রিয়াদুল হাসান
একটি সমাজ, দেশ বা জাতিকে ধ্বংসের মুখে পতিত করে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ কিন্তু এক বিষয় নয়। সন্ত্রাস হলো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত আক্রোশ, অর্থিক বা অন্য কোনো পার্থিব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের কারণে বিচ্ছিন্ন হত্যা, সহিংসতা, ভিতি প্রদর্শন, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ইত্যাদি ঘটানো। আর সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনীতিক বা বিকৃত ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ একটি জনগোষ্ঠীর একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সন্ত্রাসের পথ বেছে নেওয়া। রাজনীতিক মতাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিক স্বার্থে যে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটানো হয় তাকে রাজনীতিক সন্ত্রাসবাদ বলে। আর বিকৃত ধর্মীয় আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নেওয়া হলে তাকে জঙ্গিবাদ বলা হয়। বিকৃত ধর্মবিশ্বাস যে বৃহৎ সমস্যাগুলি সৃষ্টি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো জঙ্গিবাদ। বর্তমান পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি বিরাট সঙ্কট। আমাদের দেশও এই সঙ্কটে আক্রান্ত।
সাম্রাজ্যবাদের পাতানো ফাঁদ: জঙ্গিবাদ
পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে বর্তমানের জঙ্গিবাদ ইস্যুটির জন্ম দিয়েছে। তারপর তা বিশ্বময় রপ্তানি করে নিজেরাই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধের স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো পররাজ্য দখল করা, পরসম্পদ লুট করা, আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো কম্যুনিজমের পতনের পর ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আদর্শ ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এটা এখন পশ্চিমা আগ্রাসনকারীদের আত্মস্বীকৃত বিষয়। অনেকেই স্বীকার করেছেন, অনেকে এ নিয়ে দম্ভোক্তিও করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন বলেন, “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ [১ জুন ২০১৪, ফক্স নিউজ, সি.এন.এন]।
অন্যদিকে পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল পারভেজ মোশারফকে বলতে শোনা গেছে- তালেবান আমেরিকার সৃষ্টি, (ডন, ০৫.১২.১৪)। আর বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া আইএস- এর জন্মের প্রেক্ষাপট যারা জানেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না যে, কীভাবে পশ্চিমা জোট আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুৎ করার প্রচেষ্টায় আইএসকেই একদা সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে শক্তিশালী করেছে। অবশ্য জঙ্গিরাও অকৃতজ্ঞ নয়; তালেবান, আল কায়েদা বা আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে পৃথিবীব্যাপী শোষণ অব্যাহত রাখতে যতখানি সুযোগ করে দিয়েছে তা অতীতে কেউ পেরেছে বলে মনে হয় না।
আমরা সবাই জানি, আশির দশকে সংঘটিত রুশ-আফগান যুদ্ধটিই হচ্ছে চলমান জঙ্গিবাদের জন্মের প্রেক্ষাপট। এ সময়টিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই. আফগানদেরকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্য। কিন্তু তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাথের্র যুদ্ধ? বুঝতে পারেননি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পশ্চিমারা মুসলমান দেশগুলোতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করছিল, যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে ওয়াজ-নসিহত করে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত, অনুপ্রাণিত (গড়ঃরাধঃবফ) করে সংগঠিত করেছিল। তারা বলত যে এটা সাধারণ যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ। এখানে মরলে শহীদ বাঁচলে গাজি। এভাবে নিজেরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যারা জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করল, সেই পশ্চিমারাই আজ জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চেচিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন।
এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ যে আসলে পশ্চিমাদের রাজনীতির খেলা, অর্থাৎ Political game সেটাও প্রমাণিত। এতে তাদের লাভ হচ্ছে, তারা অস্ত্রব্যবসা করে নিজেদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি (War economy)। তাদের প্রয়োজন বিশ্বজোড়া অস্ত্রের বাজার। কিন্তু তারা আর স্বশরীরে যুদ্ধ করতে আগ্রহী নয়। তাই তারা জঙ্গি সৃষ্টি করে মুসলমানদেরই একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং জঙ্গিরা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অতি প্রয়োজনীয় শত্রু (Useful enemy)। তারা যেমন জঙ্গিদেরকে জিইয়ে রাখতে চায় চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত তেমনি, অনেক দেশের সরকারও জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা চায় না।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য: জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ
এসএসএফ- এর ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ‘বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কৌশল পরিবর্তন হচ্ছে দিন দিন। নানা ধরনের সংঘাত বাড়ছে। বাংলাদেশকে আমরা এই সংঘাত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। বিষয়টি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’ পরের সপ্তাহেই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির যুগ্মকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রকারান্তরে সমর্থন করেই বললেন, গত দুই বছরে ইরাক, সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জঙ্গি তৎপরতার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনদের নানা কার্যক্রমে এ দেশেও জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি তিনি বলেছেন তা হলো, জঙ্গিবাদ এ দেশ থেকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর) অভিযানের কারণে তা নিয়ন্ত্রণে আছে। (প্রথম আলো অনলাইন, ২৮.০৭.২০১৫)।
বর্তমানের বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানের স্বার্থে উপরোক্ত মন্তব্যগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়- আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পর্কিত এবং বিষয়টি বাংলাদেশের মৌলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন তার মোকাবেলা তিনি কীভাবে করবেন তার অস্বচ্ছতা যেমন ভাবনার বিষয়, তেমনই আশঙ্কার বিষয় গোয়েন্দা কর্মকর্তার মন্তব্যটি যেখানে তিনি খুব সহজ-সরল ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ (Control) করা গেলেও নির্মূল (uprooted) করা সম্ভব নয়। সুতরাং, বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে জঙ্গিবাদ কতবড় চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে তা সহজেই অনুমেয়।
[লেখক: সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ, ফেসবুক: riyad.hassan.ht]