সাইফুর রহমান:
রাজনীতি হলো রাজ্য পরিচালনার নীতি। যে নীতি অনুসরণ করে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা যাবে। এরিস্টটল, প্লেটোর মতো মহান দার্শনিকদের মতে রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো সাধারণ কল্যাণ, সামাজিক শুভবোধ ও নৈতিক পূর্ণতা সাধন। যারা রাজনীতি করবে তাদের লক্ষ্য হবে মানুষের কল্যাণ, সমাজে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা। এ কাজের জন্য রাজনীতিকদের অবশ্যই নিঃস্বার্থ হতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। প্রতিটি কাজ করতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে।
কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ভোগবাদী, বস্তুবাদী, আত্মাহীন দাজ্জালীয় সিস্টেমটাই এমন যে এখানে প্রায় প্রতিটা মানুষই স্বার্থপর হয়ে বেড়ে উঠছে। শিশুগুলো জন্ম নিচ্ছে স্বার্থবাদী এক সমাজে, পরিবারের কাছ থেকে শিখছে স্বার্থপরতা, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শিখছে ভোগ-বিলাসিতা, সমাজ থেকে শিখছে আত্মকেন্দ্রিকতা। নিরেট নিজেকে, সর্বোচ্চ নিজের পরিবারকে নিয়ে ভাবতে শিখছে। এই মানুষগুলো থেকেই কিছু মানুষ রাজনীতিতে আসছে। তারা আমাদের এই সমাজেরই মানুষ- ফলে তারাও স্বার্থপরতার গণ্ডি থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ না ভেবে নিজের ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়। আর আমরাও তাদের সেই স্বার্থপরতা হজম করে চলি।
রাজনীতি আজ সর্বাধিক লাভজনক একটি পেশাতে পরিণত হয়েছে। ভোটের সময় আসলেই রাজনীতিকদের মুখে দেশপ্রেম, দেশ ও জনগণের সেবা, দেশের উন্নয়ন ইত্যাদি আপ্তবাক্যে মাইক্রোফোন সিক্ত হয়, আকাশ-বাতাস মুখরিত হয় কিন্তু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশের ব্যস্ত সময় কাটে নিজের পকেট ভারী করতে, নিজের নানামুখী স্বার্থ ও নিজ দলের স্বার্থ উদ্ধার করতে। আবার পাঁচ বছর পর নতুন প্রলোভন নিয়ে জনগণের সামনে ভোটভিক্ষা করতে উপস্থিত হয় তারা। প্রচলিত সিস্টেমে যেহেতু নির্বাচনের সময় ব্যালটে প্রতিবাদের মাধ্যমে অন্য কোনো স্বার্থবাজ লোককে নির্বাচিত করা ছাড়া সাধারণ মানুষের আর কোনো উপায় থাকে না তাই নতুন কোনো স্বার্থবাজ নেতা পায় জনগণের সমর্থন আর নতুন উদ্যমে চলতে থাকে নবনির্বাচিত প্রতিনিধির স্বার্থ উদ্ধারের পালা। জনগণের রক্তঝরানো টাকা নেতা-নেত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমতে থাকে নানা কৌশলে। সেই অর্থের ন্যূনতম লভ্যাংশও যেন জনগণের ভাগ্যে না জোটে সে জন্য সেই অর্থ আবার বিদেশি ব্যাংকে পাচার হয়ে যায়। দেশ ও জাতি সঙ্কটে পড়লে জনগণকে ছেড়ে তারা যেন উড়াল দিয়ে প্রভুদের দেশে বসবাস করতে পারে সে ব্যবস্থাও পাকাপোক্ত করা থাকে। দেশের মানুষ বন্যায় ডুবে মরে আর তারা সাহায্যের অজুহাতে ত্রাণ তহবিল থেকে অর্থলুট করে। এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চলে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিতই থেকে যায়। আমরা প্রতিদিন চোখের সামনে দুর্নীতির খবর দেখি, দেখি রাজনীতিকদের দেশ বিক্রির প্রতিযোগিতা তবুও আমরা নিশ্চুপ, নিশ্চল দর্শক হয়েই বসে থাকি। এটাকে আমরা ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি।
রাজনীতিসংশ্লিষ্টরা নিজ দল অথবা গোষ্ঠীর ভেতর নিজেদেরকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেন যে তারা আর মুক্ত মানুষ থাকতে পারেন না। দেশপ্রেমিক হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। প্রকৃত অর্থে রাজনীতির সাথে বিপ্লবের সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রত্যয় রয়েছে। রয়েছে দেশপ্রেমের আত্মিক সংস্পর্শ। কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থায় রাজনীতির যে ধারা প্রবল প্রতাপ নিয়ে বিরাজ করে তা স্বার্থবাদী দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে একচুলও বেরুতে পারে না।
আমরা মনে করি, শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল এবং ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য যে অপরাজনীতি চলছে এই স্বার্থবাদী অপরাজনীতি অচিরেই বন্ধ হওয়া উচিত। রাজনীতির নামে সংঘাত, সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর ইত্যাদি আজ যেন নিত্য ঘটনা। নিজের নামে ছাফাই গাওয়া, অন্যের নামে কুৎসা রটনা করা, বিরোধী দলে থাকলে কারণে-অকারণে সরকারের সকল কাজের বিরোধিতা করা আর সরকারি দলে থাকলে নানা মিথ্যা অজুহাতে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীকে হয়রানি করাই এখন রাজনীতির রীতি। এগুলোকেই মানুষ রাজনীতির অংশ হিসাবে ভাবছে। এই রীতিগুলোকে রাজনীতি থেকে বিদায় জানাতে হবে। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের চিন্তা বাদ দিয়ে দেশ ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। রাজনীতিকরা সেই কাজই করবেন যা রাষ্ট্রের প্রতিটা জনগণের জন্য কল্যাণকর হয়। রাজনীতি কোনো পেশা নয়। যারা রাজনীতি করবে তারা শুধুই মানুষের কল্যাণের জন্য তা করবে। এর কোনো বিনিময় নেওয়া চলবে না। নিজের বাড়িতে থাকবে, নিজের উপার্জিত টাকায় সংসার চালাবে, নিজের গাড়ি থাকলে নিজের টাকায় তেল খরচ করবে আর গাড়ি না থাকলে পাবলিক বাহনে চলবে, নিজের টাকায় মোবাইল খরচ করবে। একটা টাকাও জাতির কাছ থেকে তথা সরকারের কাছ থেকে নেবে না। এই রাজনীতি মানুষের শান্তি দেবে, এই রাজনীতি যারা করবেন তারা পরকালেও আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন। ব্যবসায়ীরা যদি সৎভাবে ব্যবসা করেন, মানুষের কল্যাণ চিন্তা করে ব্যবসা করেন তবে সেটা তাদের এবাদত হবে। ঠিক একইভাবে রাজনীতিকরা যদি মানুষের কল্যাণে কাজ করেন তবে সেটাই হবে রাজনীতিকদের এবাদত। তারা স্রষ্টার সান্নিধ্য পাবার আশায়, মানুষের ভালোবাসা পাবার জন্য রাজনীতি করবে। মানুষের সেবা করার মধ্যেই যারা জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পাবে, ভোগের পরিবর্তে ত্যাগেই যারা পরিতৃপ্ত থাকবে, অর্থ-সম্পত্তির চেয়ে মানুষের ভালোবাসা, দোয়া যাদের কাছে অধিক কাম্য তারাই কেবল রাজনীতি করতে পারবে।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ, রংপুর বিভাগ