মোহাম্মদ আসাদ আলী:
পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’ কর্তৃক রূপায়িত নতুন যে বিশ্বব্যবস্থা কার্যকর কোরতে পশ্চিমারা এতদিন বদ্ধপরিকর ছিলো ইতোমধ্যেই সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে তারা পৌঁছে গেছে। সেটা হোচ্ছে পৃথিবীব্যাপী একমাত্রিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কোরে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখা। তাদের পূর্বকল্পিত বিশ্বব্যবস্থাই পৃথিবী গ্রহণ কোরেছে এবং নেতা হিসেবে গ্রহণ কোরেছে ঐ আধিপত্যবাদীদের। তারা যে উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে যেভাবে কর্মসম্পাদন কোরেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যেই ফলাফল আশা কোরেছে ঠিক তা-ই হোয়েছে এবং হোচ্ছে, এর কোথাও কোন বিচ্যুতি হয় নি। আর তাদের এই কর্মসম্পাদনা থেকে বার বার যেটা প্রমাণিত হোয়েছে যে- মানবাধিকার, স্বাধীনতা, মানবতা ইত্যাদি তাদের মুখের বুলি হোলেও কার্যক্ষেত্রে সেগুলোকে তারা ‘ছেলে ভুলানো গান’ মনে করে, তাদের কাছে এগুলো বিশ্ববাসীর চোখে ধূলি দিয়ে স্বার্থোদ্ধারের একটি পন্থা বৈ কিছু নয়। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার মোড়ল, অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার আশীর্বাদপুষ্ট দোসর রাষ্ট্রগুলিকে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য বরাবরই গণতন্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার কোরতে দেখা গেছে। বলা যায় এই গণতন্ত্রই তাদেরকে বর্তমান অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
শতাব্দীর পর শতাব্দী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ত্র“টি-বিচ্যুতির পর ইউরোপ ও আমেরিকায় বর্তমানে গণতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার পদ্ধতি। গণতন্ত্র আজ তাদের মূলধনে পরিণত হোয়েছে এবং তাদের সংস্কৃতি-সভ্যতার অনুকূলে গড়ে ওঠা সেই শাসনব্যবস্থাকেই তারা সমস্ত পৃথিবীর জাতিগোষ্ঠিগুলোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এভাবেই পৃথিবীজুড়ে যে গতিতে এই শাসনব্যবস্থার বিস্তার ঘটানো হোয়েছে তার সমান্তরালে পাশ্চাত্যের ভারসাম্যহীন সংস্কৃতি ও সভ্যতারও বিস্তার ঘটেছে, বিশ্ব হোয়ে উঠেছে আপাদমস্তক পশ্চিমানির্ভর। এতে কোরে খুব সহজেই নিজেদের স্বার্থকে আদায় করে নিতে পারছে মোড়ল রাষ্ট্রগুলি।
পশ্চিমাদের এই সুদূরপ্রসারী চক্রান্তের ফলে পৃথিবীতে এখন গণতন্ত্রের জয়-জয়কার। পশ্চিমা ভাবাদর্শে পরিচালিত দেশীয় মিডিয়া এবং শিক্ষাব্যবস্থার ফলে মানুষ অন্ধভাবে বিশ্বাস কোরছে যে গণতন্ত্রই একমাত্র গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা। এর বিকল্প হিসেবে অন্য কোন শাসনব্যবস্থার কথা পৃথিবীবাসী কল্পনাও কোরতে পারছে না, আর কল্পনা কোরলেও কোন লাভ হবে না। কারণ গণতন্ত্রের মধ্যেই পশ্চিমাদের স্বার্থ, গণতন্ত্রই তাদের শাসন-শোষণের হাতিয়ার। এটা ছাড়া অন্য কোন শাসনব্যবস্থাকে পশ্চিম মেনে নিতে দিবে না। যুক্তি আসতে পারে – অনেক দেশেই তো এখনো গণতন্ত্র চালু নেই, সে দেশের মানুষ অন্য শাসনব্যবস্থাকে এখনো ধরে নিয়ে আছে। তাহোলে সে সব দেশে কেন পশ্চিমারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কোরতে চেষ্টা কোরছে না? এর উত্তরে প্রথমেই বোলতে চাই – সে সব দেশে যে পশ্চিমা সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটে নি তা কিন্তু নয়। এটা বুঝতে হবে যে- আপাত দৃষ্টিতে পশ্চিমাদেরকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বোলতে দেখা গেলেও বাস্তবে তাদের কাছে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা বা মানবাধিকারের কোন মূল্য নেই, এগুলো মূলত তাদের স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার। কাজেই যেখানে তাদের স্বার্থ পরিপন্থী কোন কাজ হয় না এবং হবার কোন সম্ভাবনাও নেই, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না থাকলেও সে দেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পরোক্ষভাবে তাদের হাতেই রোয়েছে সেখানে তারা কেন ঐ গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা কোরবে?
মধ্যপ্রাচ্যের যে আরব দেশগুলোতে এখনও রাজতন্ত্র চালু আছে সেখানকার অধিবাসীরা যে গণতন্ত্র চায় না তা কিন্তু নয়। বহির্বিশ্বের মতো তাদেরকেও দেখা গেছে গণতন্ত্রের পক্ষে শ্লোগান তুলতে, রাজপথে নামতে। কিন্তু সে চেষ্টা কোন কাজে আসেনি, পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের কাছ থেকে কোন সাহায্য-সহায়তা আসেনি। কারণ ঐ দেশগুলোতে গণতন্ত্র চালু করার সাথে পশ্চিমা স্বার্থের কোন সম্পর্ক নেই। যদি থাকতো তবে বছরখানেকও বোধহয় লাগতো না তিউনিসিয়া, মিশর, লিবিয়ার মতো সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ইত্যাদি দেশগুলোতে গণতন্ত্র কায়েম হোতে। এখানেই বোঝা যায় – পশ্চিমাদের কাছে গণতন্ত্র আসলে কোন বিষয় নয়, আসল বিষয় হোল তাদের স্বার্থ। এই স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য তারা বহু পূর্ব থেকে চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। পৃথিবীব্যাপী অন্যায়-অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত নির্মূলের অভিপ্রায়ে ১৯৪৫ সালে যে জাতিসঙ্ঘকে জন্ম দেয়া হয় সেটাও ছিলো তাদের ঐ পরিকল্পনারই অংশবিশেষ।
পাশ্চাত্যের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদের নিরাপত্তার ছাতা হিসেবে জাতিসঙ্ঘের ব্যবহার নতুন বিশ্বব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ কোরছে। জাতিসঙ্ঘ ১৯৩টি দেশের সঙ্ঘ হোলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়ার মতো হাতে গোনা কয়েকটি দেশ তা নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসঙ্ঘের সকল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মূলত এই সব দেশের বিশেষ কোরে আজকের একক সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে যা কোনভাবেই তাদের মুখের সর্বাধিক উচ্চারিত বুলি গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ব্যাপারে জাতিসংঘের স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমর্থকদের যে আহ্বান ছিােলা বর্তমান অবস্থায় তা থেকে জাতিসঙ্ঘ অনেক দূরে অবস্থান কোরছে। এর কার্যক্রম এখন ধনী ও শক্তিশালী দেশগুলোর জাতীয় পররাষ্ট্রনীতির নকশা অনুসরণ কোরে চলে। জাতিসঙ্ঘ ব্যবস্থার মোট খরচের সিংহভাগও তারাই বহন করে। কারণ গণতন্ত্রের মতো এটাও তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একটি বড় হাতিয়ার। যেখানে নিরাপত্তা পরিষদের সকল দেশ কোন একটি সিদ্ধান্তে একমত হবার পরে শুধুমাত্র একটি দেশ ভেটো দিলেই সেই সিদ্ধান্ত নাকচ হোয়ে যায় সেখানে “সংখ্যাগরিষ্ঠের মতোই চূড়ান্ত” – এই তত্ত্বের গণতন্ত্র কোথায় থাকে? আবার দেখা যায় কোন দেশ আক্রমণ কোরতে চাইলে অন্য সব দেশ বিরোধিতা কোরলেও যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনের মতো কতিপয় দেশ কাউকে পাত্তা না দিয়ে আক্রমণ কোরে বসে, সেখানেও গণতন্ত্র কোন কাজে আসে না, গণতন্ত্রের ভাষ্য আর কৃতকর্মের মধ্যে কোন মিল পাওয়া যায় না। এর উত্তর একটিই – গণতন্ত্র পশ্চিমা আগ্রাসীদের কাছে কোন বিষয় নয়, আসল বিষয় হোল তাদের স্বার্থ। তারা গণতন্ত্র মানবে ততোক্ষণ, যতোক্ষণ সেটা তাদের স্বার্থের অনুকূলে থাকবে।
কাজেই এটা স্পষ্ট যে- আজ পৃথিবীবাসী পশ্চিমের তাবেদারি কোরেই হোক আর তাদের গালভরা বুলিতে বিশ্বাস কোরেই হোক গণতন্ত্র নামক যে সিস্টেমটিকে তাদের চলার পাথেয় হিসেবে গণ্য কোরছে এবং সেটাকে বিকল্পহীন হিসেবে বিবেচনা কোরছে সেটা পশ্চিমাদের নিছক একটি পৃথিবীব্যাপী নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার ছাড়া কিছুই নয়। এই গণতন্ত্র আজ পর্যন্ত ঐ গুটিকতক আধিপত্যবাদীদের ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ছাড়া আর কোন জাতিকে শান্তি-সমৃদ্ধি এনে দিতে পারে নি, পারার কোন সম্ভাবনাও নেই।