রাকীব আল হাসান:
যারা নিজেদেরকে মুসলিম উম্মাহর সদস্য বলে মনে করেন তাদের প্রত্যেকেরই উচিত এই জাতির সমস্যা ও সমাধান নিয়ে কম বেশি চিন্তা করা। বিশেষ করে যখন এই উম্মাহ অতিক্রম করছে এক ঘোর অন্ধকারময় ক্রান্তিকাল। একটি জীবন্ত জাতি হিসেবে মুসলিম উম্মাহর নেতা যখন জাতিটিকে আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তৈরি করে যান তখনই তিনি জাতির উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা জানিয়ে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে জাতির দৃষ্টি যখন অন্ধ হয় তখন সবদিক থেকেই অন্ধ হয়ে যায়। কোনদিকের পথই সে তখন দেখতে পায় না। এটা লানতের একটা চিহ্ন। লানতের আরো একটি চিহ্ন এই যে ‘যেখানে সমাধান নেই সেখানেই সমাধান খোঁজা’। তাই দেখি আল্লাহ মো’মেনদেরকে যেসব ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছেন মো’মেন দাবিদার এই জাতি পাশ্চাত্যদের দুয়ারে গিয়ে ঢু মারছে সেগুলো সমাধানের আশায়। আল্লাহ যাদের সাথে বন্ধুত্ব পরিত্যাগ করার আদেশ দিয়েছেন, তারা তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করায় ব্যস্ত। শুধু ব্যস্তই নয়, বরং কে কার চাইতে বেশি নিজেকে বন্ধুত্বে উজাড় করে দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা করছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যেখানে তোমার জিনিস হারিয়ে গেছে সেখানেই তাকে খুঁজতে হবে। অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দৃষ্টিভ্রম হলেই কেবল তা সম্ভব।
এই জাতির স্রষ্টা আল্লাহ এবং তাঁর রসুল জাতির জাতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্ত উপকরণ তৈরি করে রেখেছেন। যেমন যদি দুইজন মো’মেনের মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দেয় বা মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয় তাহলে একই দিনে অন্ততঃ পাঁচবার সময় রয়েছে মসজিদে মিলিত হয়ে সমাধান করে নেওয়ার। কেউ যদি কোন কারণে একদিন জামায়াত ধরতে ব্যর্থ হয় তার জন্য তিন দিন সময় রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে হাজির হয়ে মিটমাট করে নেওয়ার। আর কারো অবস্থান যদি মসজিদ থেকে দূরবর্তী স্থানে হয় তাহলে সে সপ্তাহের একদিন অর্থাৎ শুক্রবার জুম’আর সালাতে হাজির হয়ে পারস্পরিক সমস্যা মিটমাট করে নেবে। এই ক্রম ধারার আন্তর্জাতিক রূপ হচ্ছে প্রতি বছর ক্বাবার প্রাঙ্গণে, বায়তুল্লায় হজ্বের জন্য হাজির হওয়া। এদিন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত মুসলিম নেতৃবৃন্দ হাজির হয়ে নিজেদের পারস্পরিক সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করে সমাধান করে নেবেন। এমন কি মুসলিম উম্মাহর কোথায় কোন সমস্যা, কোথায় কার কোন অভাব তা পূরণ করতে হবে ক্বাবার প্রাঙ্গণে হাজির হয়ে। অন্যদিকে উম্মাহর সামরিক ও ক‚টনৈতিক সিদ্ধান্তও এখান থেকেই নেওয়া হবে। তাই হজ্বের এই নির্ধারিত দিনগুলোতে এই জাতির স্রষ্টা অমোসলেমদের প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছেন। দীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর পরেও সে আদেশ বলবৎ আছে। সারা আরবে অন্যজাতিরা প্রবেশ করলেও এমন কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে সক্ষম হলেও মক্কায় প্রবেশ করতে পারে নি। কিন্তু এ জাতি আজ জানে না কেন এখানে অন্য জাতির প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতি যদি একটিবার একটি মাত্র হজ্ব করতে সক্ষম হতো তাহলে এ জাতির কোন সমস্যা থাকতো বলে অন্তত আমি মনে করি না। কারণ এ এক অব্যর্থ ঔষধ। এটা আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের দেওয়া ঔষধ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে এই জাতি এই ঔষধ গিলতে নারাজ। তারা বিদেশি মোশরেক প্রভুদের প্রেসক্রাইব করা ঔষধ গিলবে। প্রকৃতপক্ষে তাই যদি হয়, তাহলে কেন তারা পবিত্র ক্বাবার প্রাঙ্গণে যান? যে উদ্দেশ্যে যা তৈরি করা হয়েছে তাকে দিয়ে যদি তা না হয়, তাহলে ঐ জিনিসের কী দাম থাকতে পারে? হজ্বের মাঠে মিলিত হয়ে যদি জাতি তার ঐক্যই ফিরে না পায়, শিয়া-সুন্নির ব্যবধান বজায় রেখে যার যার মত আনুষ্ঠানিকতা করার মধ্য দিয়েই হজ্ব পালন করেন তাহলে মুসলিম জাতির ঐক্য আসবে কী করে?
বর্তমানের এই হাজ্বীদের প্রতি আমার একটি আবেদন আপনারা যদি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহ এবং রসুলের সন্তুষ্টি চান, এ জাতির ঐক্য চান তাহলে সেই হজ্ব করুন যা দিয়ে সমস্ত মুসলিম জাতি তাদের ভেদাভেদ ভুলে এক জাতি হয়ে যায়, রসুলাল্লাহর ঐ বাণী মোতাবেক জাতি এমন হয়ে যায়- পৃথিবীর একপ্রান্তের কোন একজনের সমস্যায় যেন অপরপ্রান্তের একজন সদস্য ঝাঁপিয়ে পড়ে, একজন নেতার অধীনে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর আদেশ বাস্তবায়নে নিজেদের কোরবান করতে শেখে। আর যদি কেউ নিছক হাজ্বী উপাধি লাভের জন্য কিংবা ব্যক্তিগত সওয়াব লাভের জন্য হজ্ব-পালন করে থাকেন তাহলে আমার কোন কথা নেই। শুধু কথা একটাই থাকবে- অনৈক্যের বিষবাস্প আজ চারিদিকে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা এক সময় কাউকে নিস্তার দেবে না।