হেলাল উদ্দিন
প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মধ্যেই প্রতিফলন ঘটে একটি জাতির নিজস্বতা, রুচি-অভিরুচি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা, জীবনবোধ, নীতিনৈতিকতা সককিছুর। একটি জাতিকে পদানত করার সর্বাধুনিক পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, অর্থাৎ যে কোন উপায়ে একটি জাতির উপরে অন্য একটি জাতির সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে চিন্তা চেতনার উপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই সেই জাতির লোকেরা মানসিকভাবে, চিন্তা চেতনায় দাসত্ব বরণ করে নেবে। যারা অন্যজাতির সাংস্কৃতিক দাস, চিন্তার দাস তাদেরকে দেশ আক্রমণ করে সরাসরি দাস বানানোর দরকার পড়ে না, তারা চেতনে-অবচেতনেও প্রভুজাতির আনুগত্যে নিষ্ঠাবান থাকে। পাশ্চাত্য সভ্যতার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং আকাশ-সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে তারা প্রায় সারা পৃথিবীর মানুষকেই একটি অশ্লীলতানির্ভর জড়বাদী জীবনব্যবস্থা ও সংস্কৃতির দূষিত সাগরে বিলীন করে দিচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে মানুষ স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে সেই অপসংস্কৃতিকে মাথায় তুলে নিচ্ছে, ফলে যুবসমাজ হয়ে পড়ছে আদর্শহীন, চরিত্রহীন, ভোগী ও অর্থবিলাসী এবং চরম আত্মকেন্দ্রীক। ইসলামের বিরোধিতা, অশ্লীলতা, আনন্দ-উপভোগ আর উশৃঙ্খলতাই আধুনিকতার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারিবারিক বন্ধনগুলি আলগা হয়ে যাচ্ছে, বিস্তার লাভ করছে নেশাদ্রব্য, মরণব্যধী ছড়িয়ে পড়ছে সমাজদেহের সর্বত্র। আজ আমাদের কাছে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকদের গায়ের রং থেকে শুরু করে পোশাক, ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, খাদ্যাভ্যাস, মতবাদ সবকিছুই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঔপনিবেশিক যুগে যখন আমরা সরাসরি তাদের দাস ছিলাম, তখনও সাংস্কৃতিক ও মানসিকভাবে আমরা এতটা দাস ছিলাম না। আজ আমরা ভুলেই গেছি যে, মুসলিম জাতির একটি নিজস্ব সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে যা আল্লাহ প্রদত্ত, একাধারে পবিত্র, উন্নত ও মহান। ইতিহাস বলে, ইসলামের স্বর্ণযুগে ইউরোপীয়রা যখন মুসলিমদের দিকে তাকাত, তাদের চোখে থাকত মুগ্ধতার দৃষ্টি, তারা ইসলামের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, কলা, স্থাপত্যবিদ্যা, নবতর উদ্ভাবন প্রভৃতির শিক্ষা অর্জন করে গর্ব অনুভব করত। কি সঙ্গীত, কি কাব্য, কি নতুন নতুন সুর রচনায়- কোথায় নেই তারা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল ধর্মীয় গানই লেখেন নি, অনেক বিষয়ে সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান লিখে গেছেন। সেসব আজও সমাদৃত। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজকে সঙ্গীত বৈধ কি অবৈধ, নৃত্য বৈধ কি অবৈধ তার প্রশ্ন উঠছে। কারণ এগুলো আজ সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও সাহিত্যের নামে, নৃত্যের নামে আজ অশ্লীলতা, বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে-অশ্লীলতার প্রসারে সমাজে অপরাধ বৃদ্ধি পায়, তাই তা বর্জনীয় হওয়াই সভ্যতার পরিচয়। কিন্তু এজন্য কাব্যকে, সঙ্গীতকে, নৃত্যকে, সাহিত্যকেই একচেটিয়াভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতার সামিল। মাথায় ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়, বরং সঠিক চিকিৎসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সেই শিক্ষকের জাতি মুসলিমরা আজ পশ্চিমা জাতিগুলির গোলামের চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই অবস্থার একটি বড় কারণ ইসলামের অপব্যাখ্যা। ধর্মজীবী আলেমরা ফতোয়ার ছুরি চালিয়ে মুসলিমের জীবন থেকে সঙ্গীত, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য নির্মাণ সবকিছুকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। তারা এগুলিকে একপ্রকার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। অথচ ইসলাম এগুলোর কোনটিই নিষিদ্ধ করে নি, নিষিদ্ধ করেছে এগুলির সঙ্গে অশ্লীলতার মিশেলকে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম কোন সত্য ও সুন্দর, মানুষের সুকোমল বৃত্তি, প্রতিভা, সুর, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদিকে অবৈধ বলে না। স্বয়ং স্রষ্টাই সুর ও নৃত্য সৃষ্টি করেছেন। শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল কোর’আনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দবদ্ধ করে। কেবল কোর’আন নয়, যবুর, গীতা, পুরান, ত্রিপিটক ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও কাব্যময়। গীতা শব্দের অর্থই তো গান। নৃত্য হচ্ছে শৃঙ্খলার অনুপম নিদর্শন। পাখি আকাশে ওড়ে- তাদের মধ্যে বিরাজ করে শৃঙ্খলা ও তাল। পাখির কণ্ঠে তিনিই সুর ও সঙ্গীত দান করেছেন। আযান ইসলামের এক অনন্য সঙ্গীত। সুতরাং যিনি সুরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি সেই সুরকে নাজায়েজ করতে পারেন না। নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড ও শিল্পকলা আল্লাহ কোথাও নিষেধ করেন নি। সুতরাং মানুষ যত খুশি গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পারে, কেউ বিকৃত ফতোয়ার চোখ রাঙানিতে তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ করতে পারে না। কাজেই আমাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে, সাধারণ ধর্মপ্রিয় মানুষের সামনে যদি ইসলামে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রকৃত রূপ তুলে ধরা যায় তাহলে ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়াবাজি দ্বারা সমাজকে সংস্কৃতিবিমুখ করার অপপ্রয়াস নস্যাৎ হবে।