যখন প্রকৃত ধর্ম হারিয়ে যায়, মানুষ তওহীদ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যে কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করেন মানুষকে আবার তওহীদে ফিরিয়ে আনার জন্য। এই মনোনয়ন আল্লাহ কাকে করবেন সেটা আল্লাহর এখতিয়ারে।
হেযবুত তওহীদের এমামের সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকে বলেন, ইসলাম শিখতে হলে কি এখন মুচির কাছে যেতে হবে? রোগের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ডাক্তার ছাড়া যেমন রোগীর রোগ ভালো হয় না তেমনি ইসলাম শিখতে হলে যারা মাদ্রাসায় পড়ে মওলানা, মুফতি তাদের কাছে যেতে হবে। এটা দ্বারা তারা বোঝাতে চান যে, নির্দিষ্ট লেবাসধারী শ্রেণী ব্যতীত আর কারো ইসলামের কথা বলার অধিকার নাই। এই কথাটার মধ্যে একটা চরম অহংকার লুকায়িত আছে।
এই ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য এই যে, ইসলাম শিখতে যদি মুচির কাছে যেতে হয় তবে তাই যাবে। এই কথাটিই ঈসা (আ.) এর সময় বলেছিল, তিনি যখন সত্যের প্রচার শুরু করছিলেন আলেমরা অহংকার করে বলতেন যে, এখন কি ছুতোর মিস্ত্রীর কাছে আমাদের ধর্ম শিখতে হবে?
শেষ নবী রসুলে পাক (সা.)- কেও বলা হতো যে তিনি লেখাপড়া জানেন না, মক্কায় কত বড় বড় পুরোহিত ধর্মযাজক থাকতে তার কাছে আমাদের ইসলাম শিখতে হবে? এটা হলো জাহেল, কাফের, দুরাচারী, স্বৈরাচারী ইবলিসের দোসরদের অহংকার। ইবলিসের একটাই অন্যায় ছিল যে, সে আল্লাহর হুকুম অমান্য করে নিজেকে ঠিক বলে ভেবে নিয়েছিল। আমাদের কথা হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে সত্য যে বলুক না কেন, সে কোন পোশাক পড়ে, কোন প্রতিষ্ঠানের, শিক্ষিত না মূর্খ অথবা জুতা সেলাই করেন নাকি কাপড় সিলাই করেন কোন চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। মানুষের মর্যাদা তার পেশা, পোশাক দিয়ে মাপা যায় না। প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আল্লাহর রসুল (স.) কে আল্লাহ কোর’আনে আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল প্রসঙ্গে বলছেন, “এরপর তার চিত্ত তাকে ভ্রাতৃহত্যায় উত্তেজিত করল। ফলে সে (কাবিল) তাকে হত্যা করল; তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। [সুরা আনআম, আয়াত ২৭-২৯]। নিজ ভাই হাবিলকে হত্যার পর সে অনুতপ্ত হলো এবং নিজের অপকর্ম কীভাবে ঢাকবে, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। তখনো মৃতদেহ সৎকারের ব্যাপারে কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি, কারণ এর আগে কোন মানুষের মৃত্যু ঘটেনি। মৃতদেহটিকে নিয়ে কী করবে এ নিয়ে যখন সে চিন্তায় মগ্ন তখন দেখল, একটি কাক আরেকটি কাককে হত্যা করল। তারপর সে তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে একটি গর্ত করল। তারপর সেই গর্তে মৃতু কাকটিকে টেনে এনে কবর দিয়ে দিল। এটি দেখে কাবিল ভাবলো, তাকেও হয়তো এভাবে কবর দিতে বলা হচ্ছে। তাই একটি গর্ত করে সে তার ভাইকে কবর দিয়ে দিল। ইসলামের ইতিহাস অনুসারে এটিই ছিল মানবজাতির প্রথম কবর। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, মানবজাতির শুরুতেই থেকে কবর পর্যন্ত শিখতে হলো একটি কাক থেকে।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুর সিংহাসনে বসলেন। রাজত্বের পঁয়ত্রিশ বছর পূর্ণ হলে অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিতকে রাজ্যভার দিয়ে তিনি ভাইদের সঙ্গে স্ত্রী দ্রৌপদীকে সাথে নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করলেন। একটি কুকুর তাঁদের সঙ্গ নিল। যেতে যেতে দ্রৌপদী সহদেব নকুল অর্জুন ও ভীম- সবাই একে একে মারা গেলেন। শেষে দেবরাজ ইন্দ্র রথ নিয়ে এলেন যুধিষ্ঠিরকে জীবিত অবস্থায় স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। যুধিষ্ঠির বললেন যে, দ্রৌপদী ও ভাইদের না নিয়ে তিনি স্বর্গে যাবেন না। ইন্দ্র তাঁকে আস্ব¯— করলেন যে, স্বর্গে তাঁরা থাকবেন। যুধিষ্ঠির তখন কুকুরটিকে নিয়ে রথে উঠতে চাইলেন। ইন্দ্র তাতে আপত্তি জানালে যুধিষ্ঠির বললেন যে ভক্ত কুকুরটিকে ছেড়ে তিনি যাবেন না। তখন কুকুর-রূপী ধর্ম তাঁর স্বরূপ ধারণ করে যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করলেন। আসরে কুকুরটি ছিল তার জন্য পরীক্ষা।
পৃথিবীর সর্ব চৌকস সেনাবাহিনী শক্তিশালী, গোয়েন্দা সংস্থা নিজেদের জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হতে না পেরে তারা নির্ভর করছে ডগ স্কোয়াডের উপরে। ব্রিটিশ আর্মির একটি কুকুর আফগানিস্তানে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভিক্টোরিয়া ক্রস অর্থাৎ একটি উচ্চস্তরের পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এখানে মানুষের সকল জ্ঞানের অহঙ্কার নিঃশেষ হয়ে যায়। একজন খুনীকে এক কোটি লোকের মধ্য থেকে খুঁজে বের করতে সক্ষম একটি প্রশিক্ষিত কুকুর, অথচ মানুষ দুজনের মধ্য থেকেও কে অপরাধী তা বের করতে সক্ষম হয় না। কাজেই মানুষের অহংকার করা সাজে না। একজন মুচি তো সে হিসাবে অনেক উচ্চ পর্যায়ের। মুচি বলে কি তার কোনো জ্ঞান থাকতে নেই?
যারা নাক সিঁটকিয়ে বলেন, শেষ পর্যন্ত মুচির কাছ থেকে ইসলাম শিখতে হবে- তাদেরকে বলব, মুচি তো উচ্চশ্রেণির মানুষই। ও মুচি বলে কি তার কোন জ্ঞান থাকতে নেই। এখন যদি বাটা কোম্পানির কোনো কর্তাব্যক্তি বা মালিক আসেন তাহলে কি আপনারা তাকে সম্মান না করে পারবেন? তিনিও তো পাদুকা নির্মাণকারীই।
হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, কুকুরের মধ্যে এমন দশটি স্বভাব পাওয়া যায়, যেগুলো মানুষের মধ্যে পাওয়া গেলে ভালো হত। দশটা শিক্ষার এক নম্বরটা হলো: কুকুর প্রচণ্ড প্রভুভক্ত, মো’মেন বান্দারাও তার প্রভুর ভক্ত হবে। দুই নম্বর হলো কুকুর কম খেয়ে অথবা অভুক্ত থেকে দিনের পর দিন কাটায় কিন্তু অভিযোগ করবে না। তেমনি মো’মেনও দারিদ্র্য, অনাহারে অভিযোগ না করে সবর করবে। কুকুর রাতের পর রাত জেগে মালিকের বাড়ি পাহারা দেয় তেমনি মো’মেনদেরও কম ঘুমিয়ে রাতে তার প্রভুর ইবাদত বন্দেগী করে কাটাতে হবে। এমনি করে একে একে সকল ক্ষেত্রে কুকুরের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে। আমরা যদি কুকুর আর কাকের কাছ থেকে শিখতে পারি তাহলে যে কোনো মানুষ থেকে শেখা তার চেয়ে ভালো। সেই মানুষ যদি মুচিও হয়, মেথরও হয় তার ভেতর আল্লাহর রুহ রয়েছে, সেও আল্লাহর প্রতিনিধি, খলিফা। কুকুর, কাক যদি মানুষকে শিক্ষা দিতে পারে তাহলে মানুষ হয়ে একজন মানুষের থেকে কেন শিক্ষা নেয়া যাবে না?
এই মূর্খতার প্রসার হয় কখন? যখন ধর্ম যখন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী, পেশার মানুষের হাতে পুঞ্জীভুত হয়ে গেল তখন ইসলামের কথা বলার অধিকার আর সাধারণ মানুষের রইল না। ধর্ম হয়ে গেল ধর্মজীবীদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার। এই মানসিকতা যখন মুসলমানদের ভেতর ঢুকলো তখনই মানুষ তার সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে ছিটকে পড়ল, তাদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হলো, তাদের মগজ তালাবদ্ধ হয়ে গেল, তাদের আক্কেল চলে গেল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অজ্ঞতাই অহঙ্কারের আকর। এ কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞরা নিজেদের আলেম জ্ঞান করে অহংকারী হয়ে গেল। দাড়ি, টুপি, হায়েজ-নেফাসের ফতোয়ার জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে তারা মনে করল তাদের চেয়ে মহাজ্ঞানী আর কেউ নেই, তাই তাদের আর কারো থেকে শেখার প্রয়োজন নেই। বরং জগৎবাসীর ইসলাম শিখতে হলে তাদের কাছেই ধর্না দিতে হবে। অথচ আল্লাহ রব্বুল আলামিন তার সমস্ত জ্ঞানকে তার সমস্ত সৃষ্টির সকল উপাদানের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন। তাহলে অহংকার করার আসলে কোনো জায়গা নেই।