ঘটনাটা আকর্ষণীয় নয় খুব। নাটকীয় তো নয়ই। সেজন্যই আমরা তা চট করে ভুলেও গেছি। আর আজকাল যে পশ্চিমারা ইতিহাসের ফসিল খুঁড়ে তত্ত্ব ও তথ্য বের করেন তাঁরা বোধহয় ইচ্ছে করেই চেপে গেছেন। অথচ ঘটনাটা পশ্চিমে ঘটলে সেটা সোনার অক্ষরে লিখে আইফেল অথবা সি. এন. টাওয়ারের ডগায় টাঙিয়ে দেয়া হতো। দুর্ভাগ্য, হতভাগা বাংলায় ঘটেছিল সেটা।যত নীরসই হোক, ঘটনাটা আমাদের জানা দরকার। কারণ আমাদের শরীরের শিরা উপশিরায় রক্ত নামক যে লাল পদার্থটি বইছে তা আকাশ থেকে হঠাৎ আসেনি। আমাদের পূর্বপুরুষেরাই সেটা দিয়ে গেছেন। আমাদের সেই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহের (৯ বার) অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহরা আজ থেকে প্রায় ১২৬০ বছর আগে এই বাংলায় একটা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁদের দিকে তাকানো যাক এক পলক।
প্রাচীন, অতি প্রাচীন বাংলা। গোলায় উপচে-পড়া ধান আর পুকুর-ভরা মাছের দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেশের সন্তান, আমাদের পূর্বপুরুষ। সবল, সুঠাম, বলদৃপ্ত বাঙালি ও বাঙালিনি। শির নেহারি তাঁর, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির। পৃথিবীর বিস্ময়। সুদূর ইউরোপ থেকে ছুটে আসা দিগ্বিজয়ী বন্যা ঠেকিয়ে দিয়েছেন দু’দুবার।
কিন্তু এবার বাংলা পরাজিত হলো। কনৌজ (আধুনিক লক্ষ্ণৌ)-এর রাজা যশোবর্ম বাংলা জয় করলেন। “বিজয়ীর কাছে আনুগত্য স্বীকার করে নেবার সময় ওদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল, কারণ ওরা এজাতীয় কাজে অভ্যস্ত নয়”, লিখে গেছেন যশোবর্মের সভাকবি বাকপতিরাজ তাঁর “গৌড় বহো” গ্রন্থে। কিন্তু কিছুদিন পরই যশোবর্ম পরাজিত হলেন কাশ্মীর রাজ লালিত্যমোহনের কাছে। শুরু হলো বিপর্যয়। ৭৩৫-৭৪০ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা।ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল বাংলা। অতদূর থেকে শক্ত হাতে বাংলার শাসন-ব্যবস্থা নিতে পারলেন না লালিত্যমোহন। ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েকশ’ রাজা মহারাজা গজিয়ে উঠল বাংলায়। নিজেদের মধ্যে লড়াই আক্রমণ লেগেই আছে। মানসিক ও সামরিক শক্তি কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে দ্রুত। সুযোগ পেয়ে গুটিগুটি এগিয়ে এল বহিঃশত্রু। বাংলা আক্রমণ করে লুটে নিয়ে গেল তিব্বতীরা। কিছুদিন পর কামরূপ সৈন্য। আবার কিছুদিন পর কনৌজ সৈন্য। লুটে নিয়ে গেল কাশ্মীরের সৈন্যরাও।
নাভিশ্বাস উঠে গেল বাংলার রাজাদের। বিদেশি লুটেরাদের বাধা দেবার এতটুকু শক্তি তখন তাদের বাকি নেই।কিন্তু চেতনা বাকি ছিল। বাকি ছিল অত্মর্দৃষ্টি। ভুল বুঝতে সময় লাগল না। প্রতিকারের পথ একটাই, ঐক্য। বড় কঠিন সে পথ। স্বার্থত্যাগের আহ্বান সে পথে পদে পদে। ভূস্বামীদের জন্য আরো কঠিন। কিন্তু সমস্ত বাধাই অতিক্রম করে ইতিহাস রচনা করলেন তাঁরা। এমনই হয়। জননী জন্মভূমির হাহাকার আর্তনাদ যদি শুনতে পাও, সহস্র কঠিন গলে পানি হয়ে যাবে এক দিকে। প্রমাণ আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। প্রমাণ আছে সেই ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের সভায়। ঐক্য চাই। এক বাংলার এক রাজা চাই। কে হবে রাজা? কে ধরবে হাল এই ভাঙ্গা নৌকোর? কেন, ঐ তো আছে! রাজশাহীর (প্রাচীন নাম বরেন্দ্র) রাজা গোপাল। ধর্মে বৌদ্ধ, দক্ষিণরাজের কন্যা তাঁর স্ত্রী। উত্তরে দক্ষিণে সবাই ভালো বলে তাঁকে।
“স্বদেশকে আরো অধিক অরাজকতার হাত হইতে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, সকলে একত্র মিলিত হইয়া (বাংলার) জনগণের পক্ষ হইতে গোপালকে তাঁহাদের একচ্ছত্র নেতা বা রাজা নির্বাচিত করিয়াছিলেন। এভাবে নেতা নির্বাচিত করিয়া আজ হইতে বারো শত বৎসর পূর্বে মানসিক উৎকর্ষ, দূরদর্শিতা ও আত¥ত্যাগের পরিচায়ক। সংক্ষিপ্ত সময়ে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করিয়া তিনি সে দায়িত্ব সুচাররুপে পালন করেন” (পিতৃভূমি ও স্বরূপ অম্বেষণ ফারমুর হাসান)।
তারপর? শুধুমাত্র ‘শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত’ করেই কি গোপালের শক্তি ফুরিয়ে গেল? তাই কি হয়? ঐক্যবদ্ধ বাংলা যার পেছনে, তার হাতে তো আলাদীনের প্রদীপ! সেই প্রদীপের শক্তিতে কি না হয়! যতবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বাঙালি, কোনও অসম্ভবই অসম্ভব থাকেনি আর। প্রমাণ আছে একাত্তরে। আক্রমণকারী শত্রুরা লেজ গুটিয়ে পালালো বেত্রাহত কুকুরের মতো। বাড়ছে বাংলার রাজ্যসীমা।
এক এক ক’রে বৃহত্তর বাংলাকে সংহত করে শক্তিশালী করে শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম নির্বাচিত নেতা গোপাল। হাল ধরলেন পুত্র ধর্মপাল।পরের ঘটনা সহজ, সরল। আলাদীনের প্রদীপ ধর্মপালের হাতে। সে প্রদীপ হলো ঐক্যবদ্ধ বাঙালি। বন্যার মতো সে শক্তি ছুটে গেল দিকে দিকে। সারা ভারতবর্ষ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে। দাবাগ্নির মতো ধেয়ে আসছে বাঙালি। ছুটে আসছে ক্ষ্যাপা ঐরাবতের মতো। বাধা দেবার কথা বুঝি কল্পনাও করা যায় না। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাকানো যাক দলিলের দিকে।“কনৌজ (লক্ষ্ণৌ জয় করার পর) এক দরবারের আয়োজন করেন। ঐ দরবারে ভোজ, মৎস, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবস্তী, মালব, বেরার, গান্ধার, পেশোয়ার, কীর প্রভৃতি প্রাচীন রাজ্যগুলির রাজগণ উপস্থিত হইয়া বাঙালি ধর্মপালকে অধিরাজ বলিয়া স্বীকার করেন” (খালিমপুর তাম্রশাসন)। “ধর্মপালের সময় বাঙালির রাজ্যসীমা বঙ্গোপসাগর হইতে পাঞ্জাবের জলন্ধর এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য পর্বত পর্যন্ত বিস্কৃত ছিল” (তিব্বতি ঐতিহাসিক তারানাথ)।
ধর্মপাল মারা গেলেন। রাজা হলেন পুত্র দেবপাল। তখনো অনেক বাকি। বাঙালি তখনো ঐক্যবদ্ধ। দেখতে দেখতে আসাম আর উড়িষ্যা জয় হয়ে গেল। তাড়া খেয়ে ফিরে গেল তুর্কি জাতির পূর্বপুরুষ হুন সৈন্যরা। যুদ্ধে নিহত (মতান্তরে পরাজিত) হলেন দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় রাজা আমোঘবর্ষ। বিশাল সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু শাসনের জন্য পিতা ধর্মপাল রাজধানী সরিয়ে নিয়েছিলেন পাটালিপুুত্রে (পাটনা)। সেখানে বসে বাঙালি দেবপাল শাসন করলেন চট্টগ্রাম থেকে জলন্ধর, আসাম থেকে দক্ষিণ ভারত। ৮২০ খ্রীষ্টাব্দের কথা সেটা। মৃত্যুশয্যা থেকে উঠে এসে ভারতবর্ষের মাথায় চড়ে বসতে বাঙালির সময় লাগল মাত্র ৭০ বছর।বাঙালির সামরিক বীরত্বের কথা ঘটা করে বলবার জন্য এ লেখা নয়, যদিও সে-সময়ে বাঙালির কাছাকাছি সামরিক শক্তি ভারতবর্ষে কারো ছিল না। এতবড় সুবিশাল সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার মতো অতি উঁচুস্তরের মেধা ও পারদর্শিতা বাঙালির ছিল এ-কথা প্রমাণ করবার জন্যও এ লেখা নয়, যদিও সেটা অতি সত্য।আমি শুধু এক আশ্চর্য প্রদীপের কথা বলছি। ঐক্য। যা দিয়ে নিকষ অন্ধকার দূর করা যায়। আমাদের রক্তে যা দিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা, এবং ইতিহাসের ওপার থেকে আমাদের দেখছেন।
কি ভাবছেন কে জানে!