ইসলাম অর্থ শান্তি হলে মুসলিমরা আজ জগতে হীন কেন, নির্যাতিত কেন, উদ্বাস্তু কেন? ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করার পরও যদি একটি জাতি সকল জাতির লাথি খেয়ে বেঁচে থাকে তাহলে বিরাট একটি প্রশ্ন জন্ম নেয়- সমস্যাটা কোথায়? কেন এই অবস্থা?
এ অবস্থার কারণ হিসাবে একেকজন একেক মত হাজির করবেন। তবে যে মতই হাজির করুন না কেন, এ কথা আপনাকে স্বীকার করতেই হবে যে, ইসলাম হিসাবে যে ধ্যানধারণা ও আচার-অনুষ্ঠান আমরা পালন করে যাচ্ছি, সেটা যদি সত্যিকার অর্থে ‘ইসলাম’ হত তাহলে আমাদের এই বর্তমান অবস্থা হত না। ফলই বলে দিচ্ছে গাছের পরিচয়। যে ফল আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করছি তা অমৃত নয়, তা বিষফল। আর আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলাম কখনও বিষফল প্রদান করতে পারে না। আজ ইসলাম বলতে আমরা কিছু বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা ও সেই সঙ্গে নামাজ রোজা হজ ইত্যাদি পালন করাকে বুঝি। হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিষ্টান, জৈন, পারসিক ইত্যাদি ধর্মগুলোও কিছু বিশ্বাস, কিছু গ্রন্থ পাঠ, কিছু উপাসনা পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইসলামও তেমন একটি ধর্মমাত্র। পাশ্চাত্যের চালু করা বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষ জীবনব্যবস্থার এই যুগে ধর্মগুলোর জাতীয় রাষ্ট্রীয় কোনো কর্মকাণ্ডে কোনো ভূমিকা থাকে না; ইসলামেরও নেই।
অন্ধবিশ্বাস ও উপাসনাভিত্তিক ধর্ম মানুষকে আধ্যাত্মিক শান্তি বা মানসিক পরিতৃপ্তি দিতে পারলেও আর্থ-সামাজিক, জাতীয় আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অঙ্গনসমূহের উপর তা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেই অঙ্গনসমূহে বিরাজ করে অন্যায়, অবিচার, জুলুম। এ অবস্থায় ধর্মগুলো যতই শান্তির বার্তা প্রচার করুক, কার্যত শান্তি দিতে অক্ষম।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম। মানুষের জীবনের কিছু অপরিহার্য বিষয় থাকে যেগুলোকে আমরা জীবনব্যবস্থার স্তম্ভ বলতে পারি। একটি সিস্টেমে রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকতে হয়, শিক্ষাব্যবস্থা থাকতে হয়, অথনৈতিক ও বাণিজ্যব্যবস্থা থাকতে হয়, বিচারব্যবস্থা থাকতে হয়। সেই সঙ্গে পরিবারব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত জীবনের ব্যবস্থা ইত্যাদি না থাকলে তাকে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা কোনোভাবেই বলা যায় না। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ কারণ এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধ্যাত্মিক জীবন থেকে শুরু করে সমগ্র জীবনের প্রতিটি অঙ্গনের মূলনীতি ও বিধি-বিধান রয়েছে। পক্ষান্তরে গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক জীবনে নেতানির্বাচন পদ্ধতি, মত প্রকাশের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। সমাজতন্ত্র কেবল শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু যখন একজন মানুষ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও আত্মহনন করে তখন প্রশ্ন ওঠে তখন সচেতন মানুষ অনুভব করে যে মানুষের শান্তি কেবল বস্তুগত উন্নতি, ভোগবিলাস বা রাজনীতি-অর্থনীতির উপর নির্ভর করে না। বর্তমানে আমাদের জীবনযাত্রা গ্রাম্য ও সহজ-সরল নয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার তৈরি সিস্টেমের জটিল আবর্তে সে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। এমন একটি সময়ে এসে যারা ইসলামকে নিয়ে ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন তাদের কর্তব্য হচ্ছে, ইসলাম কী করে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবে এর বাস্তবভিত্তিক উত্তর প্রদান করা।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিক্ষানীতি জীবনের একটি স্তম্ভ বা পিলার। একটা বাড়ির পিলার কাঠ, বাঁশ দিয়েও তৈরি করা যায় আবার ইট-পাথর, রড, সিমেন্ট দিয়েও তৈরি করা যায়। বাড়ির স্থায়িত্ব অনেকাংশে এই পিলারের উপর নির্ভর করে। পিলার ভঙ্গুর হলে বাড়িও ভঙ্গুর। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে জাতির পরবর্তী প্রজন্ম কাক্সিক্ষত শিক্ষা ও চরিত্র লাভ করবে। তারপর তারাই এক সময় জাতির হাল ধরবে। ভুল শিক্ষা তাদেরকে চরিত্রহীন বানাবে। তাদের হাতে জাতি ধ্বংস হবে। আজকে কি তাই হচ্ছে না? জাতির শিক্ষিত মানুষগুলোই কিন্তু দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করছে। এই দুর্নীতি অশিক্ষিতদের করার সুযোগই নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে যখন পৃথিবীর জ্ঞানসমুদ্র আমাদের নখের ডগায় তখন আমাদের শিক্ষিতরা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, দেশবিক্রয়কারী বিবেকহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। তাহলে কী দিল এই সভ্যতা?
শিক্ষার সঙ্গে নৈতিকতার যোগ থাকা বাধ্যতামূলক। একই অস্ত্র ব্যবহার করে ডাকাতি করা যায়, আবার ডাকাতের বিরুদ্ধে লড়াও যায়। কলমও হচ্ছে এমন এক হাতিয়ার। শিক্ষিত মানুষ যদি ডাকাত হয় তাহলে সে তার কলমকে ডাকাতির কাজে লাগাবে। এজন্য ইসলাম মানুষকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেয়। ইসলামের অধীনে যারাই বাস করবে তারাই ক্রমশ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হবে। একজন মো’মেন বিশ্বাস করে যে আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান। সে সর্বদা আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে বলে অঙ্গীকারে আবদ্ধ। সে জানে সে যদি অন্যায় করে একদিন সেটার ফল তাকে ভোগ করতে হবে। কোনোভাবে দুনিয়ার পুলিশ, সিসি ক্যামেরা ও দুদকের চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও স্বয়ং স্রষ্টা তাকে দেখছেন। তাই সে অন্যায় করতে পারে না। রসুলাল্লাহর (সা.) সময় কোনো ব্যক্তি যদি রিপুর তাড়নায় কখনও কোনো চুরি, ব্যভিচার বা কোনোরকম অপরাধ করে ফেলেছে, সঙ্গে সঙ্গে সে এতটাই অনুশোচনায় আক্রান্ত হয়েছে যে সে নিজে সেই অপরাধের শাস্তি গ্রহণের জন্য রসুলাল্লাহর দরবারে ছুটে এসেছে।
তাকওয়া অর্থ জীবনের পথ চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সজাগ সচেতনতা। আজকে তো আল্লাহর অস্তিত্বই সমগ্র জীবনের কর্মপ্রবাহ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মানুষের তৈরি ত্রুটিপূর্ণ আইনের ফাঁক গলে বহু অপরাধ করা যায়। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার, কালো টাকা সাদা করার পন্থা জানেন আইনজীবীরা। রাজনীতিবিদরাও কীভাবে আইন ফাঁকি দিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারেন সেটারও পন্থা আছে। আইনজীবীরা সেটা শিখিয়ে দিচ্ছেন। ইসলাম এই পথ বন্ধ করেছিল। কারণ ইসলাম মানুষের আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি নিয়েও কাজ করে। তাই এর প্রভাবে মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতির একটা চেতনা জাগ্রত হয়েছিল, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যার প্রচণ্ড অভাব। মানুষ এখন নিজের অপকর্ম নিয়ে গর্বও করে থাকে প্রকাশ্যে। উদাহরণ দিই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের তারকা ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি বিলিয়নপতি হয়েছেন, কর ফাঁকি দিয়েছেন আইনের ফাঁক ফোকর গলেই। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ব্যবসায় ১১৭ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি কর মওকুফের সুযোগ নেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি নিজ মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে ‘পরামর্শক’ নিয়োগ প্রদান করেন। ২০১০-২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যয় করেছেন ২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ডলারই গেছে মেয়ে ইভানকা ট্রাম্পের কাছে। [সূত্র: দ্যা ডেইলি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ৮ মে ২০১৯]
জীবনব্যবস্থার আরেকটি স্তম্ভ হল অর্থনীতি। ইসলামের বুনিয়াদি পাঁচটি বিষয়ের একটি যাকাত বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। ইসলামের অর্থনীতি দানভিত্তিক যা পুঁজিবাদের ঠিক বিপরীত। কোর’আনে তওহীদের পর সর্বাধিক সংখ্যক আয়াতে মো’মেনদেরকে দান করার জন্য বলা হয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গুটিকয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদ পুঞ্জিভূত হয় আর অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হয়। এত বড় অবিচার সংঘটিত হয় সম্পূর্ণ বৈধভাবে। যেমন আজ পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদের মালিক মাত্র আটজন ব্যক্তি।
এর আরেকটি দুর্বলতা হচ্ছে, পুঁজি যার হাতে পণ্যের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, মূল্য নির্ধারণ সমস্তকিছু তার হাতে কুক্ষিগত। বড় বড় উৎপাদন খাতগুলোকে জাতীয়করণ থেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা নিয়ে কয়েক দশকজুড়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে। জাতীয়করণ করলে দুর্নীতির কারণে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। সরকারের কোনো জবাবদিহিত নেই। পাঁচবছর যারাই ক্ষমতায় থাকে তারাই দেশের সম্পদ লুটে খায়। বড় বড় পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল, রেল ব্যবস্থা ইত্যাদি বছরের পর বছর লোকসান গুনে যখন ব্যক্তি মালিকানাধীন করা হয়েছে তখন সেগুলো থেকেই কোটি কোটি টাকা লাভ হয়েছে। সেই টাকা চলে গেছে গুটিকয় ব্যক্তির পকেটে। তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে, বিদেশের ব্যাংকে টাকা পাচার করেছে, কেউ হয়েছে দেউলিয়া। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি এখন পুরোপুরি দাঁড়িয়ে আছে বিদেশের দান-খয়রাত ও ঋণের উপর। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ প্রায় শূন্য হওয়ার দশা হয়েছিল। তারপর আই.এম.এফ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ায় সেই আলোচনাটা আপাতত ধামাচাপা পড়েছে। তবে ধরে নেওয়া যায় ঋণের অর্থের সিংহভাগ চলে যাবে দুর্নীতিবাজদের পকেটে। যখন ঋণ শোধ করার সময় আসবে তখন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের উপর চাপানো হবে বাড়তি করের বোঝা। তারা আরও না খেয়ে, আরও বেশি কর দিয়ে তারা তাদের শাসক ও আমলাদের ভোগবিলাসের যোগান দেবে।
অর্থনৈতিক সংকট মানুষের চিরন্তন সংকট। ইসলাম যখন আসে তখন আরব ছিল চরম দরিদ্র একটি মরু অঞ্চল। ইসলামের অর্থনীতি ব্যবস্থা সেই আরবদেরকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত করেছিল। এমন কি আজ পর্যন্ত আরব শেখরা ধনকুবের হিসাবে বিশ্বজুড়ে পরিগণিত। আল্লাহর রসুল এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন যেখান থেকে অভাব, দারিদ্র্য হারিয়ে গেল। বিত্তশালী মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, অর্থ-সম্পদ উটের পিঠে বোঝাই করে শহরে-উপশহরে, পল্লীর প্রান্তরে ঘুরে বেড়াত কিন্তু গ্রহণকারী কাউকে খুঁজেও পেত না। সবাই বলত, আল্লাহর দয়ায় আজ আমরা অভাবমুক্ত। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, উম্মাহর একজন প্রশাসক দিনশেষে দেখলেন বেশকিছু স্বর্ণমুদ্রা বায়তুল মালে উদ্বৃত্ত রয়ে গেছে। তিনি তাঁর কর্মচারীদেরকে বললেন, এলাকার সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তির কাছে এই স্বর্ণমুদ্রাগুলো পৌঁছে দাও। কর্মচারীরা পুরো এলাকায় ঘুরলেন কিন্তু কেউই সেগুলো গ্রহণ করল না। বলল, আমার চেয়েও দরিদ্র মানুষ আছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সেই প্রশাসক হচ্ছেন সেই এলাকার সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তি। তাঁর নাম সাঈদ বিন আমের (রা.)। খলিফা ওমরের সময় তিনি ছিলেন সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত শহর হেমসের গভর্নর।
হেমসবাসীদের এক প্রতিনিধিদল খলিফা ওমর (রা.)-এর সাথে দেখা করতে এলে তিনি বললেন, আমাকে তোমাদের দরিদ্র নাগরিকদের একটা তালিকা দাও, বাইতুল মাল থেকে কিছু অনুদান দিব। তাদের দেয়া তালিকায় সাঈদ ইবনে আমের (রা.)-এর নাম দেখে খলিফা চমকে উঠলেন। ইনি কি গভর্নর সাঈদ ইবনে আমের? তারা সমস্বরে বললেন, জ্বি, হ্যাঁ। ওমর (রা.) তাঁর জন্য এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার একটি থলে দিয়ে বললেন, এটা সাঈদ ইবনে আমেরের ব্যক্তিগত খরচের জন্য। সাঈদ ইবনে আমের (রা.) থলেটি হাতে পেয়ে বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল, খলিফা মৃত্যুবরণ করেছেন নাকি? তিনি প্রতি উত্তরে বললেন, আখিরাত ধ্বংস করার জন্য দুনিয়া আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। তুমি এগুলো দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দাও। এগুলো কোনো কেচ্ছা-কাহিনী না, এগুলো ইতিহাস। ইসলামের সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এই যুগেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
রাজনীতি জীবনব্যবস্থার আরেকটা পিলার। জাহেলি আরব সমাজে কোনো কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ছিল না। রাজনৈতিক ব্যবস্থা ছিল গোত্রভিত্তিক। গোত্রপতিরা সমস্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। তাদের সঙ্গে যোগসাজস থাকত ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত গোষ্ঠীটির যারা মূর্তিকেন্দ্রিক ধর্মীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত। মুুর্তিকে কেন্দ্র করে হাজার বছর থেকে সেখানে একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। একেকটা গোত্রের একেকটা মূর্তি তাদের প্রতীক হিসাবে পরিচিত ছিল। রসুলুল্লাহ সেখানে এসে এই অরাজক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে একটি সুমন্বিত কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন, যার একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। সেখানে জনগণের মত প্রকাশের এতটাই স্বাধীনতা ছিল যে একজন সাধারণ মুসলিম সরাসরি খলিফাকে জবাবদিহি করতে পারতেন। শাসকের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা দুটোই ছিল। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন বা বিক্ষোভ কর্মসূচির নামে হানাহানি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির কোনো সুযোগ ছিল না। প্রতি সপ্তাহের সমস্যা জুমার দিনেই সমাধান করে ফেলা হত। প্রতিটি নাগরিক এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ ছিল যে তারা কখনওই আল্লাহর হুকুমের বাইরে যাবে না। ফলে একটা সমাজে একটা মানদণ্ড ও সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজকের প্রধামন্ত্রীশাসিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কার সিদ্ধান্ত যে চূড়ান্ত- প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, সংসদ না আদালত সে ফায়সালা এখনও অমীমাংসিত।
ইসলামের ব্যবস্থায় কারো সমালোচনা করতে হলে সেটা তার সামনে করতে হবে, আড়ালে করা যাবে না। করলে সেটা হবে গিবত, যা একটি অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে স্বীকৃত ছিল। একে জাতির ঐক্যনষ্টের কারণ হিসাবে তুলে ধরা হত। আজকে সংসদের মধ্যে যদিও ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারের ত্রুটিগুলো তুলে ধরার জন্য, কিন্তু বাস্তবে বিরোধিদল সংসদে নানাকারণে অনুপস্থিত থেকে যায় এবং রাজপথেই আন্দোলন করে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে, দেশের উন্নতি অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে থাকে।
পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভগুলোকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। সুনাগরিক গড়ে তুলতে তা যুগ যুগ ধরে ব্যর্থ হচ্ছে; পরিণামে আমরা ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। এই সময়ে এসে আমাদেরকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে ইসলাম কিভাবে উম্মাহর সদস্য তথা নাগরিকদেরকে তৈরি করেছিল। মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে যে, আজকের এই সঙ্কটময় বিশ্বে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার বিকল্প কোনো পথ নাই। এটার প্রস্তাব এখন সর্বত্র আলোচনা হওয়া দরকার মনে করি।