নাজমুল আলম বাপ্পা:
দুইশত বছর আমরা ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। তারা চলে যাবার পর আমরা এমন একটি রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা অনুসরণ করছি যে ব্যবস্থায় আমাদের মধ্যে হাজারো বিভক্তি, রাজনীতিক বিরোধ, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি, দাঙ্গা ফাসাদ ইত্যাদি লেগেই আছে। এই ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম, ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি না করে গোলামি মনোবৃত্তি তৈরি করে। এইভাবে প্রতিনিয়ত হাজারো সমস্যায় জর্জরিত হতে হতে আমরা এক প্রকার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে গেছি। আমরা গুমরে কাঁদি কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে ভয় পাই। আমাদের চারিত্রিক এমনই অধঃপতন হয়েছে যে, আমরা চোখের সামনে অপরাধ হতে দেখলেও বাধা দেই না, ভাবি, ‘এগুলো দেখার দায়িত্ব তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আমি কেন খামাখা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে যাবো।’ আজকে আমাদের সমাজে যে হানাহানি, অশান্তি হয় তা এই আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার ফল। একারণেই আমাদের চোখের সামনে আপনজনেরা পুড়ে ছাই হয়, আমরা দেখি কিন্তু ভবিষ্যতে আর যেন কাউকে এমন করুণ পরিণতির সম্মুখিন হতে না হয় সেজন্য কোনো উদ্দোগ নিই না। কেন? ষোল কোটি মানুষ কি এই সমস্যার সমাধান করতে অক্ষম? এখনও যদি আমরা না জাগি তবে আমাদের এই ঘুম কালঘুম হয়ে দাঁড়াবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে প্রতিটি মানুষকে, দেশের প্রতিটি রাস্তাঘাট, প্রতি ইঞ্চি জমি পাহারা দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু সমাজের মানুষগলি যদি দেশের ও জাতির নিরাপত্তা দেওয়াকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করে তবে সহজেই এটা সম্ভব। এজন্য আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমানে আমরা যে সমস্যায় পড়েছি, যে সংকটে পড়েছি তা আমাদের জাতীয় সংকট। এখন অন্তত দু’টি কারণে আমাদেরকে অবশ্যই সকল স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ছুড়ে ফেলে সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
(এক) এটা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব: আমাদের এই দেশের প্রায় ৯০% মানুষ আল্লাহ ও রসুলকে বিশ্বাস করি, পরকালে বিশ্বাস করি, জান্নাতে বিশ্বাস করি। আমরা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে চাই, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমার দায়িত্ব সমস্ত রকম সন্ত্রাস, সহিংসতা, জঙ্গিবাদ, অন্যায়, অশান্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মানুষের শান্তিময় নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করা। ধর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা নামায, রোযা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ম কী? মানুষ হিসাবে আমাদের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা, মনুষ্যত্ব, দয়া। ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি, অর্থাৎ মানুষের শান্তির লক্ষ্যে কাজ করাই ইসলামের মূল কাজ, এটাই এবাদত। এই কাজই করে গেছেন আল্লাহর সকল নবী রসুল ও মো’মেনগণ। এই এবাদত না করলে হাশরের দিন আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। সেদিন আল্লাহ আমাদেরকে বলবেন যে, তোমার চোখের সামনে আমার সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষ জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল তুমি কী করেছিলে? কাপুরুষের মতো ঘরে লুকিয়েছিলে, রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়েছিলে, রোজা রেখেছিলে, আকাশের দিকে হাত তুলে শুধু দোয়া করেছিলে, হজ্ব করেছিলে? আমি কি বলি নি যে, মানুষকে ভালো কাজে আদেশ করা আর খারাপ কাজ থেকে ফেরানোই তোমার মূল কাজ? যাও, তোমার এ নামায-রোযাসহ আমি তোমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলাম। কাজেই এখন আমাদের প্রত্যেকের এবাদত, ধর্মীয় কর্তব্য, ঈমানী দায়িত্ব হলো এই অশান্তি থেকে মানুষকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করা।
(দুই) সামাজিক কর্তব্য: অনেকে আছেন যারা ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্বাসগতভাবে প্রস্তুত নয়। তাদের প্রতি আমাদের কথা হলো, মানুষের নিরাপত্তাবিধানের জন্য এগিয়ে আসা আমাদের সকলের সামাজিক কর্তব্য। আমরা এই সমাজে বাস করি, এই সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত হাজারো সুবিধা ভোগ করি। তাই এই সমাজের প্রতি, এ জাতি ও রাষ্ট্রের প্রতি আমরা আজন্ম ঋণে দায়বদ্ধ। আমরা এদেশের আলো বাতাসে, এই পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অববাহিকায় বেড়ে উঠেছি। এদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত হয়েছি, দেশ ও সমাজের সেই ঋণ পরিশোধের সময় এসেছে। আজকে সমাজ যখন আক্রান্ত তখন তা থেকে সমাজের মানুষকে রক্ষা করা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব্। এই দায়িত্বকে যদি আমরা হেলাফেলা করি, তাহলে সেটা আত্মঘাতী ভুল হবে। ১৯৭১ সালে জাতি বহিঃশত্র“র দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, আমরা একতাবদ্ধ হয়ে দেশকে রক্ষা করেছিলাম। আজ জাতি অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত। কার্যত ঘটনা একই। কারণে-অকারণে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিবেশ, নিরপরাধ সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয় পথে-ঘাটে, সবার নিরাপত্তা হয় বিপন্ন, জনসাধারণের জীবন-জীবিকা ধ্বংসের মুখে পড়ে। ভবিষ্যতে আমি বা আমার সন্তান যে আক্রান্ত হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। অনেক নিষ্পাপ শিশু সহিংসতার বলি হয়েছে। কাজেই ধর্মীয় বা সামাজিক যে দৃষ্টিতেই দেখুন না কেন, আমি যদি নিজেকে মানুষ দাবি করি বা এ জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করি তাহলে আমি বসে থাকতে পারি না, আমাকে এগিয়ে আসতেই হবে। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক মানুষের কোনো এবাদতই কবুল হয় না, স্বার্থপর লোকের সমাজে বসবাস করার অধিকার নেই। যে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সে তো পশু, মানবসমাজে তার বসবাসের যোগ্যতা নেই।