হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

সামরিক ঘাঁটিগুলো হয়ে গেল খানকাহ

এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে
শেষ জীবনব্যবস্থাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে অর্থাৎ রসুলাল্লাহর (স.) প্রকৃত সুন্নাহ সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করে এই দীনের মাসলা-মাসায়েলের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে, নানা মাযহাব ফেরকা সৃর্ষ্টি করে এই জাতিটাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার কাজে যখন প-িতরা ব্যস্ত, শাসকরা যখন মহা জাঁকজমক, শান-শওকতের সঙ্গে রাজত্ব করায় ব্যস্ত তখনও এই জাতির সমস্ত মানুষ মরে যায় নি। মহানবী (স.) তাঁর শিক্ষায় যে সামরিক প্রেরণা উম্মাহর বুকে প্রোথিত করে দিয়েছিলেন, যা বটগাছের শেকড়ের মতো স্থান করে নিয়েছিল, তা তখনও সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায় নি। কিন্তু ঐ সামরিক প্রেরণা তখন পরিবর্তন হয়ে আত্মরক্ষামূলক (Defensive) হয়ে গেছে। এই জাতির সীমান্ত তখন উত্তরে আটলান্টিকের তীর থেকে ভূমধ্য সাগরের তীর ধরে উড়াল পর্বতমালা পর্যন্ত, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর, পশ্চিমে উত্তর আফ্রিকার আটলান্টিকের তীর, পূর্বে পূর্ব ভারত। এর মধ্যে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল শুধুমাত্র ইউরোপের দিক থেকে। কারণ অন্য দিকগুলোয় এমন কোনো শক্তি ছিল না যেটা এই জাতিকে আক্রমণ করার সাহস করে। এই উত্তর সীমান্তে আক্রমণ করতে হলে শত্রুকে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে এপারে এসে নামতে হবে। এই উত্তর সীমান্তকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম জাতি মরক্কো থেকে ভূমধ্য সাগরের উপকূল বরাবর পূর্বদিকে পারস্য পর্যন্ত অসংখ্য ছোটবড় দুর্গ তৈরি করেছিল।
এ দুর্গগুলির নাম দেয়া হয়েছিলো ‘রেবাত’। শব্দটি নেয়া হয়েছিল কোর’আনের সুরা আনফালের ৬০নং আয়াত থেকে যেখানে আল্লাহ উম্মাতে মোহাম্মদীকে আদেশ করছেন শত্রুর মোকাবিলার জন্য তোমরা যথাসাধ্য সামরিক সরঞ্জাম, অশ্ববাহিনী ইত্যাদি একত্র করে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক (সুরা আনফাল ৬০)। এই প্রস্তুতির স্থানটাকে আল্লাহ কোর’আনে রেবাত বলেছেন- যার অর্থ হলো সামরিকভাবে একটি সুরক্ষিত স্থান। এই রেবাতগুলিতে একটি করে নিরীক্ষণ মঞ্চ (Watch tower) থাকতো। শত্রু আক্রমণ করলে তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে দুর্গের ভেতরে ও আশেপাশের স্থানীয় লোকদের সতর্ক করে দেওয়া ও নিজেরা শত্রুদের প্রতিরোধ করা ছিল এই দুর্গ বা রেবাতগুলির উদ্দেশ্য। তখনকার দিনে এখনকার মতো পাশ্চাত্যের অনুকরণে আলাদা সামরিক বাহিনী (Standing Army) ছিল না, গোটা জাতিটাই, উম্মাহটাই ছিল একটা বাহিনী, প্রত্যেক মুসলিম একটি সৈন্য। তাই যেখানে যে রেবাত তৈরি করা হয়েছিল সেখানকার আশেপাশের লোকেরা দল বেঁধে পালাক্রমে ঐ রেবাতে বাস করতেন এবং শত্রুর আক্রমণ আসে কিনা তা লক্ষ্য করতেন। যে যতদিন সম্ভব ঐ দুর্গগুলিতে কাটাতে চেষ্টা করেছেন। এমনও দেখা গেছে কেউ কেউ বছরের পর বছর রেবাতে সামরিক জীবন যাপন করেছেন। রেবাত শব্দটি যেমন কোর’আন থেকে নেয়া হয়েছিল তেমনি মহানবীর (স.) বাণী, “একরাত সীমান্ত প্রহরা দেয়া হাজার বছর নফল এবাদতের সওয়াবের সমান (হাদিস- ওসমান (রা.) থেকে তিরমিযি, মেশকাত), এই মোজাহেদদের প্রেরণার কারণ ছিল। এই রেবাতগুলির মধ্যে এরা প্রহরীর কাজ করতেন, কুচকাওয়াজ করতেন, অস্ত্র ও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতেন। অবশ্যই সালাত, সওমও পালন করতেন ফরয হিসাবে। তাছাড়া এ জাতির সালাত তো সামরিক কুচকাওয়াজেরই অন্য সংস্করণ। উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের উপকূল বরাবর এই বহুসংখ্যক রেবাতগুলির সতর্ক প্রহরা ও প্রতিরোধের মুখে খ্রিষ্টান শত্রু বহুবার আক্রমণ করেও মুসলিমদের কাবু করতে পারে নি, পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেছে। ইসলামের প্রথম অর্থাৎ গতিশীল (Dynamic) যুগ (মহানবীর (স.) উল্লেখিত ৬০/৭০ বছর) শেষ হয়ে যাবার পর থেকে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীরও পর পর্যন্ত এই কয়েকশ’ বছর সীমান্ত রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ এই মোজাহেদরা অস্ত্র হাতে এই পতনোম্মুখ ও পচনশীল জাতিকে রক্ষা করেছেন।
একদিকে ঐ মোজাহেদরা কোর’আন ও সুন্নাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে জাতিকে রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন সীমান্তে, অপরদিকে জাতির ভেতর পচনক্রিয়া দ্রুত প্রসার লাভ করছে। যথাসময়ে এই পচনক্রিয়া ঐ রেবাত লাইনেও প্রবেশ করল। প্রবেশ করল লাইনের পূর্ব প্রান্তে পারস্য দেশের দিক থেকে বিকৃত তাসাওয়াফরূপে। কিছু দিনের মধ্যেই ঐ রেবাতগুলি দুর্গ থেকে বদলে হয়ে গেল সুফিদের আশ্রম আর রেবাতগুলির মোজাহেদরা হয়ে গেলেন দরবেশ, সুফি। এমনকি এগুলির আরবি নাম রেবাত পর্যন্ত বদলে হয়ে গেলো ফারসি শব্দ খানকাহ্। এরপর কী হলো তা ইতিহাস। এরপর শত্রু আক্রমণ করতে এসে কোনো বাঁধার সম্মুখীন হলো না কারণ তখন তারা মুখোমুখি হলো তলোয়ার হাতে মোজাহেদদের নয়, তসবিহ হাতে খানকাবাসী, মঠবাসী সুফিদের। দু’চারটি জায়গা ছাড়া সমস্ত মুসলিম পৃথিবী শত্রুর পদানত দাসে পরিণত হলো। মোজাহেদদের তলোয়ার যা কয়েক শতাব্দীরও বেশি রক্ষা করেছিল, সুফিদের আধ্যাত্মিক শক্তিও তসবিহ্ তা রক্ষা করতে পারল না (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পৃ. ৩৯৮)। শত্রুর হামলা প্রতিরোধ করবে কি করে? শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযান করতে, তাদেরকে প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন ইস্পাত কঠিন ঐক্য, পিঁপড়ার মত শৃঙ্খলা, প্রাকৃতিক শক্তিগুলির (মালায়েক) মত আনুগত্য এবং আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হওয়ার দুর্নিবার পিপাসা। কিন্তু ইতোমধ্যে তো আলেম, ফকিহ, প-িতরা তাদের ক্ষুরধার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে দীনের বিধানগুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন মাজহাব ও ফেরকায় বিভক্ত করে জাতিকে ঐক্যহীন, শৃঙ্খলাহীন করে দিল। আর সুফি, দরবেশরা জাতির বহিঃর্মুখী চরিত্রকে উল্টিয়ে অন্তর্মুখী, ঘরমুখী করে দিল। ফলে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার সেই ঐক্য, দৃঢ় মনোবল আর রইল না, যখন থেকেই তাদের হাত থেকে তলোয়ার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তসবিহ্ হাতে নিল, তখনই পতন অনিবার্য হয়ে গেল, তসবিহ্ দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করা যায় না।
এছাড়া এই সময়কালের মধ্যে এই জীবনব্যবস্থার ও এই উম্মাহর আরেকটি ভয়ংকর ক্ষতি করা হলো। কিন্তু এখন যে ক্ষতির কথা বলছি সে ক্ষতির পূরণ কঠিন হবে। সেটা হলো এই, এই সময়কালের প-িত, ফকিহ, মুফাস্সির মুহাদ্দিসরা যে অক্লান্ত ও অপরিসীম পরিশ্রম করেছেন এই দীনের কাজে, তা পড়লে, চিন্তা করলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয়। বিশেষ করে মুহাদ্দিসরা রসুলাল্লাহর (স.) হাদিস সংগ্রহ ও যাচাই করতে যে অধ্যবসায়, পরিশ্রম আর কোরবানি করেছেন তার তুলনা মানুষের ইতিহাসে আর নেই। কিন্তু এরা সবাই বিশ্বনবীর (স.) জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় যে ভাগটি সেটাকে যর্থার্থ গুরুত্ব দেন নি, সেটা হলো মহানবীর (স.) জীবনের সামরিক ভাগ। অবশ্য এটাকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিতে পারেন নি কারণ কোর’আনে স্বয়ং আল্লাহ যে তাঁর নবীকে (স.) সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে এই জীবনব্যবস্থা, দীনকে প্রতিষ্ঠার আদেশ দিয়েছেন (সুরা আল ফাতাহ ২৮, আত তওবা ৩৩, সুরা আস-সাফ ৯)। এই উম্মাহকে যে আদেশ দিয়েছেন সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে, যে পর্যন্ত না পৃথিবী থেকে যুলুম, অত্যাচার, অশান্তি আর রক্তপাত দূর হয়ে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হয় এগুলো তো আর বাদ দেয়া সম্ভব নয় (সুরা আনফাল ২২-২৩)। তারপর বিশ্বনবীর (স.) জীবনী লিখতে গেলে তিনি যে সমস্ত জেহাদে, কিতালে এবং গাযওয়াতে (যুদ্ধ) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সে সব লিখতেই হয়েছে। কিন্তু লিখলেও তারা সেগুলির প্রাধান্য দেন নি, প্রাধান্য দিয়েছেন তার জীবনের অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোয়। যে মানুষটির জীবনের মাত্র নয় বছরের মধ্যে ১০৭টি যুদ্ধ হয়েছে যার ২৭টি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিজে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করেছিলেন নয়টিতে, সাংঘাতিকভাবে যখম হয়েছিলেন আর বিভিন্ন দিকে সামরিক অভিযান পাঠিয়েছিলেন ৩৫টি, যেগুলির সমরনীতি এবং ব্যবস্থাপনা তাঁকেই করতে হয়েছিল, সে মানুষের জীবনটাকে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন যোদ্ধার জীবন বলতে আপত্তির কোনো কারণ আছে? প্রতিটি যুদ্ধের আগে কত রকম প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবস্থা, সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা, শত্রুপক্ষের অবস্থান ও চলাচল, তাদের সংখ্যা ও অস্ত্র শস্ত্রের সংবাদ (Intelligent) শত্রুর ও নিজেদের রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদি কত রকমের কত বন্দোবস্ত করতে হয়েছে, তার উপর প্রতি যুদ্ধের বিভিন্ন রকমের সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে। সেগুলির সমাধান করতে হয়েছে এই ব্যাপারে ঐ সময়ের প-িতদের কাছ থেকে আমরা এখন যে তথ্য পাই তা অন্যান্য বিষয়ের তথ্যাদির তুলনায় অতি সামান্য। অথচ যাকে অতগুলি যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাঁর সম্পর্কে লিখতে গেলে তার সামরিক জীবনের খুঁটিনাটিই মুখ্য হয়ে দাঁড়াবার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। মহানবীর (স.) ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি কম প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তাদের লেখায় আছে কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সংগ্রামের দিক এত কম স্থান পেয়েছে যে, মনে হয় তারা এটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন।
এর কারণ আছে। এই ফকিহ, মুফাস্সির, মুহাদ্দিস এরা সবাই আবির্ভূত হয়েছিলেন এই উম্মাহ তাঁর নেতার (স.) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করার সুন্নাহ ত্যাগ করার পর। এই উম্মাহ সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য তখন তাদের সম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে, আকিদা বিকৃতি হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হারিয়ে গিয়েছিল বলেই তো তারা সংগ্রাম ত্যাগ করে খাতা কলম নিয়ে ঘরে বসেছিলেন এই দীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে, আরেক দল এসবও কিছু না করে খানকায় ঢুকে তাদের আত্মার ঘষামাজা করতে শুরু করেছিলেন, নেতার (স.) প্রকৃত সুন্নাহ সংগ্রাম মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া কারোরই সম্মুখে ছিল না। সুতরাং তারা যে ঐ সংগ্রাম সম্বন্ধে নিরুৎসুক, অনাগ্রহী হবেন তা স্বাভাবিক। তাই তাদের সারাজীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের, অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে যে দীন, জীবনব্যবস্থা জনসাধারণের সম্মুখে উপস্থাপিত হলো তাতে বিশ্বনবীর (স.) প্রকৃত সুন্নাহর বিবরণ অতি সামান্য, তার ব্যক্তিগত জীবনের কম প্রয়োজনীয় অভ্যাসের বিশদ বিবরণ, দীনের গুরুত্বহীন ব্যাপারগুলির অবিশ্বাস্য বিশ্লেষণ। জনসাধারণের মনে দীন সম্বন্ধে আকিদা বদলে যেয়ে ইসলাম তার প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলল।

(সম্পাদনায়: আবু ফাহাদ, ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষ, মতিঝিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়)

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...