ডা. সুসানে গীতি সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের একজন অফিসার। ১৯৮৬ সনে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম নারী হিসাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল পদমর্যাদায় উন্নীত হন। এই সফলতার জন্য তিনি আল্লাহ তা’আলার প্রতি এবং দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন। তার স্বামী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুল্লাহ মো. হোসেন সাদ (অব.) একজন সফল সামরিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন।
যা-ই হোক, তিনি বাংলাদেশের একজন নারী এটাই হচ্ছে বড় কথা। এই দেশে ধর্মের নামে নারীর চলার পথে হাজার পাথর বিছানো হয়, সংস্কার ও পরম্পরার নামে নারীদেরকে পুরুষদের তুলনায় সর্ববিষয়ে তুচ্ছ করে দেখা হয়। তাদের মানুষ পরিচয়ের পূর্বে নারীত্বকেই বড় করে সামনে নিয়ে আসা হয়। এভাবে আমাদের নারীরা জাতিগতভাবেই পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। যারা এগিয়ে যায় তাদের দিকে রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে থাকে প্রাচীনপন্থী পুরোহিত সমাজ। কিন্তু আমরা জানি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সেনা কমকর্তাকে কী পরিমাণ কষ্টসহিষ্ণুতার পরীক্ষা প্রতিনিয়ত দিতে হয়। এখানে মেধার পাশাপাশি তার মানসিকতা, নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি, কমিউনিকেশন স্কিল, ইংরেজিতে দক্ষতা, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি নানা বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। সেনাবাহিনীর বেসিক কোর্স, অস্ত্রের কোর্স, কমান্ডো ট্রেনিং কোর্স প্রত্যেক সেনা অফিসারকে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ করতে হয়। কমান্ডো ট্রেনিং কোর্সে প্রতিটি অফিসারকে আমানুষিক কষ্টের মধ্যে রাখা হয়। এই কোর্সে প্রায় প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ৬ কিমি থেকে ৪০ কিমি পর্যন্ত দৌড়, অ্যাসল্ট কোর্স (বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম), টানা দৌড়ে উঁচু উঁচু ৭ টি পাহাড় অতিক্রম, আনআর্মড কম্ব্যাট ট্রেনিং (মার্শাল আর্টের সামরিক সংস্করণ), ট্র্যাকিং, ম্যাপ অনুসরণ করে দুর্গম এলাকায় ডে মার্চ বা নাইট মার্চ, কমান্ডো কৌশল অনুসরন করে শত্রু এলাকার ভেতরে প্রবেশ করে বিভিন্ন অভিযান পরিচালনার অনুশীলন, খাবার ছাড়া দুর্গম এলাকায় বেঁচে থাকার সারভাইভাল ট্রেনিংসহ অনেক দুঃসাহসিক প্রশিক্ষণ নেয়ার পাশাপাশি রণকৌশলের ওপর পড়াশোনা করতে হয় এ সময়। আমি শুধু একটা ট্রেনিং এর কথা বললাম, এমন বহু ট্রেনিং করেই একজন অফিসারকে সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেতে হয়। মেডিক্যাল কোরের সেনা অফিসারদেরকেও বেসিক ট্রেনিংগুলো নিতে হয় যেন তারা সকল যুদ্ধসংকুল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিজেদের বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করে যেতে পারে। তাই তাকেও বহু কঠোর প্রশিক্ষণের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নারী হিসাবে কোনোপ্রকার কোনো অনুকম্পা, করুণা বা ছাড় তিনি পান নি। পুরুষ সৈনিকদের মতোই মানসিক, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা তাকে অর্জন করতে হয়েছে, সামর্থ্যরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে।
প্রসঙ্গটি কেন আনলাম? আমি নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়ে সভা-সমাবেশ করি, জাতির কল্যাণে একত্রে সংগ্রাম করি বলে আমার বিরুদ্ধে এক শ্রেণির আলেম ওলামা ক্ষিপ্ত। তাদের কথা হচ্ছে, আমরা ইসলাম নিয়ে কাজ করি। তাহলে নারীদেরকে কেন এভাবে ঘর থেকে বের করে আনছি? এতে নাকি পর্দার লংঘন হয়। আমার কথা হচ্ছে, নারীদেরও যোগ্যতা রয়েছে, সাহস রয়েছে, মেধা রয়েছে, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করার হিম্মত ও সামর্থ্য রয়েছে জাতির জন্য কিছু করার। এই সামর্থ্য তাদেরকে স্রষ্টাই দিয়েছেন যা উপযুক্ত পরিবেশে ও চর্চায় বিকশিত করা সম্ভব।
এ কথা যে সত্য তা প্রমাণ করলেন সুসানে গীতি। তাকে সেল্যুট না জানিয়ে পারছি না আমি। অর্থাৎ নারীরাও পারে। আমাদের দেশের মতো একটি দেশে যেখানে ধর্মান্ধতার চর্চা হয় সবচেয়ে বেশি সেখানে তিনি প্রমাণ দিলেন যে নারীদেরকে যে কোনো অজুহাতে পিছিয়ে রাখা জাতির জন্য অকল্যাণকর। রসুলাল্লাহ তাঁর জাতির নারীদেরকে কী দুর্দান্তভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সে ইতিহাসকে প্রাণপণে অস্বীকার করেন এই এক শ্রেণির আলেমসমাজ। তারা মাসলা-মাসায়েল আর ফতোয়ার জাল বিস্তার করে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর নারীদের ইতিহাসকে আড়াল করে মুসলিম নারীদেরকে বাক্সবন্দী, গৃহবন্দী করার জন্য শত শত বছর ধরে ওয়াজ করে যাচ্ছেন। তাদের কারণে এ জাতির নারীরা আজ আত্মবিশ্বাসহীন, হীনম্মন্যতায় আপ্লুত, নিষ্প্রভ, ভীরু, অবলা। তাদের সেই জাতিবিনাশী ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে আমি আমার প্রত্যেকটি জনসভায় কথা বলছি। এ জন্য আমাদেরকে কতই না গালাগালি, নির্যাতন, নিপীড়ন, অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে। আমি আশা করব, সুসানী গীতির এই সাফল্য দেখে অন্যান্য নারীরা ঈর্ষান্বিত না হয়ে অনুপ্রাণিত হবেন, সাহস পাবেন, মানুষ হিসাবে নিজেদেরকে সম্মান করতে শিখবেন।