হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম: আমরা যখন একটি মহাসত্যের সন্ধান পেয়েছি, যখন মানবজাতির সবচেয়ে বড় শত্রুকে চিনতে পেরেছি, সেই শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার পথও আল্লাহ দয়া করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তখন আমাদের পক্ষে স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয় নি। আমরা আমাদের পার্থিব জীবনকে নিয়োজিত করেছি সেই শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে মানবজাতিকে তার কবল থেকে মুক্ত করার জন্য। সেই শত্রু হচ্ছে পাশ্চাত্যের আত্মাহীন, বস্তুবাদী সভ্যতা যাঁকে আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) দাজ্জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি তাঁর উম্মাহকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন এই দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষকে ডাকতে, তাদের সামনে যে মহাশত্রুর আবির্ভাব হয়েছে তার সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে, তাদেরকে ঐ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ করতে। কিন্তু হায়! তারা দেখি সেই শত্রুকেই বন্ধু নয়, একেবারে প্রভুর আসন দিয়ে তার পায়ে সেজদায় লুটিয়ে আছে। সেই পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতাকেই তারা জীবনের সর্বেসবা, হুকুমদাতা, এলাহ বানিয়ে নিয়েছে।
আজ আল্লাহর রসুল (সা.) থাকলে কী করতেন? তিনি কি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে তুমুল সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতেন না? তাদেরকে জীবন সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে এই সর্ববিস্তারি অন্তবিহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে রুখে দাঁড়ানোর মন্ত্রে মো’মেন হওয়ার দীক্ষা দিতেন না? আমরা অতি ক্ষুদ্র মানুষ, কিন্তু আমরা তাঁর উম্মত হিসাবে সেই বিশাল কাজটি কাঁধে তুলে নিয়েছি। আমরা যখন এ জাতির দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন মনে হয় এই জনগোষ্ঠীর মনে মগজে যে হিমালয় সমান আবর্জনার স্তূপ জমে উঠেছে, আমরা কী পারব সেই আবর্জনার স্তূপকে সত্যের অমৃতধারায় ধুয়ে দিতে? আমরা কী কথা বললে, কীভাবে বললে তাদের চিন্তার জড়তাপূর্ণ জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে? কোন কথায় এই জনগোষ্ঠী আবার মানুষের জন্য, আল্লাহর বিজয়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে? আদৌ করবে কি না তাও জানি না।
মাঝে মধ্যে আশা জাগে, আবার আশা হারিয়ে ফেলি। কারণ গত কয়েক শতাব্দী ধরে নানাভাবে যে জাতিকে ঘরের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে সে জাতি কী করে বহির্মুখী, বিশ্বমুখী হবে? গত পাঁচশত বছর থেকে যে জাতি অন্য জাতির পদলেহন করছে, সেই জাতি কী করে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার জন্য পাগলপারা হবে? যে জাতিকে শেখানো হয়েছে যে একবার ‘সোবাহান আল্লাহ’ বললে জান্নাতে একটি গাছ পাওয়া যাবে সে জাতি কেন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে জান্নাতলাভের ক্লেশকর পথ বেছে নেবে? যে জাতি শত শত বছর থেকে গোল হয়ে জিকির করা শিখেছে, সে জাতি কি বৃত্ত ভেঙ্গে সারিবদ্ধ হয়ে সীসা গলানো প্রাচীরের মতো দাঁড়াতে পারবে?
যে জাতি পীরের দরগায় সেজদা করে, বিকৃত সুফীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে পুলসিরাত পার হয়ে যায় সেই জাতি কি পারবে ফেরাউনের চেয়েও সহস্রগুণ ক্ষমতাবান বস্তুবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকদের সামনে শির উঁচু করে দাঁড়াতে?
এসব দেখলে হতাশ লাগে। মনে হয়, জাতির চরিত্রে এই পরিবর্তন আসা সত্যিই খুব কঠিন। এত বড় পরিবর্তন না আনতে পারলে জাতি মো’মেনও হবে না, আল্লাহর বিজয় সম্ভবও হবে না। কিন্তু আবার আশা পাই, যখন দেখি পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “তিনি ও তাঁর রসুলগণ বিজয়ী হবেন”। যে সত্য দিয়ে তাঁরা বিজয়ী হয়েছেন সেই সত্য বহু শতাব্দী ধরে পৃথিবীর কোথাও ছিল না, সেই সত্য আল্লাহ আবার দান করেছেন। সেই সত্যগুলো আমরা জনসভাগুলোতে তুলে ধরছি, বই লিখে, পত্রিকা, ম্যাগাজিন বের করে, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে পথে পথে ঘুরে সেগুলো মানুষকে বলে যাচ্ছি। আমরা বলেছি যে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লিবিয়ার মুসলমানেরা নিজেদের ভূখ-, ইজ্জত, জীবন রক্ষা করতে পারে নাই, আফ্রিকা, ইয়েমেনের মুসলমানেরা দুর্ভিক্ষের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারে নাই। তাদের এই দুর্দশার কারণ তাদের কাছে এমন কোনো আদর্শ ছিল না যার ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ একটি জাতিসত্তা গড়ে তুলবে। কিন্তু ইনশাল্লাহ এই পদ্মা, মেঘনার পলিসঞ্চিত বাংলার মাটিকে, বাংলার সহজ সরল মানুষগুলোকে আমরা রক্ষা করতে পারব। কারণ সেই আদর্শ আমাদের কাছে এসে গেছে। আল্লাহ পাক দয়া করে তা মানবজাতিকে দান করেছেন।
কীসের ভরসায় আমাদের এত বড় দুঃসাহসী উচ্চারণ? সেটা হচ্ছে, আল্লাহর ওয়াদা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। তিনি মো’মেনদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি মো’মেনদেরকে রক্ষা করবেন। আমরা যদি বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের একটাই উপায়, আমাদেরকে আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন হতে হবে। আমাদের আদর্শ, আমাদের সম্পদ, আমাদের সবচেয়ে বড় সাহস হচ্ছে এটাই যে, আমরা মো’মেন হওয়ার পথ লাভ করেছি। কী সেই পথ?
সুরা হুজরাতের ১৫ নম্বর আয়াত অনুযায়ী, মো’মেন হতে হলে আমাদের প্রথম কর্তব্যই হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে জান-মাল বাজি রেখে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে আমাদের ঐক্যের সামনে পৃথিবীর সমস্ত শক্তি তুচ্ছ। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা হতাশ হয়ো না, নিরুদ্দম হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে- যদি তোমরা মো’মেন হও (সুরা ইমরান ৩৯)’। এর প্রমাণ আল্লাহ অসংখ্যবার দিয়েছেন। খন্দকের যুদ্ধের দিন যখন আরবের সকল গোত্র মিলে সম্মিলিত সামরিক জোট গঠন করে মদিনার দ্বারে উপস্থিত হলো, সেদিন মো’মেনদেরকে আল্লাহই রক্ষা করেছিলেন। তারা যে মো’মেন ছিলেন তার স্বাক্ষরও তারা রাখতে পেরেছিলেন। তারা ছিলেন এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ, এক আদর্শে দীক্ষিত, এক লক্ষ্যে অবিচলিত। জাতির প্রতিটি সদস্য সেদিন নিজ পবিত্র ধর্ম ও ভূখ-কে রক্ষার জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল।
তিনি ইব্রাহীম (আ.) কে অগ্নিকুণ্ডের ভেতরেও রক্ষা করেছেন, তিনি লোহিত সাগরের বুকে মহাসড়ক নির্মাণ করে দিয়ে ফেরাউনের বাহিনীর হাত থেকে মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের রক্ষা করেছেন, তিনি কাবাকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে শেষ রসুলকে রক্ষা করেছেন। তিনি উহুদের প্রান্তরে তাঁদেরকে রক্ষা করেছেন সামগ্রিক পরাজয়ের হাত থেকে। এই একটা আশা তিঁনি মো’মেনদের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ, তারা সংখ্যায় যত অল্পই হোক না কেন তিনি তাদের রক্ষা করবেনই।
আমাদের আশার আরেকটি জায়গা হচ্ছে, আমরা বাংলার আপামর জনগণের সামনে যখন আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি, তাদের চোখে মুখে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন ঝলসে উঠতে দেখেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষের উদ্যত হাতে মুষ্টিবদ্ধ প্রত্যয় দেখেছি। তারা আমাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন, দেশ ও ধর্ম রক্ষার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছেন। তারা যদি এখন নিজেদেরকে সত্যের ধারক করতে পারেন, স্বার্থপরতা পরিহার করে জীবন সম্পদকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করে মানুষের মুক্তির সংগ্রামে, তাহলে হয়তো আমরা সবাই হয়তো ইরাক সিরিয়ার পরিণতি বরণ থেকে রক্ষা পেয়ে যাব। কিন্তু এই জাতি শেষতক মো’মেন হবে কি না আমরা জানি না। বিকৃত ইসলাম যাদের মনে মগজে শিকড় গেড়ে আছে তারা সর্বদা আমাদের ত্রুটিসন্ধানে ব্যস্ত। তারা ফিতা দিয়ে আমাদের দাড়ি মাপে, মাথায় টুপি আছে কিনা, আমাদের কাপড় টাখনুর উপরে কিনা তা নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ নেই। এমতাবস্থায় আমরা কেবল তাদের বোধোদয়ের অপেক্ষা করতে পারি আর সত্যটি তাদের কাছে প্রচার করে যেতে পারি। আল্লাহ চাইলে একদিন নিশ্চয়ই তারা অজ্ঞানতার কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
লেখক- এমাম, হেযবুত তওহীদ
[যোগাযোগ: হেযবুত তওহীদ ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫, ০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]