আবু হুজাইফা হাশীম (রা.) এর বাবার নাম উতবা, মা ফাতিমা বিন্তু সাফওয়ান। তিনি কোরায়েশ গোত্রের সন্তান। আবু হুজাইফা প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম ব্যক্তি। তাঁর পিতা উতবা ইসলামের চরম দুশমন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের প্রধান পুরুষ। ইসলামের বিরোধিতায় সে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা, তারই প্রিয়তম পুত্র আবু হুজাইফা ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে মোটেও বিলম্ব করেন নি। মক্কায় রসুলাল্লাহ (সা.) আরকাম ইবন আবিল আরাকামের গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণের গৌরব অর্জন করেন এবং আরো অনেকের মত কুরাইশদের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন (উসুদুল গাবা -৫/১৭০)। ইবন ইসহাক বলেন, তিনি তেতাল্লিশ (৪৩) জনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন (আল-ইসাবাÑ৪/৪২)। আবু হুজাইফা (রা.) হাবশার দু’টি হেজরতেই অংশগ্রহণ করেন। প্রথমবার হেজরত করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। পরে আবার হাবশায় চলে যান। হাবশার হেজরতে তাঁর স্ত্রী সাহলা বিনতু সুহাইলও সাথী ছিলেন। তাঁদের পুত্র মুহাম্মদ ইবন আবী-হুজাইফা সেই প্রবাসে হাবশায় জন্মগ্রহণ করেন। (উসুদুল গাবাÑ৫/১৭০)। হাবশা থেকে দ্বিতীয়বারের মত মক্কায় ফিরে এসে তিনি দেখতে পেলেন, মক্কায় অবস্থানরত মুসলমানদের মধ্যে মদীনায় হেজরতের হিড়িক পড়ে গেছে। তাঁর দাস সালেমকে সঙ্গে করে তিনিও মদীনায় পৌঁছলেন এবং আব্বাদ ইবন বিশ্র আল-আনসারীর অতিথি হলেন। রসুলে কারীম (সা.) তাঁদের দু’জনের মধ্যে ‘মুওয়াখাত’ বা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (উসুদুল গাবা৫/১৭০) রসুলাল্লাহর (সা.) সময়ে সংঘটিত সকল যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষতঃ বদর যুদ্ধের ঘটনাটি ছিল তাঁর ও সকল মুসলমানদের জন্য দারুণ শিক্ষণীয়। এ যুদ্ধে এক পক্ষে তিনি এবং অন্যপক্ষে তাঁর পিতা উত্বা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রেম সেদিন মো’মেনদেরকে আপন পর সম্পর্ক বিস্মৃত করে দিয়েছিল। সেদিন আবু হুজাইফা চিৎকার করে আপন পিতা প্রতিপক্ষের দুঃসাহসী বীর উত্বাকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহ্বান জানান। তাঁর এ আহ্বান শুনে তাঁর সহোদরা হিন্দা বিনতু উতবা একটি কবিতায় তাঁকে ভীষণ তিরষ্কার ও নিন্দা করে। উসুদুল গাবা গ্রন্থে কবিতাটির দু’টি পংক্তি সংকলিত হয়েছে।
বদর যুদ্ধে আবু হুজাইফার পিতা উত্বাসহ অধিকাংশ কুরাইশ নেতা মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয় এবং তাদের সকলের লাশ বদরের একটি কূপে নিক্ষেপ করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। রসুলে কারীম (সা.) সেই কূপের কাছে দাঁড়িয়ে নিহত কুরাইশ নেতৃবৃন্দের এক একজন করে নাম ধরে ডেকে বলতে লাগলেন, “ওহে উত্বা, ওহে শাইবা, ওহে উমাইয়া ইবনে খালাফ, ওহে আবু জাহল! তোমরা কি আল্লাহর অঙ্গীকার সত্য পেয়েছ? আমি তো আমার অঙ্গীকার সত্য পেয়েছি।’ (বুখারি) ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সে সময় আবু হুজাইফাকে খুবই উদাস ও বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। রসুলাল্লাহ (সা.) তার এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেন, “আবু হুজাইফা, সম্ভবতঃ তোমার পিতার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে।” আবু হুজাইফা বলেন, “আল্লাহর কসম, না। তাঁর নিহত হওয়ার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই। তবে আমার ধারণা ছিল, তিনি একজন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও সিদ্ধান্তদানকারী ব্যক্তি। তাই আমার আশা ছিল, তিনি ঈমান আনার সৌভাগ্য অর্জন করবেন। কিন্তু রসুল (সা.) যখন তাঁর ‘কুফর’ অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চয়তা দান করলেন, তখন আমার দুরাশার জন্য আফসুস হলো।” অতঃপর রসুলাল্লাহ (সা.) আবু হুজাইফার জন্য দু’আ করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম১/৬৩৮-৪১, উসুদুল গাবা৫/১৭১)
রসুলে কারীমের ওফাতের পর প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) খেলাফতকালে আরব উপদ্বীপে কতিপয় ভ- নবীর ফিতনা ও উৎপাত শুরু হয়। ইয়ামামার মুসাইলামা কাজ্জাবও ছিল সেইসব ভ- নবীর একজন। খলীফা তার বিরুদ্ধে এক বাহিনী পাঠান। এই বাহিনীতে আবু হুজাইফাও (রা.) ছিলেন। ভ- মুসাইলামার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে তিনি ইয়ামামার রণক্ষেত্রে শহীদ হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ অথবা ৫৪ বছর।
আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রসুলাল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধের সময় একদিন সাহাবীদের বললেন, “আমি জানতে পেরেছি, বনী হাশেম ও অন্য কতিপয় গোত্রের কিছু লোককে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। তাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। তোমাদের কেউ বনী হাশেমের কোন ব্যক্তির মুখোমুখি হলে তাকে হত্যা করবে না। কেউ আবুল বুখতার ইবন হিশামের দেখা পেলে তাকে হত্যা করবে না। আর কেউ রসুলাল্লাহর (সা.) চাচা আব্বাস ইবন আবদিল মুত্তালিবের সামনাসামনি হলে তাকেও হত্যা করবে না। কারণ, তিনি বাধ্য হয়ে এসেছেন।” সঙ্গে সঙ্গে আবু হুজাইফা বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের পিতা, পুত্র ও ভ্রাতাদের হত্যা করবো, আর আব্বাসকে ছেড়ে দেব?” আল্লাহর কসম, আমি তার সাক্ষাৎ পেলে তরবারি দিয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।’ রসুলাল্লাহ (সা.) হুজাইফার এ কথা শুনে বললেন, “ওহে আবু হাফ্স (উমার), আল্লাহর রসুলের চাচাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করা হবে?” উমার বললেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, তরবারি দিয়ে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই। আল্লাহর কসম, সে একজন মুনাফিক।” আবু হুজাইফা বলেন, “সেদিন যে কথাটি বলেছিলাম, সে জন্য আমি নিরাপদ বোধ করি না এবং শাহাদাতের মাধ্যমে তার কাফ্ফারা আদায় না করা পর্যন্ত সর্বদা আমি ভীত সন্ত্রস্ত।” ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হয়ে তিনি তাঁর কাফ্ফারা আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা২/৩৬৪-৬৫)।
(সংগ্রহে: মো: আবু ফাহাদ, ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদের ‘আসহাবে রসুলের জীবনকথা’ থেকে)