শেখ মনিরুল ইসলাম:
সর্বশেষপ্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, মিনায় পদদলিত হয়ে সাত শতাধিক হাজির মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। অস্থিতিশীলতা, গৃহযুদ্ধ বা বহিঃশক্তির আক্রমণের বদৌলতে মুসলিমদের মৃত্যু এমনিতেই অনেক সহজ হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে শত শত মুসলিমের মৃত্যুর খবর পেতে আমরা এক প্রকার অভ্যস্ত। সে হিসেবে এ মৃতের সংখ্যা আহামরি কিছু না হলেও, অন্য সব মৃত্যুর সাথে মিনায় পদদলিত হয়ে যে মানুষগুলো প্রাণ হারালো তাদের মৃত্যুকে আমরা এখানে একটু ভিন্নদৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করব।
আল্লাহর রসুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘শীঘ্রই এমন দিন আসছে যে অন্যান্য জাতিসমূহ এই উম্মাহর বিরুদ্ধে একে অপরকে ডাকবে যেমন করে (খানা পরিবেশন করার পর) একে অন্য সবাইকে খেতে ডাকে।” তাকে প্রশ্ন করা হলো “আমরা কি তখন সংখ্যায় এত নগণ্য থাকব?” তিনি বললেন, “না, তখন তোমরা সংখ্যায় অগণ্য হবে, কিন্তু হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। (হাদীস- সাওবান (রা:) থেকে আবু দাউদ, মেশকাত) রসুলের এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ভালো করে খেয়াল করুন। তিনি যাদের সম্পর্কে বলছেন তাদের সাথে বর্তমানের এই জাতিটির চিত্র হুবহু মিলে যায় না কি? আজ মুসলিমরা সংখ্যায় অগণিত, বিশাল ভূখ-ের অধিকারী, প্রাকৃতিক সম্পদের সিংহভাগ এদের হাতে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি হুংকার ছাড়লে পৃথিবীর তাবৎ অপশক্তির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠার কথা। অথচ বাস্তবতা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
পৃথিবীর সর্বত্র মুসলিম নামধারী জাতিটি আজ অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত। এদের প্রাণের দাম নেই। মা-বোনদের ইজ্জতের মূল্য নেই। পৃথিবীব্যাপী এরা ১৬০ কোটির বিশাল সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যার সেই বিশালত্বের কোনো মাহাত্ম্য নেই। স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতোই এদের জীবন-সম্পদ অর্থহীন, মূল্যহীন। পরাশক্তিগুলো এদের নিয়ে ইদুর-বেড়াল খেলছে। কখনও নিজেরা মারছে, লুটতরাজ চালাচ্ছে, কখনও এদেরকেই অস্ত্র দিয়ে একে অপরের সম্মুখে দাঁড় করাচ্ছে। এ জাতি নিজেরাই নিজেদের রক্তে হোলি খেলে। আজকে ইরাক-সিরিয়ার দিকে তাকালে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। লাখ লাখ মুসলিম উদ্বাস্তু হয়ে পথে ঘাটে জীবন কাটাচ্ছে। পশুর সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। এক দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য দেশের সীমানায় কড়া নাড়ছে। প্রভুদের কৃপা হলে আশ্রয় পাচ্ছে, না হলে কুকুরের মতো বিতাড়িত হচ্ছে। লাথি খাচ্ছে। কেউ সমুদ্রে ডুবে মরছে। কেউ পাচার হয়ে যাচ্ছে। শুধু একটাই অপরাধ- তারা মুসলিম। ঠিক একই কারণে একই পরিণতি ভোগ করছে- আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইয়েমেন, লিবিয়া, ফিলিস্তিন ও মিয়ানমারের মুসলিমরা। এ তালিকায় বাকি মুসলিম দেশগুলোর নামও যে অচীরেই যোগ হতে যাচ্ছে তা পরিস্থিতি অবলোকন করে পূর্বেই বলে দেয়া যায়। এমতাবস্থায়, এ জাতির উপমা স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনা ছাড়া আর কী হতে পারে?
একটা সময় ইহুদি জাতি সমস্ত পৃথিবীতে মার খেয়ে বেড়াতো। মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতো না। সংঘবদ্ধভাবে অন্যান্য জাতিগুলো এদেরকে আক্রমণ করে হত্যা করতো, ধন-সম্পদ লুটপাট করতো, মেয়েদের লাঞ্ছিত করতো। এ ছিল তাদের প্রতি নবী-রসুলদের অভিশাপের ফল। আজ সমস্ত পৃথিবীতে মুসলিম জাতির যে দুরাবস্থার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা ইহুদি জাতির ওই অভিশপ্ত জীবনকেও হার মানায়। এদের এই দুরাবস্থার কারণও যে আল্লাহর অভিশাপ তা সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। প্রথমত, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করে ভোগ বিলাসিতায় মত্ত হওয়া এবং দ্বিতীয়ত, জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করায় এরা এখন মোমেন নেই, মুসলিমও নেই, উম্মতে মোহাম্মদী হবার তো প্রশ্নই উঠে না। এদের ইতিহাসে দগদগে ‘কলঙ্ক’ হয়ে আছে প্রায় দুই শতাব্দীর দাসত্ব। কিন্তু কার্যত কাফের-মোশরেকে পরিণত হলেও তারা নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত, জিকির-আজগার, দাড়ি-টুপি, মিলাদ-মাহফিল, কোর’আন তেলাওয়াত ইত্যাদি ব্যক্তিগত আমলে, উপাসনায় পৃথিবী ভরে ফেলছে। আল্লাহ বলেছেন, “আমি কি তোমাদের এমন লোকদের কথা বলব, যারা আমলের দিক থেকে স¤পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত? (এরা হচ্ছে) সেসব লোক যাদের সকল প্রচেষ্টা এ দুনিয়ায় বিনষ্ট হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে মনে ভাবছে, তারা (বুঝি) ভালো কাজই করে যাচ্ছে (সুরা কাহাফ: ১০৩-১০৪)।’ বর্তমানের মুসলিম নামধারী এই জাতিটি আল কোর’আনের এই বাণীকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছে। যেখানে আল্লাহর কাছে এদের জীবনেরই কোনো মূল্য নেই, সেখানে হজ্ব-কোরবানি তথা আমল কবুল হওয়ার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?
লা’নতের অন্যতম একটি পরিণতি হলো জাতির মধ্য থেকে বোধশক্তি উঠে যাওয়া। এ জাতির সেটাই হয়েছে। এদের ন্যূনতম বোধশক্তি থাকলে তারা বিপুল অর্থ-সম্পদ খরচ করে হজ্ব করার চাইতে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেশি গুরুত্ব দিতো, আগে মো’মেন হবার চেষ্টা করতো। হজ্ব তো ইসলামপূর্ব আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মোশরেকরাও করতো (যারা সেটা জানেন না তাদেরকে ইতিহাস পড়ার অনুরোধ রইল)। কিন্তু সে হজ্বের কোনো মূল্য কি আল্লাহর কাছে ছিল? শুধু হজ্ব নয়, ইসলামের সকল বিধি-বিধান পালনের নির্দেশ কেবল মো’মেনদের জন্য। আল্লাহ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন কেবল মো’মেনদের। আর মো’মেন হবার পূর্বশর্ত হলো মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নিঃস্বার্থভাবে জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করা, যার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টাও এ জাতিতে কেউ দেখাতে পারবেন না। এরা লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্ব করতে যান, কারও উদ্দেশ্য থাকে সামাজিক মর্যাদাবৃদ্ধি, নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ পদবী যুক্ত করার বাসনা, কারও উদ্দেশ্য থাকে নিজের আত্মার উন্নতি সাধন। অর্থাৎ উভয়ই ব্যক্তি ও স্বার্থকেন্দ্রিকতা। জাতির স্বার্থের প্রশ্নে তারা নির্বিকার।
অধঃপতিত জাতি যখন ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে পড়ে বিরাণভূমিতে পরিণত হচ্ছে মুসলিম দেশগুলো, অন্যায়, অবিচার, অনাচার, হানাহানি, রক্তপাত অর্থাৎ অশান্তিতে ছেয়ে গেছে সমাজ, তখন লানতের স্পষ্ট ছাপ ললাটে ধারণ করে আত্মিক উন্নতি অর্জন করার ব্যর্থ প্রয়াসে হজ্ব করতে যাওয়া যে আল্লাহর সাথে তামাশা করা হচ্ছে সে কথা তাদের কে বোঝাবে? আল্লাহর রসুল বলেছেন- ‘আমার উম্মত একটি দেহের ন্যায়, এর এক অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হলে সমস্ত শরীরে সে ব্যথা অনুভূত হয়।’ এক অংশ নয়, আজ আক্রান্ত এ জাতির সর্বাঙ্গ, প্রাণবায়ু নির্বাপিত হয়েছে বহু আগেই, এখন তার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পচে-গলে গন্ধ ছড়াচ্ছে, অথচ সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, চেতনা নেই। তারা সারা জীবন স্বার্থের পূজা করবেন, তারপর বৃদ্ধ বয়সে হজ্ব করে পবিত্র হয়ে মৃতুর সাথে সাথে স্বর্গে চলে যাবেন। জাতির কথা ভাবার সময় কোথায়?
যাদের মৃত্যু হবার কথা ছিল মানবতার কল্যাণে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য, তারা যখন নিছক সংখ্যাধিক্কের কারণে নিজেরাই নিজেদের পায়ে দলিত হয়ে প্রাণ হারায়, তখন বোঝা যায়, মৃত্যুও এ জাতির সাথে উপহাস করতে কত ভালোবাসে। মিনায় পদদলিত হয়ে সাত শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, ‘সেখানে সাহায্যের হাত বাড়ানোর মতো কাউকে পাওয়া যায় নি।’ কী সাংঘাতিক কথা! ঐক্যের শিক্ষা দেয় হজ্ব, ত্যাগের মহীমা শিক্ষা দেয় কোরবানি, আর শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের মাঝে রয়েছে বিপদগ্রস্ত মানুষের মুক্তির জন্য অপশক্তির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সংগ্রামের মহড়া। কিন্তু এ ঘটনা প্রমাণ করে, এ জাতি না ঐক্যের শিক্ষা গ্রহণ করেছে, না ত্যাগের। যদিও এদের হজ্ব নিরর্থক, কেননা আল্লাহ মোমেন ছাড়া কারও আমল কবুল করেন না, তবু যদি হজ্ব থেকে পার্থিব কিছু শিক্ষা এরা লাভ করতে পারতো তাও কিছুটা উপকার হতো, সেটাও তো হচ্ছে না। যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মৃত্যুকে অনেকে ‘শহীদী মৃত্যু’ বলতে চাইবেন, কিন্তু সেটা নিছক আশ্বাসবাণী ছাড়া কিছুই নয়। যেখানে স্বার্থ আছে, সেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করা চলে না। নিজেদের পায়ে পদদলিত হয়ে লজ্জাজনক এই কাপুরুষোচিত মৃত্যুকে ‘শহীদী মৃত্যু’ অভিহিত করলে যারা সকল প্রকার স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন তাদেরকে ছোট করা হবে। শহীদের সম্মান প্রদান তো পরের কথা, যে হজ্ব এবং যে মৃত্যু মানবতার কল্যাণে কাজে লাগে না, সে অর্থহীন হজ্ব ও অর্থহীন মৃত্যুর কোনো মূল্যই আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ বলেন- ‘বল, আমার সালাহ, আমার যাবতীয় ইবাদাত, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু, সব কিছুই সারা জাহানের রব আল্লাহরই জন্য (আন’আম-১৬২)।’ এখানে আল্লাহর জন্য মানে যে কাজ মানুষের কল্যাণে বা মানবতার কল্যাণে করা হয়। কাজেই আমাদের সকল আমল, তা সালাহ হোক, সওম হোক, হজ্ব হোক বা মৃত্যু হোক, সবই যেন মানবতার কল্যাণে, অর্থবহ ও সার্থক হয়। যে আমল বা মৃত্যু মানবতাকে উপকৃত করতে পারল না, সেই আমল বা মৃত্যু হাশরের দিনও জান্নাতে নিতে পারবে না।