ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট আসন্ন। জনসাধারণ এই সংকট মোকাবেলায় কী প্রস্তুতি নিচ্ছেন? গত কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হচ্ছে এখানে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এর কারণ বুঝতে ছোট একটি উদাহরণই যথেষ্ট। একটি বড় পুকুরে যদি এক লক্ষ পুঁটি মাছ থাকে আট দশটা রাক্ষুসে শোলমাছ আর তিন চারটা বোয়াল মাছ সেখানে ছেড়ে দিন। ব্যাস, ছয়মাস পরে সেখানে কয়টা পুটিমাছ বেঁচে থাকবে? অধিকাংশই চলে যাবে বোয়াল আর শোলমাছের পেটে। দু একটা পুঁটি যদি লুকিয়ে-চুরিয়ে বেঁচেও থাকে তবে এরই মধ্যে তারা প্রত্যেকে দু’ চারবার করে মৃত্যুর মুখদর্শন করে ফেলেছে।
বাংলাদেশে সেটাই হয়েছে। ভয়াবহ দুর্নীতি, অর্থপাচার, সুদভিত্তিক অর্থনীতি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো গজিয়ে ওঠা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া দখদারিত্ব দেশের পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিরাট একটি খাদের পাড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। যেভাবে আন্তর্জাতিক পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেটার প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের উপর পড়বে। কারণ আমরা ঐ দেশগুলোর উপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এই প্রযুক্তির যুগে আমাদের দেশে একটা সুঁই বানানোর প্রযুক্তি নেই, ইলেকট্রনিক প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ আমাদের আমদানি করতে হয়। বিপুল খাদ্যশস্য আমরা প্রতিবছর আমদানি করি। আমি অর্থনীতিবিদ নই, তবু মোটাদাগে আমাদের অর্থনীতির যে সংকটগুলো দৃশ্যমান আমি সেগুলোই তুলে ধরছি।
১. গত কয়েক দশকের তুলনায় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন সস্তা শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে এসেছে। শ্রমিকরা আর সস্তায় শ্রম দিতে পারবে না। ফলে এদেশে বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রগুলো সস্তা শ্রমের জন্য অন্যান্য দরিদ্র দেশের দিকে দৃষ্টি দেবে।
২. বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অধিকারী খুবই কম। ব্রিটিশদের প্রবর্তিত কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কেবল কেরাণিই তৈরি হচ্ছে যারা সরকারি/বেসকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ছাড়া আর কিছুই করতে সক্ষম নন। কিন্তু সরকারি চাকরির ক্ষেত্রগুলো দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে এবং অল্পদিনের মধ্যে সরকারি চাকরির সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে। কারণ ইতোমধ্যেই সরকারি অফিস আদালতে এমন বিপুল সংখ্যক লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাদের বলতে গেলে তেমন কোনো কাজই নেই। গল্পগুজব করে তারা মাসের শেষে বেতন তোলেন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। কথায় আছে, বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও খালি হয়ে যায়।
৩. দেশের পয়সাওয়ালারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, জানজট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ইত্যাদি নানা অজুহাতে তারা এখন বিদেশমুখী।
৪. এক ইঞ্চি জমিও বাড়ে নি কিন্তু ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের কারণে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে কৃষকরা জীবিকা হারাচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্ব আর ওদিকে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে।
আমরা হেযবুত তওহীদ এমন একটি আন্দোলন যাকে আদর্শগত কারণেই দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে হয়। আমরা প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক, অতিদরিদ্র দিন মজুর সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলি, তাদের সঙ্গে মিশি, তাদের সঙ্গে খাই। তাদের সুখ-দুঃখ খুব কাছ থেকে দেখি, শুনি। কাজেই সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে কী যে তপ্ত মরুর লু হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে তা আমরা যেভাবে জানি অনেকেই সেভাবে জানার সুযোগ পান না।
প্রায় প্রত্যেকটি কৃষক আজ ঋণের দায়ে জর্জরিত। হয় কোনো এনজিও থেকে, নয় কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে প্রত্যেকদিন কিস্তির টাকা গুনছে। কিস্তির টাকা দিতে না পেরে কত দরিদ্র মানুষ যে সর্বহারা ভিখারীতে পরিণত হয়েছে, কতজন যে আত্মহত্যা করেছে তার হিসাব নেই। এক এনজিওর ঋণ শোধ করার জন্য আরেক এনজিও থেকে চড়া সূদে ঋণ নিচ্ছে মানুষ।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কারণে পুঁজি হারিয়ে পথে বসছেন প্রতিদিন। সামান্য চাটনি, মাঠা, হলুদ-মরিচের গুড়া, কুলা, বসার পিঁড়ি, শলার ঝাড়ু পর্যন্ত উৎপাদন ও বাজারজাত করছে রাঘব বোয়াল শিল্পপতিরা। আমার এক সমাবেশে আলোচনা চলাকালে একটি চিঠি আমার হাতে আসে। যিনি লিখেছেন তাকে আমি চিনি না। তার হাতের লেখা বুঝতেও অনেকের অসুবিধা হবে। তিনি লিখেছেন: “এমাম ভাই, আসসালামু আলাইকুম। ভাই আমি অনেক দুঃখী। আমার সাত লক্ষ টাকা ঋণ। আমি চা বেচে খাই। আল্লাহ ছাড়া আমার আর কেউই নাই আমাকে দেখার। তাঁর পরই এমামের দোয়া চাই যেন আমি একদিন তওহীদে আসি। আমার দোকান চলে না ভাই। না খাওয়ার মতো আমি চার বছর যাবৎ। আপনার সাথের রিপন ভাই জানেন আমার অভাবের কথা। ভাই, আগে আল্লাহ, আপনি অসিলা। পথ দেখান। বেয়াদবি হলে মাফ করবেন।”
এমনই অবস্থা দেশের কোটি কোটি মানুষের। কোনো একটা বিপদ-আপদ হলে নিজের পকেট থেকে দশ হাজার টাকা খরচ করার সামর্থ্যও তাদের নেই। কয়েকদিন আগে আমাদের তিনটি বোন একটি অটোরিক্সায় করে যাচ্ছিলেন। পথে একটি তেলবাহী ট্রাক আর বাসের মধ্যে শুরু হয় পাল্লাপাল্লি। বাসটির ধাক্কা খেয়ে ছোট্ট সিএনজিটি পড়ে যায় রাস্তার পাশের পানিভর্তি খাদে। ডুবে যাওয়া সিএনজির ভিতর থেকে তাদেরকে টেনে বের করা হয়। তাদের একজনের অবস্থা গুরুতর খারাপ। একটি পা সম্পূর্ণ গুড়ো হয়ে গেছে, সারা শরীরেও ভয়াবহ সব আঘাত। তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি স্ত্রীর চিকিৎসাবাবদ কোনো খরচ দিতে পারবেন কিনা? তিনি বলেন, একটা ট্যাবলেট কেনার পয়সাও তার কাছে নেই। যেহেতু মেয়েটা হেযবুত তওহীদের তাই আমরা তো আর ফেলে দিতে পারি না। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত ঢাকা এনে ভর্তি করা হয়।
বলা হয় বাংলাদেশ অচিরেই মধ্যম আয়ের দেশ হচ্ছে, কতশত উন্নয়নের ফিরিস্তি আর মেগা মেগা প্রজেক্টের গালগল্প আমরা রোজ শুনি। সেই উন্নতি কিন্তু বাংলার আপামর জনগোষ্ঠীর উন্নতি নয়। কিছুদিন আগে বিবিসির একটি সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অতি ধনীদের সংখ্যা হুড়মুড় করে বাড়ছে। অতি ধনী বলে তাঁদেরই বিবেচনা করা হয়েছে যাঁদের সম্পদের পরিমাণ তিন কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় যাঁদের সম্পদ ২৫০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে অতি সম্পদশালীর বৃদ্ধির হার ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
একদিকে এমন এমন ধনকুবেরে বাংলাদেশ ভরে যাচ্ছে যাদের অর্থের পরিমাণটাও আমাদের কল্পনায় আনার সামর্থ্য নেই, অপরদিকে তিনবেলা ভাতের যোগাড় করতে গলদঘর্ম অধিকাংশ মানুষ। এই বৈষম্য দিন দিন আরো বাড়বে চর্চিত সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির ফলে। মেগা মেগা প্রজেক্টের অধিকাংশ অর্থই পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। এক কিলোমিটার রাস্তা বানাতে চীনে যদি খরচ হয় ২৫ কোটি টাকা, আমাদের দেশে খরচ করা হয় ১২৫ কোটি টাকা। কিন্তু সেই রাস্তা টেকে না এক বছরও। সেই টাকা চলে যাচ্ছে অতি ধনীদের মারফত হয়ে বিদেশের ব্যাংকে। সেখানে গড়ে উঠছে তাদের প্রাসাদোপম সেকেন্ড হোম। এত চুরি, এত দুর্নীতির বোঝা কিন্তু বাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে ষোল কোটি সতের লক্ষ মানুষের মাথায়। ফলে আমাদের প্রতিটি শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে। এই ঋণ জাতিকে শোধ করতে হবে আরো না পরে, আরো না খেয়ে।
কিন্তু এই সংকটের দিকে কেউ নেত্রপাতও করছেন না। ভাবখানা এমন, এভাবে তো চলছে বছরকে বছর। এভাবেই চলবে। দেখা যাক কী হয় শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সব মিলিয়ে জাতি এখন চূড়ান্ত ধ্বংসের কিনারায় এসে গেছে। এখন চূড়ান্ত পতনটা বাকি। যে কোনো মুহূর্তে এই পতন ঘটবে। তাই রাশ টানাটা জরুরি।