হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

আল বেরুনী (৯৭৩ খ্রি.-১০৪৮ খ্রি.)

দশম শতাব্দীর শেষ এবং একাদশ শতাব্দীর যে সকল মনীষীর অবদানে পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল, আল বেরুনী তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জীবতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব, গণিত, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, দিনপঞ্জির তালিকা ও ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস, ধর্মত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশেষ করে ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি মুসলিম বিশ্বের মনীষীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অধ্যাপক মাপা বলেন, “আল বেরুনী শুধু মুসলিম বিশ্বেরই নয় বরং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি।” তিনি পৃথিবীর ইতিহাস জগৎবাসীর সামনে রেখে গেছেন; কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর আত্মপরিচয় অনুপস্থিত। তাঁর বাল্য জীবন, শিক্ষাজীবন, দাম্পত্য জীবন ও সন্তান-সন্ততি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। সম্ভবত ঐতিহাসিকগণও এই মহাজ্ঞানী ব্যক্তির বিস্তারিত পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নি। যতদূর জানা যায়, ৩৬২ হিজরীর ৩ জিলহজ্জ মোতাবেক ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার খাওয়ারিজমের শহরতলীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম ছিল আবু রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী। তিনি নিজের নাম আবু রায়হান লিখতেন কিন্তু ইতিহাসে তিনি আল বেরুনী নামে অধিক পরিচিত হন। তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়েছিল আল ইরাক বংশীয় রাজপতি বিশেষ করে আবু মনসুর বিন আলী ইবনে ইরাকের তত্ত্বাবধানে। এখানে তিনি সুদীর্ঘ ২২ বছর রাজকীয় অনুগ্রহে কাটিয়েছিলেন। এখানে অবস্থানকালেই আস্তে আস্তে তাঁর বিচিত্র প্রতিভা ছড়িয়ে পড়ে। আব্বাসীয় বংশের খলিফাদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বহু স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এ সময় খাওয়ারিজম প্রদেশে ও দু’টি রাজশক্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রদেশের দক্ষিণাংশে রাজত্ব করতেন আল বেরুনীর প্রতিপালক আল ইরাক বংশীয় আবু আব্দুল্লাহ এবং উত্তরাংশে রাজত্ব করতেন মামুদ বিন মাহমুদ। ৯৯৪-৯৫ খ্রিষ্টাব্দে মামুন বিন মাহমুদ আবু আব্দুল্লাহকে হত্যা করে রাজ্য দখল করে নিলে আল বেরুনীর জীবনে নেমে আসে দুঃখ-দুর্দশা। যাদের তত্ত্বাবধানে তিনি সুদীর্ঘ ২২টি বছর কাটিয়েছেন তাঁদেরকে হারিয়ে তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ত্যাগ করেন খাওয়ারিজম এবং চলতে থাকেন আশ্রয়হীন ও লক্ষ্যহীন পথ ধরে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত তিনি কাটিয়েছেন অনাহারে অর্ধাহারে। এ সময় জুরজানের রাজা কাবুসের সুনজরে পড়েন তিনি। ? রাজা কাবুস ছিলেন বিদ্যোৎসাহী। জ্ঞানী ব্যক্তিদের তিনি খুব ভালোবাসতেন। তিনি ইতিপূর্বে আল বেরুনীর সুনাম শুনেছিলেন। রাজা আল বেরুনীর উন্নত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানের দিনগুলো আল বেরুনী সুখেই কাটিয়েছিলেন কিন্তু যাদের আদর-স্নেহে তিনি ২২টি বছর কাটিয়েছিলেন সেই আল ইরাক বংশীয় অভিভাবকদের কথা ক্ষণিকের জন্যও ভুলতে পারেন নি। এখানে অবস্থানকালে ১০০১-১০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘আসারুল বাকিয়া’ এবং তাজরী দুশ শুয়াত’ নামক দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন। রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তিনি ‘আসারুল বাকিয়া’ গ্রন্থটি রাজা কাবুসের নামে উৎসর্গ করেন। খাওয়ারিজমের রাজা সুলতান মামুদ বিন মাহমুদ ছিলেন বিদ্যোৎসাহী এবং তিনি আল বেরুনীর জ্ঞানে ও গুণে মুগ্ধ ছিলেন। সুলতান মামুদ এক পত্রে আল বেরুনীকে দেশে ফিরে আসার অনুরোধ জানান। তিনিও সুলতানের অনুরোধে ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে মাতৃভ‚মি খাওয়ারিজমের ফিরে আসেন এবং সুলতানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার সাথে সাথে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার কাজও চালিয়ে যেতেন। মানম
ন্দির নির্মাণ করে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণ কার্য চালান। এখানে তিনি ৫/৬ বছর অবস্থান করেছিলেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। গজনীর দিগ্বিজয়ী সুলতান মাহমুদ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের খুব সম্মান করতেন এবং তাঁর শাহী দরবারে প্রায় প্রতিদিন দেশ বিদেশের জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা নিয়ে আলোচনা হত।
সুলতান মামুনের শাহী দরবারে জ্ঞানী ব্যাক্তিদেরকে গজনীতে পাঠানোর জন্য সুলতান মাহমুদ একটি সম্মানজনক পত্রে পরোক্ষ নির্দেশ দিয়ে পাঠান। পত্র পাবার পর আল বেরুনী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ১০১৬ খ্রি. গজনীতে সুলতান মামুদের শাহী দরবারে উপস্থিত হন। মামুনের দরবারে অন্যতম বিশ্ব বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা এ প্রস্তাবকে অপমান ও আত্মমর্যাদাকে বিকিয়ে দেয়ার সামিল অ্যাখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেন এবং কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে খাওয়ারিজম ত্যাগ করেন। সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে না পেয়ে এবং ইবনে সিনার বিদ্রোহের অজুহাতে খাওয়ারিজম রাজ্য দখল করে নেন। আল বেরুনী সুলতান মামুদের একান্ত সঙ্গী হিসেবে ১০১৬ হতে ১০১৯ খ্রি. পর্যন্ত গজনীতে অবস্থান করেন।
আল-বিরুনি যে কত বড় ফলিত বিজ্ঞানী, জ্যোতিবিজ্ঞানী ও জ্যোতিষশাস্ত্রে তিনি যে কত উচ্চস্তরে স্থান লাভ করেছিলেন, এ সম্বন্ধে একটি ঘটনা উল্লেখই যথেষ্ট। একদিন সুলতান মাহমুদ গজনিতে তার হাজার বৃক্ষের বাগানে গ্রীষ্মাবাসের ছাদে বসে আল বেরুনিকে বললন, এ বাড়ির চার দরজার কোন দরজাটি দিয়ে আমি বের হবো, আপনি তা গুনে ঠিক করে একটি কাগজে লিখে আমার কম্বলের নিচে রেখে দিন। আল-বেরুনী তার আস্তারলব (astrolabe) যন্ত্রের সাহায্যে অঙ্ক কষে তার অভিমত একটি কাগজে লিখে সুলতান মাহমুদের কম্বলের নিচে রেখে দিলেন। তখন সুলতান রাজমিস্ত্রির সাহায্যে একটি নতুন দরজা সৃষ্টি করে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে দেখেন আল-বেরুনীর কাগজে অনুরূপ কথাই লেখা: “আপনি পূর্ব দিকের দেয়াল কেটে একটি নতুন দরজা করে বেরিয়ে যাবেন”। কাগজের লেখা পাঠ করে সুলতান রেগে গিয়ে ছাদ থেকে আল-বেরুনীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন। নিচে মশামাছি প্রতিরোধের জন্য জাল পাতা ছিল। সুলতানের আদেশ কার্যকর হওয়ার পর আল-বেরুনী সেই জালে আটকে গিয়ে মাটিতে আস্তে পড়ার ফলে বেশি আঘাত পেলেন না। সুলতান আল-বেরুনীকে আবার ডেকে আনলেন এবং তার চাকরের কাছ থেকে আল বেরুনীর দৈনিক ভাগ্য গণনার ডায়েরিটা নিয়ে সুলতান দেখলেন, তাতে লিখা আছে “আমি আজ উঁচু জায়গা থেকে নিচে পড়ে গেলেও বিশেষ আঘাত পাব না”। এ দেখে সুলতান আরো রেগে গিয়ে আল-বেরুনীকে জেলে পাঠালেন। এর পর আল-বেরুনীকে কারগার থেকে মুক্তির সুপারিশ করতে কেউ সাহস পেলেন না। ছয় মাস পর সুলতানের মনমর্জি বুঝে প্রধানমন্ত্রী আহমদ হাসান একদিন আল-বেরুনীর প্রতি সুলতানের নেক নজর আকর্ষণ করলেন। সুলতান মাহমুদের এ কথা স্মরণই ছিল না। তিনি তৎক্ষণাৎ তাকে মুক্তি দিলেন। (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত)
(সংগ্রহে: মো. আবু ফাহাদ)

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...