আমি কে? মানুষ। মহান আল্লাহর অগণিত সৃষ্টির একটি অংশ। আমাকে মহান আল্লাহ সকল সৃষ্টি থেকে আলাদা করে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন (সুরা সাদ- ৩৫)। কিন্তু কেন? আমি কি সে প্রশ্নের উত্তর জানি? আমাকে সৃষ্টি করে তিনি পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন কেন? কী উদ্দেশ্যে আমি পৃথিবীতে এসেছি? একজন মানুষ হিসেবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা খুব জরুরী কারণ এ উত্তরগুলোই আমার পরিচিতি তুলে ধরবে। তাই লেখার শুরুতেই এ প্রশ্নগুলোকে লিপিবদ্ধ করলাম।
যদি শুরু থেকে চিন্তা করি তবে মহান আল্লাহ আমাকে অর্থাৎ মানুষকে তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাত উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তাই প্রথমেই জানতে হবে মহান আল্লাহ আমাকে কেন সৃষ্টি করলেন। এ সৃষ্টির কারণ তিনি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন পবিত্র গ্রন্থ আল কোর’আনে। তিনি বলছেন, “যখন তোমার প্রতিপালক মালায়েকদেরকে বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা অর্থাৎ প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।’ তারা বললো, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।’ তিনি বললেন, নিশ্চয়ই ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না’ (সুরা বাকারা- ৩০)।” তাহলে তিনি আমাকে তৈরি করলেন তাঁর প্রতিনিধিস্বরূপ, ইংরেজিতে যার অর্থ Vicegerent, Representative । অর্থাৎ, প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে বলা যায়, আমি মানুষ যে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি; যার কাজ তাঁর হয়ে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব করা।
তাহলে এখন দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। যদিও দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রথম প্রশ্নের উত্তরেই চলে এসেছে। মহান আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। কিন্তু বিষয়টি সহজভাবে প্রকাশ করা গেলেও উপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। ছোট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরুন, আপনার বাবাকে কোনো একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হলো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি যেতে না পারায় আপনাকে তার হয়ে অনুষ্ঠানে যেতে বললেন। সে অনুষ্ঠানে আপনার কাজ হচ্ছে আপনার বাবা ও আপনার পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করা। আপনি সেখানে একটি সিদ্ধান্ত দিলে সেটি আপনার বাবার দেয়া সিদ্ধান্ত হিসেবেই গৃহিত হবে। আপনাকে তারা যে সম্মান ও আতিথেয়তা প্রদর্শন করবে সেটিও সে কারণেই। অর্থাৎ, আপনি আপনার বাবার হয়ে সেই অনুষ্ঠানে আপনার বাবার কাজটি সম্পাদন করবেন, কারণ আপনার বাবা আপনাকে সে ক্ষমতা প্রদান করেছেন। পার্থক্য শুধু এতটুকুই যে তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী আর তখনকার জন্য আপনার কার্যক্ষেত্র শুধুমাত্র সে অনুষ্ঠান।
এখন প্রতিনিধি ও প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি যদি বুঝতে পারেন তবে প্রশ্ন আসে যে, মহান আল্লাহ যখন আমাদের সৃষ্টি করলেন এ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তখন কী আমাদের মধ্যেও মহান আল্লাহর মত ক্ষমতা রয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তরও জানা যায় (সুরা হিজর- ২৯) নম্বর আয়াত থেকে। সেখানে আল্লাহ বলেন যে, তিনি আদমের দেহে নিজের রূহ ফুঁকে দিলেন। অর্থাৎ, আদম তথা মানুষের মধ্যে আল্লাহর একটি অংশ রয়েছে। বাস্তব জীবনেও যদি আপনি চিন্তা করেন তবে এর সত্যতা খুঁজে পাবেন। আল্লাহর রূহ অর্থাৎ আল্লাহর সিফতসমূহ। চিন্তা করুন, আল্লাহ পরম করুণাময় তাই মানুষের মধ্যেও করুণা রয়েছে, আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা তাই মানুষও সৃষ্টি করতে পারে, আল্লাহ পরম জ্ঞানী, তাই মানুষের মধ্যেও সে গুণ রয়েছে, আল্লাহ পরম দয়ালু। এভাবে দেখলে দেখা যাবে যে মহান আল্লাহর প্রতিটি গুণ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। তাহলে এ প্রতিনিধির কাজ কী?
মহান আল্লাহর এ সকল সিফতের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তিনি হুকুমদাতা। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক। এ মহাবিশ্ব তাঁর হুকুমে পরিচালিত হয় এবং এটিই তাঁর প্রকৃত কাজ। তাহলে তাঁর খলিফা হিসেবে মানুষের প্রধান কাজও একই। তফাৎ শুধু মানুষ এ পৃথিবীর প্রতিনিধি তাই সে এ পৃথিবীকে পরিচালনা করবে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, কীসের ভিত্তিতে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছি যে মানুষের কাজ পৃথিবীকে পরিচালনা করা? এ সম্পর্কেও আল্লাহ কোর’আনে বলে দিয়েছেন।
(সুরা বাকারা- ৩০) নম্বর আয়াতে আল্লাহ যখন তাঁর সিদ্ধান্তের কথা মালায়েক বা ফেরেশতাদের বললেন, তখন তাঁরা যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন যে “আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসা, গুণকীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি”। তাহলে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, মালায়েকরা মহান আল্লাহর সিদ্ধান্ত শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এ সৃষ্টির ভিতর আল্লাহর গুণাবলী থাকবে। অর্থাৎ, এর মধ্যে আল্লাহর গুণাবলীর অন্যতম একটি গুণ, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও থাকবে। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থাকবে। যে ইচ্ছাশক্তির উপর ভিত্তি করে এ সৃষ্টি যেকোনো কিছু করতে পারবে। এমনকি মহান আল্লাহকে অস্বীকার করার মত ধৃষ্ঠতাও তারা দেখাতে সক্ষম। সে ধারণা থেকেই তাঁরা বলেছিলেন, এ সৃষ্টি এ ক্ষমতা পাওয়ার পর নিজেদের ক্ষমতাসীন মনে করে একজন অন্যজনের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবে। যার দরুণ ফ্যাসাদ অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও সাফাকুদ্দিমা রক্তপাত ঘটাতেও তারা দ্বিধা করবে না।
এর পরবর্তী ইতিহাসও স্পষ্ট। মহান আল্লাহর রূহ প্রবেশ করার সাথে সাথে মানুষের মধ্যে আল্লাহর ‘হুকুম’ প্রবেশ করল। আল্লাহ মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষা দিলেন (সুরা বাকারা- ৩১) এবং সে জ্ঞানের মাধ্যমে আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে প্রমাণ করে দিলেন যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ (সুরা বাকারা- ৩২)। তিনি ফেরেশতাদের সিজদা করার হুকুম দিলেন এবং তারা মানুষের আনুগত্য করার শপথ নিল (সুরা বাকারা- ৩৪)। অর্থাৎ, ফেরেশতারা মানুষকে তাদের থেকে উত্তম হিসেবে ধরে নিল কারণ মানুষের মধ্যে আল্লাহর রূহ আছে, অংশ আছে যা তাদের মধ্যে নেই। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ এর মাধ্যমে দুনিয়া পরিচালনাকারী প্রাকৃতিক শক্তিদের মানুষের সেবায় নিযুক্ত করলেন, যেমনটি এখন প্রতিটি উপাদান যেমন, মাটি, পানি, বায়ু, বিদ্যুৎ, চুম্বক ইত্যাদি মানুষ তাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করছে। কিন্তু একজন মাত্র অবাধ্য হয়েছিল, ইবলিস। কারণ ইবলিস মালায়েক ছিল না, সে জ্বীন জাতির অন্তর্ভূক্ত ছিল। কঠিন এবাদত ও রেয়াযত করে সে মালায়েকদের সর্দারে পরিণত হয়েছিল। আগুনের তৈরি জ্বীন ইবলিসের মধ্যে তাই অহংকার প্রকাশ পেল এবং সে অহংকারের দরুণ সে অবাদ্ধ হলো।
এখন ভেবে দেখুন তো, মহান আল্লাহ যখন ইবলিসকে মাটির আদমের জন্য অবাধ্য ঘোষণা করলেন, তাঁর নৈকট্য থেকে বিতারিত করলেন তখন ইবলিসের কার উপর রাগ করার কথা? স্বভাবতই আদম বা মানুষের উপর। কারণ এ সৃষ্টি যদি না হতো, মানুষ যদি না থাকত তবে ইবলিস আগের মতই তার নিজ অবস্থানে বহাল থাকত। তাই ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। সে তখন আল্লাহকে বলল, যদি আমাকে এ শক্তি দাও যে আমি মাটির তৈরি তোমার এ সৃষ্টির দেহ ও মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারি তবে আমি প্রমাণ করে দিব এ সৃষ্টি তোমার খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের কাজ বাদ দিয়ে ফ্যাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করবে। মহান আল্লাহ ইবলিসের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং তাকে প্ররোচিত করার ক্ষমতা প্রদান করলেন (সুরা বাকারা ৩৬, নিসা ১১৯)।
তবে আল্লাহ এরই পাশাপাশি মানুষের জন্য হাদি বা পথপ্রদর্শক প্রেরণের আশ্বাসও দিলেন (সুরা বাকারা- ৩৮)। তাহলে এ পথপ্রদর্শকগণ আমাদের কী শিখিয়েছে? তাঁর প্রতিবারই এসে আমাদের আল্লাহর হুকুম স্মরণ করিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের (স.) মাধ্যমে আল্লাহ একটি জীবনব্যবস্থা, দীন ও একটি কর্মপদ্ধতি প্রেরণ করলেন যা অনুযায়ী মানুষ এ পৃথিবীকে পরিচালনা করবে। মানুষ তাকে সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে। এ দীন বা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে সমাজে আর ফ্যাসাদ, অন্যায়-অশান্তি-যুদ্ধ ও সাফাকুদ্দিমা, রক্তপাত হবে না। বরং ব্যক্তির জীবনে, পরিবারে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি। তাই তিনি সকল নবী ও রসুলের মাধ্যমে এ জীবনব্যবস্থাই পাঠালেন যেটা অনুসরণ করলে মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করবে এবং এর ফলে ইবলিস তার চ্যালেঞ্জে পরাজিত হবে। নবী রসুলগণ মানুষকে কর্মপদ্ধতি শেখালেন। যে সকল মানুষ অবাধ্য হয়েছে, অন্যায়-অত্যাচার ও রক্তপাতের মাধ্যমে পৃথিবীকে কলুষিত করেছে, ইবলিসের তাবেদারি করেছে, তাদের সুপথে আসার আহ্বান করলেন এবং যারা সুপথে ডাকছে তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করে দিলেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালনা করতে হবে তা তাঁর প্রেরিত নবী রাসূলদের মাধ্যমে শিক্ষা দিলেন। শেষ রসূলের উপর শেষ আসমানী গ্রন্থ পাঠানোর মাধ্যমে তিনি পরিচালনা করার এই শিক্ষা ও পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ ঘোষণা করলেন। তাঁর সেই শিক্ষা ও কর্মপদ্ধতির সংকলন কোরআন এর মাধ্যমে তিনি এই পৃথিবীকে পরিচালিত করার উপায় বলে দিয়ে তাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার নির্দেশ দিলেন। এরই সাথে শেষ রসূলের (স.) মধ্যে এমন গুণাবলী দিলেন যাতে তাঁকে অনুসরণ করে প্রতিটি মানুষ মহান আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত খলিফায় পরিণত হতে পারে। অতএব মানুষ হিসেবে আমাদের মূল কাজই হচ্ছে মহান আল্লাহ পাঠানো এ দীন ধারণ করা ও প্রতিষ্ঠা করা যাতে ইবলিস পরাজিত হয়।
তাহলে আমার পরিচয় তুলে ধরতে হলে, প্রথমে আমরা মানুষ, আল্লাহ খলিফা বা প্রতিনিধি। মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য যে দীন প্রতিষ্ঠা করলে আমরা পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে। শান্তি ও নিরাপত্তা অর্থাৎ, ফ্যাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা থাকবে না। তখন ইবলিস পরাজিত হবে এবং আল্লাহ তাঁর চ্যালেঞ্জে জয়ী হবে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব আমাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি হবে কার্যত পৃথিবীর হুকুমদাতা, যেখানে বর্তমানে কার্যত ইবলিস পৃথিবীকে পরিচালিত করছে। মানুষ তার পরিচয় না জেনেই আল্লাহর হুকুমকে বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমত সামষ্টিক জীবন পরিচালনা করছে। তাই আল্লাহর হুকুমকে জীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এটাই আমাদের কাজ, মুখ্য কাজ। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ এবাদত। আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যও এটিই। কাজেই প্রতিটি মানুষের উচিত তাদের পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া ও সে অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা।