ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা। মানবজীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল হুকুম-বিধান সুস্পষ্টভাবে কোর’আনে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহ বলেছেন ‘কোরআনে রয়েছে সত্য ও সঠিক বিষয় – Wherein are laws (or decrees) right and straight (সুরা বাইয়্যেনাহ ৩)।’ এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ কোর’আনে কিছু সংযোজন বা বিয়োজনকে পুরোপুরি নাকচ করেছেন। অন্যান্য বিধানের মত পর্দা সংক্রান্ত বিধানও স্পষ্টভাবে কোর’আনে উল্লিখিত আছে। এখন কেউ যদি পর্দার নির্ধারিত সীমারেখার কম বা বেশি পর্দা করতে চায় তা হবে সীমালঙ্ঘন, আল্লাহর হুকুমকে অস্বীকার করা। কেননা আল্লাহ বলেছেন, “দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না (সুরা আন নিসা ১৭১, সুরা আল মায়েদা ৭৭)।” পর্দা সংক্রান্ত বিধানগুলো মূলত সুরা নূর ও সুরা আহযাবে বিবৃত করা হয়েছে। আর সুরা নূরের শুরুতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘এটি একটি সুরা, এটি আমি অবতীর্ণ করেছি এবং এর বিধানকে অবশ্যপালনীয় করেছি। এতে আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর (সুরা নূর ১)।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে নারীদের উপর আপাদমস্তক আবৃতকারী যে পর্দাপ্রথা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি বাংলাদেশেও এটাকে পর্দার প্রকৃত পদ্ধতি বলে ব্যাপকভাবে ওয়াজে বয়ানে প্রচার চালানো হচ্ছে আসলেই সেটা কোর’আন, হাদিস মোতাবেক কতটুকু বৈধ তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে মাথার স্কার্ফকে হেজাব বলা হয়, আবার পর্দা করাকেও হেজাব বলা হয়। হেজাব হল একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হল – আবরণ, বিভাজন, আলাদা, পর্দা। কোর’আনে হেজাব শব্দটি সাতবার উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সাত আয়াতের কোনোটিতেই আল্লাহ শব্দটি নারীদের পোশাক হিসেবে ব্যবহার করেননি। কোর’আনে কী পোশাক পরতে হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে।
(সুরা নূর- ৩১) নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে রসুল! মো’মেন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। নারীর পোশাক সংক্রান্ত একটি নীতি এই আয়াতে আমরা পাচ্ছি। আয়াতটিতে ‘খুমুরিহিন্না’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এখানে খুমুরের মাধ্যমে স্রষ্টা নারীদের বক্ষদেশ ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। কোর’আনের ইংরেজি অনুবাদে এ নির্দেশটি এভাবে অনুবাদ করা হয়েছে – Let them draw their veils over their chests . ‘খুমুরিহিন্না’ শব্দটি ‘খুমার’ শব্দ থেকে উদ্ভুত (বহুবচন খিমার) যার অর্থ শার্ট বা শাল বা ব্লাউজ বা যে কোন আবরণ। খেয়াল করুন, এই আয়াতে মুখ বা চুল নয় বরং বুক ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছে। (সুরা আহযাব- ৫৯) আয়াতে আল্লাহ বলেছেন একটি অতিরিক্ত কাপড় নারীর ‘জুয়ুব’ আবৃত রাখতে।
আল্লাহ বলেন, “হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মো’মেনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের বক্ষের উপর (জুয়ুবিহিন্না) টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।”
এখানে ব্যবহৃত ‘জুয়ুবিহিন্না’ শব্দটি ‘জায়ব’ থেকে উদ্ভূত (বহুবচন জুয়ুব) যার অর্থ হল ‘বক্ষ’। যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য হতো ঘোমটা, আঁচল বা নেকাব চাপিয়ে দেওয়া তবে প্রেরিত আয়াতে মুখমণ্ডল ও ঘোমটা শব্দগুলো সরাসরি ব্যবহার করা থেকে কোনো কিছুই তাঁকে বিরত রাখতে পারত না। বরং তিনি সেগুলোই ব্যবহার করতেন। কারণ তিনি কোর’আনের নির্দেশগুলোকে মুবিন বা সুস্পষ্ট বলে ঘোষণা দিয়েছেন বারবার।
উল্লিখিত আয়াতে মুখ (ওয়াজহু, উজাহ, কুবাল); মাথা (রাআস); বা চুল (শাআর) এর কোনো উল্লেখ নেই। তিনি আসলে যেটা বোঝাতে চান নি, অনুবাদক ও মুফাসসিররা সম্ভবত কোনো গায়েবি অহী মারফত সেটা বুঝে নিয়ে কোর’আনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন এবং আল্লাহর নামে নিজেদের কথা চালিয়ে দিয়েছেন। ভাগ্যিস আরবি কোর’আনটা অবিকৃত আছে, নইলে সঠিক জায়গায় ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগই থাকত না।
উল্লেখিত আয়াতে এটাও নির্দেশিত হয়েছে যে, নারীরা তাদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখবে না। ওই আয়াতে বলা হয়েছে নারীরা শুধুমাত্র তাদের শরীরের সাধারণ প্রকাশ্য অংশ ছাড়া অন্যান্য সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। যদি শরীরের এমন কোনো অংশ থাকে যা সর্বাধিক প্রকাশিত অংশ তবে তা হল মুখমণ্ডল। যদি কান ও চোখ সামান্যতম ঢেকে রাখা হয় তবে দেখা ও শোনার কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। মুখ আবৃত থাকলে খাওয়া ও পান করাও সম্ভব নয়। মুখমণ্ডলে পর্দার ব্যবহার নানা ধরণের জটিলতা সৃষ্টি করে। কিন্তু দয়াশীল সৃষ্টিকর্তা দীনে কোন জটিলতা রাখেননি। (সুরা আল হাজ্ব ৭৮)
(সুরা আহযাব- ৫৯) নম্বর আয়াতে রসুলকে (সা.) বলা হয়েছে তিনি যেন তার স্ত্রী ও কন্যা এবং বিশ্বাসী নারীদেরকে বলেন, তারা যেন তাদের ‘জালাবিবের’ কিয়দংশ দিয়ে নিজেদের জুয়ুব (বক্ষদেশ) ঢেকে নেয়। এখানে ব্যবহৃত ‘জালাবিব’ শব্দটি হল ‘জিলবাব’ এর বহুবচন যার অর্থ হল শার্ট, চাদর, ওড়না বা আলখেল্লা। প্রশ্ন জাগে, এই জালবিব শব্দের অর্থ কি এটা বুঝায় যে মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে হবে? পরিষ্কারভাবে না, কেননা মহাজ্ঞানী আল্লাহ এমনটা বলতে চাইলে সেই শব্দ ব্যবহার করতেন। যদি একজন নারীর মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা হয় তবে তাকে কেউ চিনতে পারবে না। শরীরের একমাত্র অংশ যা দ্বারা এক মানুষকে আরেক মানুষ আলাদাভাবে চেনা যায় তা হল তার মুখমণ্ডল। কোর’আনে এমন একটাও আয়াত নেই যেখানে নারীদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার জন্য বলা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, কোর’আনে উল্লেখিত পর্দার আয়াতগুলো দ্বারা মুখমণ্ডল ঢেকে পর্দা করা আল্লাহর বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, তবে ধুলা-বালি, রোগজীবাণু থেকে বাঁচার জন্য বা আত্মপরিচয় গোপন করার জন্য কেউ সেটা ঢাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া পর্দার হুকুমের আওতায় মুখমণ্ডল আবৃত করা পড়ে না। কোর’আনের এই আয়াতগুলোতে নারীদের জানার আবশ্যকতা রয়েছে। আল্লাহর রসুলের যুগেও নারীরা তাদের মুখ খোলা মসজিদে যেতেন, বাজারে যেতেন, সামষ্টিক সকল কাজে অংশগ্রহণ করতেন। এমনকি আজকের দিনে সৌদি আরব যেখানে মুখঢাকা কঠোর পর্দা প্রথা বিদ্যমান সেখানেও হজের সময় ইসলামের প্রকৃত বিধানের চর্চা দেখা যায়। হজের সময় কোন নারীর মুখমণ্ডল ঢাকা রাখা যায় না। নবীজী (সা.) বলেন, ‘মেয়েরা বড় হলে চেহারা ও হাত ছাড়া আর কিছু দেখানো উচিত নয় (আবু দাউদ ৪০৯২)।
বর্তমান নারীদের পর্দা এমনভাবে করতে বলা হয় এবং নারীরা করে থাকে এতে কাউকে চেনার উপায় নাই। কেউ মুখ খুলে রাখলে তাকেও বেপর্দা নারী, দাইয়ুস নারী, উলঙ্গ নারী বলে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ অনেক মাদকব্যবসী, দেহ ব্যবসায়ী, প্রতারক চক্রসহ বিভিন্ন নারীদেরকে দেখা যায় পর্দা করে এসব অপকর্ম, অপরাধ করে বেড়ায় যা তাদের জন্য সহজ হয়। মানুষের সৃষ্টি করা এই বিকৃত পর্দা এসব অপকর্ম, অপরাধগুলোকে সহজ করে দিচ্ছে।
যারা নারীদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে নির্দেশ দেয় তাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে যে, আল্লাহ বিশ্বাসী পুরুষদের দৃষ্টি সংযত ও নত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা নূর- ৩০)। যদি নারীর শরীর আপাদমস্তক আবৃতই থাকে তাহলে দৃষ্টি অবনত ও সংযত রাখার কোন প্রয়োজন হত না। এর অর্থ নারীর দিকে মোমেন পুরুষ লালসার লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবে না। এই নির্দেশকে লজ্জাজনক ভাবে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের মুফতি সাহেবরা নারীকেই প্যাকেটবন্দী করার নির্যাতনমূলক ও অপ্রাকৃতিক বিধান রচনা করে তা আল্লাহর বিধান বলে চালিয়ে যাচ্ছেন।