আজ সমগ্র মানবজাতি যে নিদারুণ সঙ্কটে পতিত, তার একমাত্র কারণ আমাদের ত্রুটিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। জীবনব্যবস্থা হতে পারে দুই প্রকার- স্রষ্টার দেওয়া অথবা মানুষের তৈরি। যুগে যুগে মানুষের জীবনযাপনকে শান্তিময় করতে স্রষ্টা তাঁর নবী-রসুল-অবতারগণের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠিয়েছেন, যেগুলিকে আমরা ধর্ম বলে থাকি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে বিরাজিত মোট ধর্মের সংখ্যা ৪,২০০টি, যার মধ্যে প্রধান পাঁচটিকে বলা হয় বিশ্বধর্ম বা World Religion. পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আছেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী- প্রায় ২২০ কোটি, এসলাম ধর্মের অনুসারী ১৬০ কোটি, সনাতন ধর্মাবলম্বী ১১০ কোটি, বৌদ্ধ আছেন প্রায় ৫০ কোটি, ইহুদি আছেন ১ কোটি ৪০ লক্ষের মত। আর প্রায় ১১০ কোটি মানুষ আছেন যারা কোনো ধর্মের উপরই আস্থাশীল নন। ধর্মের প্রতি এত বিরাট সংখ্যক মানুষের বীতশ্রদ্ধ হওয়ার কারণ, মানবজাতির শান্তির জন্য যে ধর্মের আগমন তা আজ অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সমগ্র মানবজাতি, এমন কি যারা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক বলে দাবি করেন তারাও নিজেদের সামগ্রিক জীবন থেকে স্রষ্টার বিধান বাদ দিয়েছেন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থা, তন্ত্র-মন্ত্র মেনে চলেছেন।
প্রতিটি ধর্মের মূল শিক্ষা এক
মানবসৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত কেবলমাত্র স্রষ্টার বিধানই মানুষকে শান্তি দিতে পেরেছে। এটাই মানুষের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার সঠিক মূল্যায়নই আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। স্রষ্টায় বিশ্বাসী সকলকে আজ হৃদয় দিয়ে বুঝতে হবে যে, সকল মানুষ একই স্রষ্টার সৃষ্টি, তারা একই বাবা-মা আদম হাওয়ার সন্তান।
মহান স্রষ্টার অভিপ্রায় হচ্ছে, মানবজাতি একতাবদ্ধ হয়ে শান্তিতে জীবনযাপন করুক, ঠিক যেমনভাবে একজন পিতা চান তার সন্তানেরা মিলেমিশে থাকুক। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়হস্তে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সুরা এমরান ১০৩)
বেদে বলা হয়েছে, “হে মানবজাতি! তোমরা সম্মিলিতভাবে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হও, পারস্পরিক মমতা ও শুভেচ্ছা নিয়ে একত্রে পরিশ্রম কর, জীবনের আনন্দে সম অংশীদার হও। একটি চাকার শিকগুলো সমভাবে কেন্দ্রে মিলিত হলে যেমন গতিসঞ্চার হয়, তেমনি সাম্য-মৈত্রীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হও, তাহলেই অগ্রগতি অবধারিত। (অথর্ববেদ, ৩/৩০/৬-৭)।
বাইবেলে ঈসা (আ:) বলেছেন, “যে রাজ্য নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সে রাজ্য ধ্বংস হয়, আর যে শহর বা পরিবার নিজের মধ্যে ভাগ হয়ে যায় সেই শহর বা পরিবার টেকে না।” (মথি ১২:২৫)
সত্য এক লক্ষ বছর পুরাতন হলেও তা মিথ্যা হয়ে যায় না, আবার পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একটি মিথ্যাকে মেনে নিলেও সেটা সত্য হয়ে যায় না। আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার আরেক নাম দীনুল কাইয়্যেমাহ (সুরা ইউসুফ ৪০, সুরা বাইয়্যেনাহ ৫, সুরা রুম ৩০, ৪৩)। দীন শব্দের অর্থ জীবনব্যবস্থা আর কাইয়্যেমাহ শব্দটি এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ প্রতিষ্ঠিত, আদি, শাশ্বত, চিরন্তন। যা ছিল, আছে, থাকবে। সনাতন শব্দের অর্থও আদি, শাশ্বত, চিরন্তন। এই হিসাবে আমরা বলতে পারি, স্রষ্টার প্রেরিত সকল ধর্মই সনাতন ধর্ম। সুতরাং সকল ধর্মের অনুসারীরাই একে অপরের ভাই।
সকলের আদিতে যিনি তিনিই স্রষ্টা, সবকিছুর শেষেও তিনি (সুরা হাদীদ ৩)। তিনিই আলফা, তিনিই ওমেগা। (Revelation 22:13) কারও কাছে তিনি আল্লাহ, কারো কাছে ব্রহ্মা, কারো কাছে গড। যে যে নামেই ডাকুক সেই মহান স্রষ্টার প্রশ্নহীন আনুগত্যই সকল ধর্মের ভিত্তি। তাই সনাতন ধর্মের মহাবাক্য ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬:২:১) অর্থাৎ একত্ববাদ। ‘একম ব্রহ্মা দ্বৈত্য নাস্তি’ অর্থাৎ ব্রহ্মা এক, তাঁর মত কেউ নেই। নিউ টেস্টামেন্টে বলা হচ্ছে: There is only one Lawgiver and Judge. (New Testament: James 4:12) অর্থাৎ বিধানদাতা এবং বিচারক কেবলমাত্র একজনই। কোরানের শিক্ষাও তাই, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তিনি আদেশ দিয়েছেন যে আল্লাহ ছাড়া আর কারও আনুগত্য করো না। এটাই দীনুল কাইয়্যেমাহ অর্থাৎ শাশ্বত-সনাতন জীবনবিধান। সমস্ত মানবজাতি এক পিতা-মাতা আদম-হাওয়ার সন্তান। বাইবেলে তাঁদের নাম অ্যাডাম ও ইভ। ভবিষ্যপুরাণে তাঁরা আদম ও হব্যবতী। ভবিষ্যপুরাণমতে, “আদমকে প্রভু বিষ্ণু কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেন। তারপর তারা কলি বা এবলিসের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ রম্যফল ভক্ষণ করে স্বর্গ থেকে বহিষ্কৃত হন।” কোর’আন ও বাইবেলের বর্ণনাও প্রায় একই।
স্রষ্টার দেওয়া সম্ভবত প্রাচীনতম গ্রন্থ হচ্ছে বেদ। আমাদের বিশ্বাসমতে, মহর্ষী মনু, রাজা রামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাবীর জৈন, মহামতি বুদ্ধ এঁরা সবাই ছিলেন ভারতবর্ষে আগত আল্লাহর নবী। অনেক গবেষক মনে করেন বৈবস্বতঃ মনুই হচ্ছেন বৈদিক ধর্মের মূল প্রবর্তক, যাঁকে কোরানে ও বাইবেলে বলা হয়েছে নূহ (আ:), ভবিষ্যপুরাণে বলা হয়েছে রাজা ন্যূহ। তাঁর উপরই নাযেল হয় বেদের মূল অংশ। তাঁর সময়ে এক মহাপ্লাবন হয় যাতে কেবল তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একটি বড় নৌকায় আরোহণ করে জীবন রক্ষা করেন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিটি প্রাণীর এক জোড়া করে রক্ষা পায়। এই ঘটনাগুলি কোরানে যেমন আছে (সুরা মো’মেনুন-২৭, সুরা হুদ ৪০, সুরা আরাফ ৬৪, সুরা ছাফফাত ৭৭), বাইবেলেও (Genesis chapters 6–9) আছে আবার মহাভারতে (বনপর্ব, ১৮৭ অধ্যায়: প্রলয় সম্ভাবনায় মনুকর্তৃক সংসারবীজরক্ষা) মৎস্যপুরাণেও আছে। যা প্রমাণ করে যে, এই সব গ্রন্থই একই স্থান থেকে আগত।
শাস্ত্রের শাসন যখন ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তখন এখানে বিরাজ করত অকল্পনীয় শান্তি। উদাহরণ হিসাবে রামরাজত্বের কথা বলতে পারি। রামরাজত্বে বাঘ ও ছাগ একসঙ্গে জল পান করত। মানুষের মধ্যে কেউ কারও শত্রু ছিল না। ধর্মীয় জ্ঞান ধর্মব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত ছিল না, সাধারণ মানুষও ধর্মের বিধানগুলি জানত। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের কোন পার্থক্য ছিল না। রাজ্যের নামই হয়েছিল অযোদ্ধা অর্থাৎ যেখানে কোন যুদ্ধ নেই। শিক্ষকের মর্যাদা ছিলো সবার ঊর্ধ্বে। নীতি-নৈতিকতায় পূর্ণ ছিল মানুষ।
কিন্তু এই শান্তি চিরস্থায়ী হয় নি। অবতারগণের বিদায় নেওয়ার পর তাদের অনুসারীদের মধ্য হতে অতি ভক্তিবাদী কিছু মানুষ ধর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করেছে এবং ধর্মকে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের বাইরে নিয়ে গেছে। ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিশেষ শ্রেণির ব্যবসার পুঁজি। ফলে ধর্ম শান্তির কারণ হওয়ার পরিবর্তে শোষণের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যই স্রষ্টা আবার নতুন অবতার পাঠিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ (আ:) অর্জুনকে বলছেন: হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি অবতীর্ণ হই এবং সাধুদিগের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন করি। শ্রীগীতা ৪:৭/৮।
সুতরাং ধর্মকে পুনস্থাপন করে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্যই ভারতবর্ষে এসেছেন শ্রীকৃষ্ণ (আ:), রামচন্দ্র (আ:), যুধিষ্ঠির (আ:), মধ্য এশিয়ায় এসেছেন এব্রাহীম (আ:), ইহুদীদের মধ্যে এসেছেন মুসা (আ:), দাউদ (আ:), ঈসা (আ:), ইয়াহিয়া (আ:), ইয়াকুব (আ:) এমনই আরও বহু নবী রসুল। এভাবে সকল যুগে, সকল জাতি গোষ্ঠীর কাছে তাদের মাতৃভাষায় আল্লাহ নবী-রসুল, ও গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। (সুরা ইউনুস ৪৮, সুরা রাদ ৮, সুরা নাহল-৩৭, সুরা ফাতির -২৫, সুরা ইব্রাহীম-৫)। তাঁদের অনেকের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রামরাজ্যের অনুরূপ শান্তিময়, প্রগতিশীল সমাজ।
এঁদেরই ধারাবাহিকতায় মক্কায় আসলেন সর্বশেষ রসুল মোহাম্মদ (স:)। তিনি যে জীবনব্যবস্থা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন সেটা যখন অর্ধ পৃথিবীতে প্রয়োগ করা হলো, সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলো ন্যায়, সুবিচার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জীবন ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা এক কথায় শান্তি। স¤পদের এমন প্রাচুর্য তৈরি হয়েছিল যে, দান গ্রহণ করার মত লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। একজন যুবতী মেয়ে সমস্ত গায়ে অলংকার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল পথ অতিক্রম করতে পারত, তার মনে কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হত না। আদালতে মাসের পর মাস কোন অভিযোগ আসত না। আল্লাহর দেওয়া সত্য জীবনব্যবস্থার প্রভাবে সত্যবাদিতা, আমানতদারী, পরোপকার, অতিথিপরায়ণতা, উদারতা, ত্যাগ, ওয়াদারক্ষা, দানশীলতা, গুরুজনে শ্রদ্ধা ইত্যাদি চারিত্রিক গুণাবলীতে মানুষের চরিত্র পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এটাই ছিল সত্যদীনের সর্বশেষ সংস্করণ যা আইয়ামে জাহেলিয়াতের দারিদ্র্যপীড়িত, বর্বর, কলহবিবাদে লিপ্ত, অশ্লীল জীবনাচারে অভ্যস্ত জাতিটিকে একটি সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিল। তারা অতি অল্প সময়ে অর্থনৈতিক, সামরিক, জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং যুগে যুগে শাস্ত্রের বিধান যে সর্বদাই সত্যযুগের সৃষ্টি করে সেটাই বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
আল্লাহর শেষ রসুলের উপর অবতীর্ণ কোর’আন আজও অবিকৃত আছে, কিন্তু তাঁর শিক্ষাগুলিকে পরবর্তী যুগের অতি-বিশ্লেষণকারী আলেম, ফকীহ, মোফাসসেররা যথারীতি বিকৃত করে ফেলেছেন। তাদের সৃষ্ট মতবাদ ও লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েলের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে অগণিত ফেরকা, মাজহাব, তরিকা। তারা একদা ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন। তাদের কাজের ফলে মুসলমান নামের জাতিটি আজ চরম অশান্তিতে পতিত। যারা নিজেরাই আছে চরম অশান্তির মধ্যে তারা কী করে অন্য জাতিকে শান্তি দেবে?
সাম্প্র্রদায়িক অনৈক্য ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রের বিষফল
ইংরেজরা আসার আগে সাতশত বছর মুসলিমরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে এ অঞ্চলে সিংহাসন নিয়ে যুদ্ধ অনেক হয়েছে কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার একটিও উদাহরণ নেই। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সভ্যতার লীলাক্ষেত্র ভারতবর্ষের অতুল সম্পদরাশি লুট করার জন্যই বণিকের বেশে আগমন করেছিল পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ও ইংরেজরা। ইংরেজরা কীভাবে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষকে ভিক্ষুকের দেশে পরিণত করেছিল, কিভাবে তারা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষকে ভাতের অভাবে মরতে বাধ্য করেছিল, কিভাবে তাদেরকে শিয়াল শকুনের খাদ্যে পরিণত করেছিল- সে এক হৃদয়বিদারক ইতিহাস।
তাদেরই চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম আমাদের মনুষ্যত্ব কেড়ে নিয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এই জাতির চারিত্রিক মেরুদণ্ড তারা ভেঙ্গে দিয়েছে। জাতিকে হীনমন্যতায় আপ্লুত গোলাম বানিয়ে দিয়েছে। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা নিজেদেরকে পশ্চিমাদের থেকে নিকৃষ্ট ভাবতে শিখেছে, ছাত্রসমাজ পরিণত হয়েছে সন্ত্রাস-বাহিনীতে।
তাদের চাপিয়ে দেয়া সিস্টেম মানুষকে সুদ, ঘুষ, খাদ্যে ভেজাল, রাজনৈতিক রক্তারক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সৎ মানুষকে অসৎ হতে বাধ্য করছে। নারীকে করা হয়েছে ভোগ্যপণ্য, দিকে দিকে কেবল নির্যাতিতা, ধর্ষিতার হাহাকার। আর এই নিজেদের তৈরি করা নরকে বসে ব্রিটিশপ্রবর্তিত ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির মানুষ সকল শান্তির উৎস ধর্মকেই গালাগালি করছে।
বিকৃত এসলামের ধর্মব্যবসায়ীরা কথায় কথায় অন্য ধর্মের উপাস্য ও মহামানবদের অমর্যাদা করে কথা বলেন। অথচ এঁরা যে আল্লাহর নবীও হতে পারেন এটা তাদের ধারণারও বাইরে। একইভাবে মুসলিম ছাড়া অনেকেই এটা স্বীকার করেন না যে, মোহাম্মদ (দ:) নবী ছিলেন। তাই তাঁর ব্যাপারে ঘৃণাবিদ্বেষ ছড়াতে, কার্টুন আঁকতে বা চলচ্চিত্র বানাতে তাদের হৃদয়ে কোনো গ্লানি অনুভব করেন না। তাদের এসব কাজের ফলে সৃষ্টি হয় ক্ষোভের, পরিণতিতে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক ভাইয়ের নির্যাতনের শিকার হয়ে আরেক ভাই পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমান।
“ডিভাইড এ্যান্ড রুল অর্থাৎ ঐক্যহীন করে শাসন করো” এই ছিল ব্রিটিশদের নীতি। তারা নিজেদের শাসন ও শোষণ টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতবর্ষে হিন্দু- মুসলমান শত্রু তার সৃষ্টি করেছিল। যখন শোষণ করার মত আর সম্পদ অবশিষ্ট ছিল না, তখন তারা স্বাধীনতা দেওয়ার নাম করে বিদায় নিয়েছে, কিন্তু সেই যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তারা তৈরি করে রেখে গেছে সে বিদ্বেষ আজও আমরা রক্তকণিকায় বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।
আর আমাদের কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যারা প্রকৃতপক্ষে সেই ব্রিটিশদের প্রেতাত্মা তারা এই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ব্যবহার করে ভোটের যুদ্ধে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করে যাচ্ছেন। তাই অধিকাংশ ধর্মীয় দাঙ্গার পেছনে মূল কারণ থাকে রাজনৈতিক। মায়ানমারে বৌদ্ধরা হাজারে হাজারে জীবিত মানুষ পুড়িয়ে মারছে, আর এদেশে মুসলমানেরা ভাঙছে বৌদ্ধ মন্দির, তালেবানরা আফগানে ভাঙছেন বৌদ্ধমূর্তি, চীনে মুসলমানদের দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। খ্রিস্টানরা পোড়াচ্ছে কোরান, প্রতিবাদে মুসলমানেরা চালাচ্ছে আত্মঘাতী হামলা। ভারতে মসজিদ ভাঙা হচ্ছে, প্রতিবাদে এদেশে ভাঙা হচ্ছে মন্দির। আমরা যাঁদের অনুসারী- সেই বুদ্ধ (আ:), ঈসা (আ:), শ্রীকৃষ্ণ (আ:), মোহাম্মদ (দ:)- তাঁরা কি চান আমরা এভাবে একে অপরের রক্তে স্নান করি? না, তারা চান না। তবু তাদের নামেই চলছে এই রক্তের হোলি খেলা, পৈশাচিক নারকীয়তা। একবার ভেবে দেখুন আমাদের সবার বাবা মা আদম হাওয়ার কথা। আমরা- তাঁদের সন্তানেরা এই যে ধর্মের নামে শত সহস্র বছর ধরে একে অপরের রক্ত ঝরাচ্ছি, এই দৃশ্য দেখে তাদের হৃদয় কী অপরিসীম যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হচ্ছে! এর চেয়ে মূর্খতা আর কী হতে পারে যে, আমরা একই বাবা মায়ের সন্তান হয়েও একে অপরকে অপবিত্র মনে করি? আচারের নামে এইসব অনাচার ধর্মের সৃষ্টি নয়, ধর্মব্যবসায়ীদের সৃষ্টি।
ধর্ম যেন বিকৃত না হতে পারে সেজন্য, আল্লাহ সর্বকালেই ধর্মের বিনিময় গ্রহণকে হারাম করেছেন। প্রায় সকল নবীই জাতির উদ্দেশে একটি সাধারণ কথা বলেছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। পবিত্র কোরানে আল্লাহ নুহ অর্থাৎ মনু (আ:), লুত (আ:), শোয়াইব (আ:), সালেহ (আ:), হুদ (আ:), সর্বোপরি মোহাম্মদ (দ:) এর এই ঘোষণাগুলি উল্লেখ করেছেন।
(সুরা হুদ-২৯, ৫১, সুরা শু’আরা ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪, ১৮০, সুরা ইউনুস – ৭২, সুরা ইউসুফ-১০৪, সুরা সা’দ-৮৬, সুরা আনআম- ৯০, সুরা শুরা- ২৩, সুরা মো’মেনুন: ৭১-৭২, সুরা তুর: ৪০)
আল্লাহ আরো বলেছেন, “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে আর কিছুই ঢুকায় না। আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না, বস্তুতঃ তাদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। এরাই হল সে সমস্ত লোক, যারা সঠিক পথের বিনিময়ে পথভ্রষ্টতা ক্রয় করেছে। ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে শাস্তি ক্রয় করেছে, অতএব, আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল। তাদের এই পরিণাম এজন্য যে, আল্লাহ নাযিল করেছেন সত্যপূর্ণ কিতাব। কিন্তু তারা সেই কেতাবের বিষয়গুলি নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি করেছে। নিশ্চয়ই তারা অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। (সুরা বাকারা ১৭৫-১৭৬)।
সকল ধর্মের মত সনাতন ধর্মেও ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ। মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে: ‘যজ্ঞের জন্য শূদ্রের নিকট ধন ভিক্ষা করা ব্রাহ্মণের কখনও কর্তব্য নয়। কারণ যজ্ঞ করতে মৃত্যুর পর প্রবৃত্ত হ’য়ে ঐভাবে অর্থ ভিক্ষা করলে চণ্ডাল হ’য়ে জন্মাতে হয়। যে ব্রাহ্মণ যজ্ঞের জন্য অর্থ ভিক্ষা করে তার সমস্তটা ঐ কাজে ব্যয় করে না, সে শত বৎসর শকুনি অথবা কাক হ’য়ে থাকে।’ (মনুসংহিতা ১১:২৪-২৫)
ঈসা (আ:) পূর্ববর্তী ইহুদি ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি একদিন বায়তুল মোকাদ্দাসে দাঁড়িয়ে উপস্থিত লোকজন এবং ধর্মগুরুদের উদ্দেশে বলেন,
“আলেম ও ফরীশীরা শরীয়ত শিক্ষা দেবার ব্যাপারে মুসা (আ:) এর জায়গায় আছেন। সুতরাং এরা যা কিছু করতে আদেশ করেন তোমরা তা পালন করো। কিন্তু তাঁরা যা করেন সেটা তোমরা অনুসরণ করো না, কারণ তাঁরা মুখে যা বলেন কাজে তা করেন না। তাঁরা ভারী ভারী বোঝা মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দেন, কিন্তু সেগুলো সরাবার জন্য নিজেরা একটা আঙ্গুলও নাড়াতে চান না। তাদের সব কাজই লোক দেখানোর জন্য। দাওয়াতের সময় এবং উপাসনালয়ে তারা সম্মানজনক আসনে বসতে ভালোবাসেন। হাটে-বাজারে তারা সম্মান খুঁজে বেড়ান আর চান যেন লোকেরা তাদের প্রভু বা রাব্বাই বলে ডাকে। কিন্তু কেউ তোমাদেরকে প্রভু বলে ডাকুক তা তোমরা চেয়ো না, কারণ তোমাদের প্রভু বলতে কেবল একজনই আছেন। আর তোমরা সবাই ভাই ভাই।
ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, কী নিকৃষ্ট আপনারা! আপনারা মানুষের সামনে জান্নাতে প্রবেশের দরজা বন্ধ করে রাখেন। তাতে নিজেরাও ঢোকেন না আর যারা ঢুকতে চেষ্টা করছে তাদেরও ঢুকতে দেন না। একদিকে আপনারা লোকদের দেখাবার জন্য লম্বা লম্বা মোনাজাত করেন, অন্য দিকে বিধবাদের সম্পত্তি দখল করেন।
ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, কী ঘৃণ্য আপনারা! আপনারা পুদিনা, মৌরি আর জিরার অংশ আল্লাহকে ঠিকঠাক দিয়ে থাকেন; কিন্তু আপনারা মুসা (আ:) এর শরীয়তের অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে বাদ দিয়েছেন। যেমন সুবিচার, দয়া এবং সততা। আপনাদের উচিৎ আগে এইগুলি পালন করা এবং অন্য বিধানগুলিকেও বাদ না দেওয়া। আপনারা নিজেরাই অন্ধ অথচ অন্যদের পথ দেখান। একটা ছোট মাছিও আপনারা ছাঁকেন অথচ উট গিলে ফেলেন।
ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, ঘৃণ্য আপনারা। আপনারা বাসনের বাইরের দিকটা পরিষ্কার করে থাকেন, কিন্তু পাত্রের ভিতরে আছে কেবল সেই নোংরা জিনিস যা মানুষের উপর জুলুম আর স্বার্থপরতা দ্বারা আপনারা লাভ করেছেন। অন্ধ ফরীশীরা, আগে পাত্রের ভিতরের ময়লাগুলি পরিষ্কার করুন, তার বাইরের দিকটা আপনিই পরিষ্কার হবে।
ভণ্ড আলেম ও ফরীশীরা, কী জঘন্য আপনারা! আপনারা সাদা ঝকঝকে রং করা কবরের মত, যার বাইরে থেকে দেখতে খুবই সুন্দর কিন্তু তার ভেতরে আছে মরা মানুষের হাড়-গোড় ও পঁচা গলা লাশ। ঠিক সেইভাবে, বাইরে আপনারা লোকদের চোখে ধার্মিক কিন্তু ভিতরে মোনাফেকী আর পাপে পরিপূর্ণ।
হে সাপের দল আর সাপের বংশধরেরা! কিভাবে আপনারা জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবেন?” (নিউ টেস্টামেন্ট: ম্যাথু ২৩ : ১-৩৪)
ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আল্লাহ এত কঠোর অবস্থানে থাকলেও প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই শ্রেণিটির জন্ম হয়েছে এবং তারা সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশ্রিত করে ধর্মকে দূষিত করে ফেলেছে এবং ধর্মকে মসজিদ-মন্দিরকেন্দ্রিক করে ফেলেছে। স্রষ্টা কি শুধু মসজিদ মন্দিরে চার্চে প্যাগোডায় থাকেন? না। তিনি বলেছেন, ‘আমি ভগ্ন-প্রাণ ব্যক্তিদের সন্নিকটে অবস্থান করি।’ ‘বিপদগ্রস্তদেরকে আমার আরশের নিকটবর্তী করে দাও। কারণ আমি তাদেরকে ভালোবাসি।’ (হাদিসে কুদসী, দায়লামী ও গাজ্জালী)।
অথচ ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষের ভালোমন্দের চিন্তা না করে উপাসনালয় সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যাপৃত থেকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত আছেন।
জান্নাতে, স্বর্গে কারা যাবেন?
সকল ধর্মের, সকল মাজহাবের উপাসকেরা বিশ্বাস করেন যে কেবলমাত্র তারাই সঠিক, আর সবাই পথভ্রষ্ট। সুতরাং জান্নাতে, স্বর্গে বা হ্যাভেনে কেবল তারাই যাবেন। আসলে কি তাই? বরং সকল ধর্মের শিক্ষা হচ্ছে জান্নাতে বা স্বর্গে ঠাঁই পাবেন তারা, যারা একমাত্র স্রষ্টার বিধানে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নিজেদের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে মানবতার কল্যাণে কাজ করে যায়।
নামাজ, রোযা, উপবাস, উপাসনা ধর্মের মূল বিষয় নয়। স্রষ্টা মানুষের কাছে খানা-খাদ্য চান না, তাঁকে ভোগ দিয়ে লাভ নেই। বরং এই দুধ কলা যদি ক্ষুধার্তকে দেওয়া হয় তাতেই তিনি খুশি হন। মানুষের পেটে যখন ভাত নেই, উপাসনালয় থেকে যখন জুতা চুরি হয়, যেখানে দুই বছরের শিশুও ধর্ষিত হয় সেখানে যারা মসজিদে-মক্কায়-বেথেলহেমে গিয়ে মনে করছেন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট, গয়া-কাশিতে গিয়ে মনে করছেন দেবতা বুঝি স্বর্গ থেকে তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করছেন, তারা ঘোর ভ্রান্তির মধ্যে আছেন। কারণ স্রষ্টার এসবের দরকার নেই। তিনি বলেছেন,
‘পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে তোমাদের মুখ ফিরানোতে কোন পুণ্য নেই। বরং পুণ্য আছে তাদের জন্য যারা আল্লাহর উপর, কেয়ামত দিবসের উপর, মালায়েকদের উপর এবং নবী-রসুলগণের উপর ঈমান আনবে, আর আল্লাহকে ভালোবেসে স¤পদ ব্যয় করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও দাসমুক্তির জন্যে।’ (সুরা বাকারা ১৭৭)।
কেবল তাদের উপাসনাই আল্লাহ কবুল করেন যারা নিরন্তর মানুষের কল্যাণে কাজ করে যায়। রসুলাল্লাহ বলেন, “যারা সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রত থাকে আল্লাহ তাদের দোয়া এমন ভাবে কবুল করেন যেরূপ ভাবে তিনি রসুলদের দোয়া কবুল করেন।” (হাদীসে কুদসী, জুমানাহ বাহেলী থেকে আবুল ফাতাহ আযদী)
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “কেহ ধার্মিক কি অধার্মিক পরীক্ষা করিতে হইলে দেখিতে হইবে, সে ব্যক্তি কতদূর নিঃস্বার্থ। যে অধিক নিঃস্বার্থ সে অধিক ধার্মিক। (রামেশ্বর-মন্দিরে প্রদত্ত বক্তৃতা)।
বুদ্ধ (আ:) বলেছিলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যে ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্ত্যে কল্যাণ।’
সুতরাং কেবল ধ্যান করে দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ নয়, মানুষের সমষ্টিগত কল্যাণই ছিল বুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য।
একইভাবে ঈসা (আ:) ইহুদিদের প্রার্থনার দিন তওরাতের বিধান লঙ্ঘন করে অন্ধ, রুগ্ন, খঞ্জকে সুস্থ করে তুলেছেন।’ (নিউ টেস্টামেন্ট: মার্ক ৩, লুক ১৪)।
সাবাথের দিনে মানুষকে সুস্থ করা ছিল ধর্মজীবীদের দৃষ্টিতে অপরাধ। এজন্য তাঁর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও রাষ্ট্রশক্তিকে উস্কিয়ে দিয়ে তাঁকে হত্যা করে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে।
এভাবেই সকল রসুল ও অবতার শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই ধর্ম বলে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তাই ওঙ্কার ধ্বনীর অর্থ শান্তি, এসলাম শব্দের অর্থও শান্তি, আবার বৌদ্ধ ধর্মেরও মূল লক্ষ্য ‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্ত- জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।’ যে ধর্ম মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, সেটা আত্মাহীন ধর্মের লাশ। প্রদীপের শিখা নিভে গেলে সেটা আর আলো দিতে পারে না, দিতে পারে শুধু কালি। তাই আজ সারা বিশ্বে যে ধর্মগুলি চালু আছে সেগুলোর বিকৃত অনুসারীরা মানুষকে আলোকিত করার বদলে কালিমালিপ্ত করছে, শান্তির বদলে বিস্তার করছে সন্ত্রাস।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলতে হয়। অবতারগণের বিদায় নেবার পর তাঁদের অনুসারীরা অনেক ক্ষেত্রেই অতি ভক্তির প্রাবল্যে তাঁকে ক্রমশঃ ঊর্দ্ধে উঠাতে উঠাতে স্বয়ং স্রষ্টার আসনে বসিয়ে দিয়েছেন অথবা স্রষ্টাই নবীর মূর্তিতে সশরীরে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বাস ও প্রচার করেছেন।
আমরা মনে করি, তাঁরা স্বয়ং স্রষ্টা হোন, অবতার হোন আর ঈশ্বরের পুত্রই হোন তাঁদের জীবনের যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা, সেই উদ্দেশ্য আমরা কতটুকু পূরণ করতে পারলাম সেটাই অধিক বিবেচনার দাবি রাখে।
মানবজাতির ঐক্যসূত্র
আমরা কাউকে কোন বিশেষ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট করছি না। আমাদের কথা হচ্ছে, আমরা সকলেই যদি শান্তি চাই, সকলেই যদি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিময় পৃথিবী উপহার দিতে চাই, তবে এজন্য আমাদেরকে সকল প্রকার বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এ কথাতে নিশ্চয়ই আপনারা সবাই একমত হবেন? কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবো কিসের ভিত্তিতে? সেটাই আজ খুঁজে বের করতে হবে।
আমাদের সকলের স্রষ্টা এক, একই পিতা-মাতার রক্ত আমাদের সবার দেহে। সকল নবী-রসুল-অবতারগণও এসেছেন সেই এক স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তাই শান্তি পেতে হলে আমাদেরকে স্রষ্টার হুকুমের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদেরকে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র চাপিয়ে দেওয়া তন্ত্রমন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, সর্বপ্রকার ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সকল প্রকার সন্ত্রাস, হানাহানির বিরুদ্ধে এবং সকল ন্যায় ও সত্যের পক্ষে।
আল্লাহর শেষ রসুলও সকল জাতির উদ্দেশে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “গ্রন্থের অধিকারী সকল সম্প্রদায়, একটি বিষয়ের দিকে এসো যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক, তা হল- আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও এবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন অংশীদার সাব্যস্ত করব না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রভু বলে মানবো না (সুরা এমরান ৬৪)”।
অতএব, আসুন, আমরা কোন কোন বিষয়ে আমাদের মিল আছে সেগুলি খুঁজে বের করি, অমিলগুলো দূরে সরিয়ে রাখি, বিচ্ছেদের রাস্তা না খুঁজে সংযোগের রাস্তা খুঁজি। আজকে যারা ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে বিভেদের মন্ত্র শেখায়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বিস্তার করে তারা আল্লাহর উপাসক নয়, তারা শয়তান বা আসুরিক শক্তির উপাসক। এদের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকা আবশ্যক।
যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের উদ্দেশে আমাদের কথা হচ্ছে, ‘নিঃসন্দেহে মানুষের কল্যাণই আপনাদের জীবনের ব্রত। সকল ধর্মের উদ্দেশ্যই তাই। সুতরাং, আমরা যে যেই দলই করি না কেন, আজ মানবতা যখন বিপন্ন, আমাদের সকলের অস্তিত্ব যখন সঙ্কটে, তখন নিজেদের মধ্যকার যাবতীয় ভেদাভেদ ভুলে, নিজেদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আপাততঃ স্থগিত রেখে ঐক্যবদ্ধ হই। মানুষের জন্যই রাজনীতি, আগে মানুষকে বাঁচাই। যারা এসলামকে ভালোবাসেন তারাও আসুন, একে অপরের ত্র“টি সন্ধান না করে, ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করে এক স্রষ্টার বিধানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের উপর ঐক্যবদ্ধ হই।’
কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে আবার মানবজাতির সামনে তুলে ধরেছেন এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তিনি ভারতবর্ষে আগত কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, বুদ্ধ প্রমুখ নবীদের নামের শেষে সম্মানসূচক ‘আলাইহে আস সালাতু আস সালাম’ ব্যবহার করেছেন; এর দ্বারা তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ ও মুসলিমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক প্রাচীরের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছেন। এজন্য তাঁকে ধর্মব্যবসায়ী আলেম-মোল্লাদের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তাঁর লেখা বই পোড়ানো হয়েছে, তাকে কাফের, খ্রিস্টান অর্থাৎ ধর্মত্যাগী ফতোয়া দেওয়া হয়েছে, এমন কি এজন্য তাঁকে মিথ্যা মামলারও শিকার হতে হয়েছে; তবু তিনি সত্যের উপর ছিলেন অবিচল। এ উপমহাদেশের ইতিহাসে তাঁর পূর্বপুরুষদেরও রয়েছে বিরাট ভূমিকা। ১৫৭৬ পর্যন্ত পন্নী পরিবার ছিলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সহ বৃহত্তর গৌড়ের শাসক। এদেশের শাসনে, সংস্কৃতিতে, শিক্ষাবিস্তারে তাঁদের বিরাট অবদান রয়েছে। মাননীয় এমামুয্যামান সর্বপ্রকার অনৈক্যের দেয়াল ভেঙ্গে সমগ্র মানবজাতিকে এক পরিবারে পরিণত করার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি কোরান, বাইবেল, বেদ, ত্রিপিটক, তওরাত, গীতা সকল ঐশী গ্রন্থগুলিকে বইয়ের শেলফে একই সঙ্গে রাখতেন। বলতেন, ‘এগুলি সবই আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। কিন্তু আজকে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ইহুদি-খ্রিস্টান কেউই তাদের ধর্মগ্রন্থের অনুসরণ করছে না।’
সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যেমন বিশ্বাস করেন যে, সত্যযুগ আবার আসবে (বিষ্ণুপুরাণ), মুসলমানরাও বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ পৃথিবীকে এমন ন্যায় ও শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দিবেন ঠিক ইতিপূর্বে পৃথিবী যেমন অন্যায় ও অশান্তিতে পরিপূর্ণ ছিল (আবু দাউদ)। আর বাইবেলে পাই কিংডম অব হ্যাভেনের আগমনী বার্তা যখন কিনা নেকড়ে ও ভেড়া একত্রে বিচরণ করবে (নিউ টেস্টামেন্ট: ঈসাইয়াহ ১১:৬)।
এখন প্রশ্ন হল সেই সত্যযুগ বা বুদ্ধ (আ:) এর কাক্সিক্ষত সর্বসত্তার সুখলাভের সেই রাজ্য অথবা কিংডম অব হ্যাভেন আসবে কী ভাবে? এটা কি এমনি এমনিই আসবে? না। শান্তি বা অশান্তি মানুষের কর্মফলমাত্র। পবিত্র আত্মা ঈসা (আ:) ও এ কথাই বলেছিলেন, The kingdom of heaven is at hand. (Matthew 10:7)- হাতের মুঠোয়। কিভাবে? সেটা বলা হয়েছে মহাভারতে, “রাজা যখন দণ্ডনীতির অনুসারে সুচারুরূপে রাজ্যপালন করেন, তখনই সত্যযুগ নামে শ্রেষ্ঠ কাল উপস্থিত হয়। ঐ কালে বিন্দুমাত্রও অধর্ম্মসঞ্চার হয় না।” (কালী প্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬০৭)।
সত্যযুগ প্রতিষ্ঠার সেই পথের দিকেই মানবজাতিকে আহ্বান করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট হলে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিপাদ্য বিষয়ের মূল প্রবন্ধ।