মোহাম্মদ আসাদ আলী
ধর্মীয় সেন্টিমেন্টের সামনে বড় বড় পরাশক্তিরা যেভাবে ধরাশায়ী হচ্ছে, তা থেকে আমাদের দেশের অনেক কিছু শেখার আছে। বিশেষ করে আমাদের শাসক মহলের কথা বলতে হয়। একটা বিষয় কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেছে ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম সমাজে ধর্মের বিপরীতে গিয়ে যতই উন্নয়ন, মানবাধিকার, প্রগতিশীলতা, নারীমুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির গালভরা বুলি আউড়ানো হোক- সেসবের কোনো আবেদন অধিকাংশ জনগণের মধ্যে নেই বললেই চলে। মানুষ অবশ্যই স্বাধীনতা চায়, মানবাধিকার চায়, উন্নয়ন চায়, কিন্তু তার আত্মা বলে একটা বিষয় আছে যার খোরাক এগুলো দিয়ে মেটে না। তার আত্মা চায় স্রষ্টার সান্নিধ্য, স্রষ্টার সন্তুষ্টি। ধর্ম মানুষের এই আত্মার খোরাক মেটাতে পারে। তাই ধর্মের প্রতি মানুষের যে আবেগ-অনুভূতি ও দুর্বলতা, সেটার বিপরীতে অন্য সবকিছুই তুচ্ছ।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ধর্ম অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে আছে হাজার হাজার বছর ধরেই। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় অত্র অঞ্চলের সরকারগুলোকে ধর্ম নিয়ে আরও গভীরভাবে বিশে¬ষণ করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত কয়েক যুগ থেকে ধর্মই কিন্তু প্রধান ইস্যু হয়ে থেকেছে এবং সময়ের সাথে পাল¬া দিয়ে এই ইস্যু ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
বিগত প্রায় এক যুগ ধরে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন, হরতাল, অবরোধের মাধ্যমে দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করেছে। কোনোটা রাজনৈতিক ইস্যু ছিল, আবার কোনোটা ধর্মীয় ইস্যু ছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে- ধর্মীয় ইস্যুতে তারা যতটা সাড়া পেয়েছে ও জনগণের যতটা সমর্থন পেয়েছে, অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যুতে ততটা পায়নি। (অবশ্য ধর্মীয় ইস্যুগুলোর নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও কাজ করেছে) ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা বেশি বেশি ধর্মীয় ইস্যুতে আন্দোলন, বিক্ষোভ, সহিংসতা ইত্যাদি ঘটতে দেখেছি। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য ইস্যুকে সরকার অনেকটা বেপরোয়াভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবেলা করলেও ধর্মীয় ইস্যুতে সাবধানে পা ফেলার চেষ্টা করেছে। সরকার চেয়েছে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে যথাসম্ভব শান্ত রাখতে এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে যাতে জনগণের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট সরকারের বিরুদ্ধে না যায়। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে মোদীবিরোধী আন্দোলনের নামে কার্যত সরকারবিরোধী সহিংস আন্দোলনের জন্ম দেওয়া হলে সরকার কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর হতে বাধ্য হয়। এই সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হেফাজতে ইসলামের এই সহিংস আন্দোলন চলাকালেই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজত নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ কাফের, ছাত্রলীগ কাফের, যুবলীগ কাফের ইত্যাদি। হেফাজত নেতা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর বরাতে একটি বিবৃতি অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল যেখানে তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগের কেউ মারা গেলে জানাজা জায়েজ হবে না। ব্যাপক ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে হিমশিম খায়। তার মানে সরকার যা চেয়েছিল অর্থাৎ ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট সরকারের পক্ষে রাখা, সেটা ব্যর্থ হয়েছে বললে হয়ত অত্যুক্তি হবে না। এখন প্রশ্ন হলো- সরকার কতদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে এই ধর্মীয় ইস্যুগুলোকে মোকাবেলা করতে পারবে? বাংলাদেশের ক্ষমতায় যারাই আসতে চাইবে কিংবা যারা বহাল থাকতে চাইবে তারা উভয়েই ধর্মীয় ফ্যাক্টরকে উপেক্ষা করতে পারছে না। আর এই ফ্যাক্টরটি আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদীদেরও অজানা নয়। এখন যদি অত্র অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক খেলায় কোনো পক্ষ বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে তারা প্রথমেই “ধর্মীয় ট্রাম্পকার্ড” খেলতে চাইলে অবাক হবার কারণ নেই। বিশেষ করে তালেবান ইস্যুতে যখন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রকাশ্যে তালেবানকে সমর্থন দিচ্ছে তখন এটা ভাবা স্বাভাবিক যে, আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি দূরে নেই। বাংলাদেশে যত তালেবান সমর্থক পাওয়া যাচ্ছে আইএস সমর্থক তার সিকিভাগও ছিল না, তবু আমরা দেখেছিলাম ইরাক-সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের পর বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নতুন মাত্রায় পৌঁছেছিল। তাহলে বর্তমানের তালেবান উত্থানের প্রভাব কতদূর গড়াতে পারে সহজে অনুমেয়।
এ তো গেল ধর্মভিত্তিক “অরাজনৈতিক” দলগুলোর হালত, এবার নজর দেওয়া যাক ধর্মভিত্তিক “রাজনৈতিক” দলগুলোর দিকে। বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো মোটামুটি মূল ধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে বিতাড়িতই বলা চলে। রাজনৈতিকভাবে তারা বেশিদূর যেতে পারবে না তা বোঝা হয়ে গেছে। তাদের কর্মীদের নৈতিক মনোবল নষ্ট হবার শেষ প্রান্তে চলে এসেছিল আর এরইমধ্যে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় চলে আসায় বাংলাদেশের এই ইসলামপন্থী রাজনীতিতে হতাশ হওয়া তরুণ-যুবকরা প্রবলভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তারা এখন তালেবানকে “হিরো” ভাবছে। অনেকে তালেবান ফ্যান্টাসিতে ডুবে আছে, আবার অনেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে তালেবানের বিজয়-অভিযানে শরিক হবার জন্য আফগানিস্তানে পাড়ি জমাচ্ছে (তথ্যসূত্র: পুলিশ)। এর পরিণতি কী হতে পারে তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না।
একটা সেক্যুলার দল ও ধর্মভিত্তিক দলের মধ্যে বাহ্যিক তফাৎ যাই থাকুক শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই ধর্মভিত্তিক দলের কর্মীরা অনেক বেশি এগিয়ে থাকে। যারা ইসলামপন্থী রাজনীতিতে ঢোকে, তারা বিরিয়ানির প্যাকেটের লোভে বা বড় ভাইয়ের অনুগ্রহ পাবার আশায় ঢোকে না। তাদেরকে বোঝানো হয় আল¬াহ-রসুল-কোর’আনের বাণী দিয়ে। তারা আল¬াহ ও রসুলের জন্য সংগ্রাম করছে বলে বিশ্বাস করে, ফলে তাদের নৈতিক শক্তি ও মনোবল থাকে সর্বোচ্চ। রাজনীতিটা তাদের পেশা নয়, বরং স্বপ্ন ও সাধনার বিষয়ে পরিণত হয়। সেই সাধনার জন্য তারা অনায়াসে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে পারে। হাসিমুখে জীবন দিতে পারে, নিতেও পারে। প্রশ্ন হলো- এই
এই মহাশক্তিকে নির্মূল করা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তো সম্ভব নয়ই, বেতনভুক্ত কোনো সামরিক বাহিনীর পক্ষেও সম্ভব নয়। কারণ সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়- পানির তৃষ্ণা পানি দিয়েই নিবারণ করতে হয়, আদর্শের শূন্যতা পূরণ করতে হয় আদর্শ দিয়ে। সে কারণে আমরা দেখতে পাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার মত পরাশক্তিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পারে না, কারণ তারা ধর্মীয় মতাদর্শকে প্রতিস্থাপন করতে চায় ধর্মহীন মতাদর্শ দিয়ে। এই পদ্ধতি ভুল। তাদেরকে বুঝতে হবে- উগ্রবাদী ইসলামকে মোকাবেলা করতে পারে কেবল প্রকৃত ইসলাম। আফগানিস্তানে আমরা দেখলাম তালেবানরা যখন আফগানিস্তানে ইসলাম কায়েমের বুলি নিয়ে আগাচ্ছিল- তখন সরকারী বাহিনী আমেরিকার মদদ নিয়ে টিকে থাকার প্রয়াসে মত্ত। বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদারী করা ঠুনকো মনোবল নিয়ে তালেবানকে মোকাবেলা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? তালেবান সদস্যরা ভাবছিল তাদের প্রত্যেকটা জীবন যাচ্ছে আল¬াহর রাস্তায়, অন্যদিকে সরকারি বাহিনী কি তা ভাবতে পেরেছে? পারেনি। তারা ভেবেছে তাদের জীবন যাচ্ছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী নকশা বাস্তবায়নের পথে। হ্যাঁ, আশরাফ গনি যদি বলতে পারতেন তালেবানরা যে ইসলামের নামে যুদ্ধ করছে সেটা আল¬াহ-রসুলের প্রকৃত আদর্শ না, বরং আল¬াহ-রসুলের ইসলাম নিয়ে আমি দাঁড়িয়েছি, আমার সেনাবাহিনী দাঁড়িয়েছে, তাহলে সেটা হত আদর্শিক মোকাবেলা। তখন তিন লক্ষ সরকারি আর্মিও লড়াই করার মনোবল পেত। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় কারণ আসলে তালেবানরা যেমন প্রকৃত ইসলাম নয়, তেমনি আশরাফ গনির সরকারও ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য নয়। ফলে প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত, জনবিচ্ছিন্ন, বৈদেশিক শক্তির তাঁবেদার সরকারের যা পরিণতি হবার ছিল সেটাই হয়েছে।
ধর্মীয় এই ডামাডোলে আমাদের দেশের সরকারকে মোটামুটি আত্মবিশ্বাসী দেখা যাচ্ছে। তবে সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিটা কি শুধুই সামরিক শক্তি? অস্ত্র ও বাহিনী দিয়ে কতটুকু কী অর্জন করা যায় বা প্রয়োজনের সময় এগুলো কতটা কাজে আসে তা আশরাফ গনি সাহেব প্রমাণ করে দিয়েছেন। এমনকি আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন বা সহযোগিতাও যে প্রয়োজনের সময় “পরিহাসে” পরিণত হয় সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন দেখার বিষয়- বাংলাদেশের সরকার আফগানিস্তানের আশরাফ গনির সরকার থেকে কী শিক্ষা নেয়?
[লেখক: আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষক; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]