-কাজী নজরুল ইসলাম
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা,-আসবি কখন সর্বনাশী?
দেব-সেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,
রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে’?
বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয়-বছরী ফন্দী-কারায়,
চক্র তাহার চরকা বুঝি ভণ্ড-হাতে শক্তি হারায়!
মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে,
অরবিন্দ চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে সে জানে!
সদ্য অসুর-গ্রাসচ্যুত ব্রহ্মা-চিত্তরঞ্জনে, হায়!
কমগুলুর শান্তি-বারি সিঞ্চি যেন চাঁদ নদীয়ায়।
শান্তি শুনে তিক্ত এ-মন কাঁদছে আরো ক্ষিপ্ত রবে,
মরার দেশের মড়া-শান্তি, সে ত আছেই, কাজ কি তবে?
শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায় কেউ জানি না।
মা গো তোর ঐ দনুজ-দলন সংহারিণী মূর্তি বিনা!
দে তারা আজ জ্যোতিহারা, ধ্র“ব তাঁদের যায় না জানা,
কেউ বা দৈব-অন্ধ মা গো, কেউ বা ভয়ে দিনে কানা।
সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন দানব-রাজার অত্যাচারে,
দম্ভ তাঁহার দম্ভোলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে।
রবির শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগন্তরে,
সে কর শুধু পশলো না মা অন্ধ কারার বন্ধ ঘরে।
গগন-পথে রবি-রথের সাত সারথি হাঁকায় ঘোড়া,
মর্ত্যে দানব মানব-পিঠে সওয়ার হয়ে মারছে কোঁড়া।
বারি-ইন্দ্র বরুণ আজি করুণ সুরে বংশী বাজায়,
বুড়িগঙ্গার পুলিন বুকে বাঁধছে ঘাটি দস্যু-রাজায়।
পুরুষগুলোর ঝুঁটি ধরে বুরুশ করায় দানব-জুতো,
মুখে ভজে আল্লা হরি, পূজে কিন্তু ডাণ্ডা-গুঁতো।
দাড়ি নাড়ে, ফতোয়া ঝাড়ে, মসজিদে যায় নামাজ পড়ে,
নাই ক’ খেয়াল গোলামগুলোর হারাম এ-সব বন্দী-গড়ে।
‘লানত’ গলায় গোলাম ওরা সালাম করে জুলূমবাজে,
ধর্ম-ধক্ষজা উড়ায় দাড়ি, ‘গলিজ’ মুখে কোরান ভাঁজে।
তাজ-হারা যার নাঙ্গা শিরে গরমাগরম পড়ছে জুতি,
ধর্ম-কথা বলছে তারাই, পড়ছে তারাই কেতাব-পুঁথি।
উৎপীড়কে প্রণাম করে শেষে ভগবানে নমি,
হিজ্রে ভীরুর ধর্ম-কথার ভণ্ডামিতে আসছে বমি।
টিকটিকির ঐ লেজুড় সম দিগি¦দিকে উড়ছে টিকি,
দেব্তার আগে পূজে দানব, তাদের কাছে সত্য শিখি!
পুরুষ ছেলে দেশের নামে চুগ্লি খেয়ে ভরায় উদর,
টিকটিকি হয়, বিষ্ঠা কি নাই-ছি ছি এদের খাদ্য ক্ষুধোর!
আজ দানবের রংমহলে তেত্রিশ কোটি খোজা গোলাম
লাথি খায় আর চ্যাঁচায় শুধু, ‘দোহাই হুজুর, মলাম মলাম!’
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা-বোল নাকি-নাকি,
খাঁড়ায় কেটে র্ক মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি!
হান্ তরবার, আন্ মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় র্ক মা পুরুষ, রক্ত দে মা, রক্ত দেখা!
লক্ষ্মী-সরস্বতীকে তোর আয় না রেখে কমল-বনে,
বুদ্ধি বুড়ো সিদ্ধিদাতা গণেশ-টনেশ চাই না রণে।
ঘোমটা-পরা কলা বৌ-এর গলা ধরে দাও ক’রে দূর,
ঐ বুঝি দেব-সেনাপতি, ময়ূর-চড়া জামাই ঠাকুর?
দূর ক’রে দে, দূর ক’রে দে, এ সব বালাই সর্নাশী,
চাই না ক’ ঐ ভাং-খাওয়া শিব, নেক দিয়া তাঁয় গঙ্গামাসী!
তূই একা আয় পাগ্লী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য ক’রে,
রক্ত-তৃষায় ‘ময় ভখা হুঁর কাঁদন-কেতন কণ্ঠে ধরে’।
‘ময় ভুখা হুঁ’র ক্ষেপী ছিন্নমস্তা আয় মা কালী,
গুরুর বাগে শিব সেনা তোর হুঙ্কারে ঐ ‘জয় আকালী!’