রাকীব আল হাসান
লড়াইটা ধর্ম নিয়ে। ধর্মের ধ্বজা আলেম-পুরোহিত শ্রেণির হাতে। ধর্মকে মুছে ফেলার জন্য যে শ্রেণিটা এদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে সেটা হলো- পাশ্চাত্য বস্তুবাদী আত্মাহীন, স্রষ্টাহীন সভ্যতা তথা দাজ্জাল।
অর্থনীতিক শক্তি, সামরিক শক্তি, বিশ্বমিডিয়া, নব নব আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা শাস্ত্র, মহাকাশবিজ্ঞান, নৌবিদ্যা, অস্ত্র-সস্ত্র ইত্যাদি এক কথায় বর্তমান পৃথিবী যা দিয়ে চলছে তার সমস্ত কিছুই পাশ্চাত্যদের দখলে, সকল ক্ষেত্রে তারাই শ্রেষ্ঠ। মানুষ শক্তির পূজারী তাই তাদের পূজা করছে, তাদের অনুকরণ করছে। মানুষ নিজের চোখকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে, তাই তাদের আবিষ্কৃত বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে পারছে না, তাদের দৃশ্যত চাকচিক্যময়তাকে অস্বীকার করতে পারছে না, কাজেই তাদের জয়গান গাইছে।
পাশ্চাত্য নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছে বহু আগে, এখন তারা পৃথিবী থেকে বের হয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সকল ক্ষেত্রে নারীদের বিচরণের সুযোগ দিচ্ছে তারা। ফলে সারা পৃথিবীর নারীরা তাদের অনুকরণে এখন মহাকাশ পানে ছুটতে চায়। মানুষের দৃষ্টি স্বভাবগতভাবে ওপরের দিকে থাকে। পাশ্চাত্যরা যখন সকল ক্ষেত্রে প্রভুত্ব করছে, সব জায়গাতেই তারা যখন ঊর্ধ্বগামী তখন মানুষ তাদের অনুকরণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদি ইত্যাদি সকল ধর্মের সাধারণ মানুষ, ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষ, শিক্ষিত, চিন্তাশীল সকল শ্রেণির মানুষই আজ পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণ, অনুসরণ, পূজা করে চলেছে। সাধারণ মানুষের চোখে পাশ্চাত্য শ্রেণির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মজ্ঞানী আলেম-পুরোহিত একটা শ্রেণি। বাস্তবে পাশ্চাত্যদের প্রতিরোধ করার ন্যূনতম শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, ঐক্য, শৃঙ্খলা কোনোটাই তাদের নেই এবং তারা এই সভ্যতার কার্যত কোনো প্রতিরোধ তো করছেই না বরং অন্যদের মতোই আত্মসমর্পণ করে নিয়েছে কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেখানোর জন্য অনর্থক, অহেতুক মৌখিক বিরোধিতা করছে মাত্র। তাদের দৃশ্যত অবস্থা হলো- বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অতি সামান্য, বিজ্ঞান সম্পর্কে তারা প্রায় অজ্ঞ, অর্থনীতিক শক্তি, সামরিক শক্তি, তথ্য-প্রযুক্তি, মিডিয়া ইত্যাদি কোনোকিছুতেই তাদের কর্তৃত্ব নেই। তারা কেবল ধর্মের কিছু পুস্তক মুখস্থ করে সাধারণ (অধিকাংশই অশিক্ষিত, দরিদ্র শ্রেণির) মানুষকে নসিহত করতে ব্যস্ত। এর বিনিময়ে তাদের ক্ষুণ্নিবৃত্তির যোগান হয়। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে উদ্ভূত নানা রকম সমস্যার বাস্তব সমাধানও তারা ধর্ম থেকে দিতে অপারগ। তাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো- তারা দাড়ি কতটুকু রাখতে হবে, টুপির কেমন হবে, পাগড়ীর রং কেমন হবে, সুরা ফাতিহার শেষের শব্দটার উচ্চারণ দোয়াল্লিন নাকি জোয়াল্লিন হবে, মিলাদের মধ্যে রসুলাল্লাহর প্রতি দরুদ দাঁড়িয়ে পড়তে হবে নাকি বসে পড়তে হবে ইত্যাদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে নিজেরাই মতভেদে লিপ্ত, তারা শিয়া-সুন্নি, হানাফি-হাম্বলি-ফাফেয়ি-মালেকি ইত্যাদি মাজহাব-ফেরকা, মত-পথে বিভক্ত। মধ্যপ্রাচ্যে তো রীতিমতো শিয়া-সুন্নি একে অপরের রক্তে হোলি খেলছে, উভয়পক্ষেই বিরাট বিরাট আলেম, মুহাদ্দীস, মুফাস্সির, পীর, দরবেশ রয়েছেন। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে কাফের বলে গালি দেন, একে অন্যকে হত্যা করা ঈমানী দায়িত্ব মনে করে।
তাদের অনুসারী সাধারণ ঐ মানুষগুলোকে তারা এই চিন্তার মধ্যে নিমজ্জিত করে রেখেছে যে, দুনিয়ার যা হয় হোক, তোমরা কোনোমতে ধর্ম-কর্ম করে জীবনটা পার করে দাও, তাহলে আখেরাতের অনন্তকালের জীবনে শান্তি পাবে, জান্নাত পাবে, স্বর্গ পাবে, হ্যাভেন পাবে। যে নারীদেরকে পাশ্চাত্যরা মহাকাশে নিয়ে যাচ্ছে সেই নারীদেরকে তারা ঘরের বাইরে বের হতে দিতে চান না। নিতান্তই যদি ঘরের বাইরে বের হতেই হয় (না হাওয়াই ভালো) তবে তাকে এমনভাবে আবৃত করতে হবে যেন কেউ তার চুলের আগা, নখের ডগা বা চোখের তারাটিও দেখতে না পায়।
কেউ যদি তাদের এই মনগড়া ফতোয়াবাজির বেড়াজাল ছিন্ন করে পবিত্র কোর’আন এবং মহানবীর জীবনীর আলোকে দীনের অনুশীলন করতে চায় তাহলে তার ভাগ্যে জোটে নানা গালাগালি ও অধার্মিক, ধর্মবিদ্বেষী, মুর্তাদ, নাস্তিক, দালাল ইত্যাদি তকমা।
আপনি যতই ধর্ম-কর্ম পালন করেন না কেন যদি ধর্মের লেবাস না থাকে তাহলে আপনাকে ধার্মিক মনে করা হবে না। বোরখা পরবেন না, তাহলে আপনি তো ধার্মিকই না (যদিও বোরখা নামের কোনো পোশাকের সাথে রসুলাল্লাহ ও তাঁর সাহাবাগণ পরিচিতই ছিলেন না), আপনার মাথায় টুপি নেই মানেই আপনি অধার্মিক (যদিও টুপি বলে কোনো কিছু রসুলাল্লাহ কখনো মাথায় দিয়েছেন- এমনটা আমি কোথাও পড়িনি)।
যতদিন ধর্মের ধ্বজাধারীরা উন্নত না হবেন, উদার না হবেন, মানবিক গুণসম্পন্ন ও যুক্তিশীল না হবেন, সত্যিকারের আলেম (জ্ঞানী- সমস্ত বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন) না হবেন, ক্ষমতাবান না হবেন, কর্তৃত্বশালী না হবেন ততদিন সর্বশ্রেণির মানুষ তাদের অনুকরণ করবে না, অনুসরণ করবে না। কাজেই এখন সত্যিকারের ধর্মের প্রেমিকদের এক মহা সংগ্রামে নামা দরকার। যারা ধর্মের বিজয় চায় এমন সকল মানুষকে এক বিন্দুতে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগী হওয়া দরকার।
ধর্মের পক্ষশক্তিটি এখন কেবল পরাজিতই নয়, একেবারে নিশ্চিহ্ন হবার কাছাকাছি। এখনো যদি ধর্মের পক্ষশক্তির মানুষগুলো তাদের যাবতীয় মতভেদ, অনৈক্য দূর করে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে, আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তাহলে তাদের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। এই দায়িত্ব যেহেতু ধর্মের ধ্বজাধারীরা পালন করতে পারছেন না এবং তাদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ছে না কাজেই এ ধ্বজা এখন তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে। তারা ধ্বজা বহন করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে বহু আগেই।