মুসলিম জাতির অনেকেই তাদের অতীত ঐতিহ্য সম্পর্কে জানে না। জানার তেমন আগ্রহও নেই। আগ্রহ থাকলেও জানার তেমন কোন পথ ও পাথেয় নেই। রাষ্ট্রশক্তি হারা মুসলমানরা তাদের অতীত ঐতিহ্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানকে ধরে রাখতে পারে নি। মুসলমানদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করে অমুসলিম বিশ্ব আজ উন্নত। অন্যদিকে বর্তমান মুসলিম বিশ্ব তাদের পূর্ব পুরুষদের দেয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে হারিয়ে আজ মূর্খ ও পরনির্ভরশীল জাতিতে হয়েছে পরিণত। এমন এক যুগ ছিল যখন সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল মুসলমানদের হাতে। জ্ঞান বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য ও সভ্যতায় মুসলিম জাতি ছিল উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ পাকের আশীর্বাদে মুসলিম জাতির মধ্যে ধন্য জাতির জন্ম হয়েছিল, যারা ছিল ঐশী জ্ঞানে মহিমান্বিত। তাঁদের মধ্যে এবং মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত সম্পর্কে হতভাগা মুসলমানদের অনেকেই জানে না। না জানাটাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে বিকৃত করে রচনা করা হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ মুসলিম সভ্যতাকে বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণের অধিকাংশের নামই বিকৃত করে লিপিবদ্ধ করেছে। তাই বর্তমান প্রজন্মের জানতে হবে তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল হারানো দিনগুলো সম্পর্কে এবং বিভিন্ন মুসলিম মনীষীদের দেয়া জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্কার সম্পর্কে। অগ্নিপুরুষ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বাঙালি মুসলমানদের চোখের সামনে তাঁদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস তুলে ধরার দুর্বার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন।
তিনি তাঁর ‘স্পেন বিজয়’ কাব্য গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন’
“গাবো সে অতীতের কথা, গৌরব কাহিনী,
নাচাইতে মুসলেমের নিস্পন্ধন ধমনী
গাবো সে দুর্দম বীর্য দীপ্ত উন্মাদনা,
কৃপা করি অগ্নিময়ী করো এ রসনা।”
পৃথিবীতে মুসলমানদের উন্নতির জন্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আশীর্বাদ হিসেবে যুগে যুগে যে সকল মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে ছিলেন আল ফারাবী তাঁদের অন্যতম। তাঁর জন্ম তারিখ কত তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তাঁর জন্ম তারিখ কত তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তাঁর জন্ম তারিখের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো তৎকালীন যুগে কারো জন্ম তারিখ লিখে রাখার ব্যাপারে তেমন কোনো গুরুত্ব ছিল না।
যতদূর জানা যায় এ মনীষী ৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কিস্তানের অন্তর্গত ‘ফারাব’ নামক শহরের নিকটবর্তী ‘আল ওয়াসিজ’ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবু নাসের মোহাম্মদ ইবনে মোহাম্মদ। ‘ফারাব’ নামক শহরের নামানুসারে আবু নাসের পরবর্তীতে ‘আল ফারাবি’ নামে পরিচিত হন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, অনেকেই তাঁদের জন্মস্থান, নিকটবর্তী শহর কিংবা দেশের নামে পরিচিত ছিলেন। আল ফারাবির ক্ষেত্রেও তার বিপরীত ঘটে নি। ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ তাঁর নামকে বিকৃত করে ‘ফারাবিয়াস’ লিপিবদ্ধ করেছে। আল ফারাবির পিতা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন পারস্যের অধিবাসী। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ও রাজনৈতিক কারণে তাঁর পূর্বপুরুষগণ পারস্য ত্যাগ করে তুর্কিস্তানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
আল ফারাবী বাল্যকাল থেকেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। অজানাকে জানার এবং অজেয়কে জয় করার প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল তাঁর হৃদয়ে। তাই জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁর সারাটি জীবন। জ্ঞানের সন্ধানে তিনি ছুটে চলেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় ফারাবায়। সেখানে কয়েক বছর শিক্ষালাভের পর শিক্ষার উদ্দেশ্যে চলে যান বোখারায়। এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে তিনি গমন করেন বাগদাদে। সেখানে তিনি সুদীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর অধ্যয়ন ও গবেষণা করেন। কয়েকটি ভাষার উপর ছিল তাঁর পূর্ণ দখল। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ছিলেন তিনি পারদর্শী। দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা বাকি ছিল না, যেখানে ফারাবির প্রতিভা বিস্তৃত হয়নি। কিন্তু তারপরও জ্ঞানের পিপাসা তাঁর মিটে নি। জ্ঞানের অন্বেষণে তিনি ছুটে গিয়েছেন দামেস্কে, মিসরে এবং দেশ বিদেশের আরো বহু স্থানে। গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখা নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রভৃতিতে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে বিজ্ঞান ও দর্শনে তাঁর অবদান ছিল সর্বাধিক। পদার্থবিজ্ঞানে তিনিই ‘শূণ্যতার’ অবস্থান প্রমাণ করেছিলেন। দার্শনিক হিসেবে ছিলেন ‘নিয়োপ্লেটোনিস্ট’দের পর্যায় বিবেচিত। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক হিসেবে তিনি আরোহণ করেছিলেন জ্ঞানের শীর্ষে।
একবার আলেপ্পোর আমীর সাইফ আদ দৌলার শাহী দরবারে মনীষী আল ফারাবি উপস্থিত হন। ইতিপূর্বে আমীর আল ফারাবীর নাম শুনেছিলেন কিন্তু ফারাবীর সাক্ষাৎ পান নি। ফারাবিকে নিকটে পেয়ে আমীর খুব খুশি হন এবং জ্ঞান বিজ্ঞান নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আলোচনায় ফারাবীর জ্ঞান ও গুণাবলীতে আমীর মুগ্ধ হন এবং তাঁকে খুব সম্মান দেখান। বিজ্ঞানী আল ফারাবি আমীরের সঙ্গী হিসেবে এখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন।
বিজ্ঞানী আল ফারাবি সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, যুক্তিশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে বহু রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক বলে অনেকে উল্লেখ করেছেন। এ সকল অমূল্য গ্রন্থের অধিকাংশরেই সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর রচিত ‘আলা আহলে আল মদীনা আল ফাদিলা’ (দর্শন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত) গ্রন্থটি সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। সমাজ বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থ তাকে বিখ্যাত করেছে।
তিনি আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই কিন্তু মুসলিম জাতির কল্যাণে তিনি জ্ঞান বিজ্ঞানের যে মৌলিক আবিষ্কার রেখে গেছেন তা চর্চা না করে মুসলমান সমাজ এখন বিভিন্ন মাসলা-মাসায়েল নিয়ে চর্চা করে শত শত ফেরকা মাজহাবে বিভক্ত হয়ে আছে। যার পরিণামে তারা জাতি হিসাবে নিকৃষ্ট পর্যায়ে পতিত হয়েছে এবং অন্যান্য সকল জাতির পদানত হয়ে সমগ্র বিশ্বে লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছে। আল ফারাবি কত সালে ইন্তেকাল করেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। যতদূর জানা যায় তিনি ৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন। সংগ্রহে: আবু ফাহাদ