সুন্নাহ অর্থ নীতি, কর্মপদ্ধতি, চর্চা ইত্যাদি। বর্তমানের বিকৃত ইসলামে রসুলাল্লাহর সুন্নাহ বলতে বোঝানো হয় তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস, অনভ্যাস, পোশাক, দাড়ি, টুপি, পাগড়ী ইত্যাদির অনুকরণ করা। কিন্তু এইগুলি রসুলাল্লাহর প্রকৃত সুন্নাহ নয়। নবী হিসাবে তাঁকে আল্লাহ যে দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, সেই দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তিনি যা করেছেন সেগুলিই হচ্ছে তাঁর সুন্নাহ। কী সেই কাজ? আল্লাহ কোর’আনে অন্তত তিনবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি (আল্লাহ) তাঁর রসুলকে সঠিক দিক নির্দেশনা ও সত্যদীন দিয়ে পাঠিয়েছেন এই জন্য যে তিনি এটাকে অন্যান্য সমস্ত দীনের ওপর বিজয়ী করবেন। এই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নবী ঘোষণা করলেন- “আমি আদিষ্ট হয়েছি সমস্ত মানব জাতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না তারা একথা মেনে নেয় যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন এলাহ নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) তাঁর রসুল” [হাদীস- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বোখারী]।
ইতিহাস সাক্ষী যতদিন তিনি এই দুনিয়ায় ছিলেন ততদিন তিনি ও তাঁর আসহাব একদেহ একপ্রাণ হয়ে আল্লাহর দেয়া ঐ আদেশ ও দায়িত্ব পালন করে গেছেন এবং তা করতে যেয়ে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে ৭৮ টি ছোট বড় যুদ্ধ করেছেন। তারপর যখন আল্লাহর রসুল এই দুনিয়া থেকে চলে গেলেন তখন ঐ দায়িত্ব স্বভাবতঃই এসে পড়ল তাঁর গঠন করা জাতিটির ওপর কারণ রসুলের ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব তখনও পূর্ণ হয় নি। শুধু আরব দেশটাকে আল্লাহর আইনের শাসনের মধ্যে আনা হয়েছে। বাকি পৃথিবী মানুষের তৈরী আইনের অধীনে চলছে। রসুলাল্লাহর নিজ হাতে গড়া জাতিটি অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদী তার জান্নাতবাসী নেতার ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব তাদের মাথায় এসে পড়া সম্বন্ধে এত সচেতন ছিলেন যে নেতার দুনিয়া থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্ষেত-খামার পরিবার পরিজন, এক কথায় পার্থিব সব কিছু কোরবান করে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ করতে অস্ত্র হাতে তাদের স্বদেশ আরব থেকে বের হয়ে পড়েছিলেন।
এই কাজকেই তাদের নেতা বলেছিলেন, আমার সুন্নাহ এবং বলেছিলেন আমার এই সুন্নাহ যে বা যারা ত্যাগ করবে তারা আমার কেউ নয়, ‘মান তারাকা সুন্নাতি ফালাইসা মিন্নি’ অর্থাৎ তারা উম্মতে মোহাম্মদীই নয়। শুধু তাই নয়, তিনি বলেছেন- ‘মান রাগেবা আন সুুন্নাতি ফালাইসা মিন্নি’ (বোখারী, মুসলিম) অর্থাৎ যে আমার সুন্নাহ থেকে শুধু মুখ ফিরিয়ে নেবে, সেও আমার কেউ নয়। ঐটাকে তিনি বললেন ‘আমার সুন্নাহ’ অর্থাৎ আমি সারা জীবন যা করে গেলাম এবং এও বললেন যে, যে আমার এই সুন্নাহ ত্যাগ করবে সে বা তারা আমার কেউ নয়; অর্থাৎ আমার উম্মত নয়। অবশ্যই, কারণ আল্লাহ যে দায়িত্ব দিয়ে তাকে পৃথিবীতে পাঠালেন, যে দায়িত্ব তিনি এক জীবনে পূর্ণ করতে না পারায় এক উম্মাহ সৃষ্টি করে তার উপর অর্পণ করে চলে গেলেন, সেই দায়িত্ব যে বা যারা ছেড়ে দেবে-ত্যাগ করবে, তারা নিশ্চয়ই তার কেউ নয়।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি বিশ্বনবীকে প্রেরিত বলে স্বীকার করে এই দীনে প্রবেশ করলেন, অর্থাৎ আবু বকর (রা.) মুসলিম হয়েই রসুলাল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন- “হে আল্লাহর রসুল! এখন আমার কাজ কি? কর্তব্য কি?” আল্লাহর শেষ নবী যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমরা ইতিহাসে ও হাদীসে পাই। তিনি বললেন, “এখন থেকে আমার যে কাজ তোমারও সেই কাজ।” কোন সন্দেহ নেই যে যদি প্রত্যেকটি মানুষ-যারা ঈমান এনে মহানবীর হাতে মুসলিম হয়েছিলেন তারা আবু বকরের (রা.) মত- যদি ঐ প্রশ্ন করতেন তবে তিনি প্রত্যেককেই ঐ জবাব দিতেন। “আমার যে কাজ” বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? তাঁর কী কাজ ছিল? তাঁর কাজ তো মাত্র একটা, যে কাজ আল্লাহ তাঁর উপর অর্পণ করেছেন। সেটা হলো সমস্ত রকমের জীবনব্যবস্থা ‘দীন’ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এই শেষ দীনকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসে পাচ্ছি, শেষ ইসলামকে গ্রহণ করার দিনটি থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আবু বকরের (রা.) কাজ একটাই হয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল মহানবীর সংগ্রামে তাঁর সাথে থেকে তাঁকে সাহায্য করা। শুধু আবু বকর নয়, যে বা যারা নবীকে বিশ্বাস করে মুসলিম হয়েছেন সেই মুহুর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বা তারা বিশ্বনবীকে তাঁর ঐ সংগ্রামে সাহায্য করে গেছেন, তাঁর সুন্নাহ পালন করে গেছেন। আর কেমন সে সাহায্য! স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করে, বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে, অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে, নির্মম অত্যাচার সহ্য করে, অভিযানে বের হয়ে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়ে। এই হলো তার উম্মাহ, উম্মতে মোহাম্মদী, তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী জাতি।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- “এমন সময় আসবে যখন আমার উম্মাহ প্রতিটি ব্যাপারে বনি ইসরাইলকে নকল করবে। এমনকি তারা যদি তাদের মায়ের সাথে প্রকাশ্যে ব্যভিচার করে তবে আমার উম্মাহ থেকেও তাই করা হবে। বনি ইসরাইলরা বাহাত্তর ফেরকায় (ভাগে) বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। এর একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” সাহাবারা প্রশ্ন করলেন-“ইয়া রসুলাল্লাহ! সেই এক ফেরকা কোনটি?” তিনি জবাব দিলেন-“যার উপর আমি ও আমার সঙ্গীরা (আসহাব) আছি” (হাদীস- আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে- তিরমিযি, মেশকাত)। যে একটি মাত্র ফেরকা (ভাগ) জান্নাতী হবে- যেটার কথা রসুলাল্লাহ বলেছেন- সেটা সেই কাজ নিয়ে থাকবে যে কাজের উপর তিনি ও তাঁর আসহাব ছিলেন।
তিনি ও তাঁর আসহাব (রা.) কিসের উপর- কোন কাজের উপর ছিলেন? সেই মহা জীবনী যারা পড়েছেন, তাঁর সাহাবাদের ইতিহাস যারা পড়েছেন-তাদের এ কথা স্বীকার করা ছাড়া কোন পথ নেই যে, নবুয়ত পাওয়ার সময় থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই অতুলনীয় মানুষটির একটিমাত্র কাজ ছিল, সেটা হলো এই শেষ জীবনব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে মানুষের জীবনে ন্যায়-শান্তি আনা এবং তার জীবিত অবস্থায় ও তাঁর ওফাতের পরে তাঁর সঙ্গীদেরও (আসহাব) জীবন ঐ একই কাজে ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ নেতা ও তার জাতির সম্পূর্ণ জীবন কেটেছে মানব জাতির কল্যাণের জন্য। যে কল্যাণের একটিমাত্র পথ-মানুষের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা, এক কথায় আল্লাহকে দেওয়া ইবলিসের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আল্লাহকে জয়ী করে সমস্ত মানব জাতিকে অন্যায়-অবিচার-অশান্তি-যুদ্ধ ও রক্তপাত থেকে উদ্ধার করে পরিপূর্ণ শান্তি, ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা।
যে বা যারা এই সংগ্রাম করবে শুধু তারাই রসুলাল্লাহর সুন্নাহ পালনকারী, অর্থাৎ যার উপর আল্লাহর রসুল ও তার আসহাব (রা.) ছিলেন। ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্বনবীর ঐ সঙ্গীরা (আসহাব) তাঁর ওফাতের পর তাদের নেতার উপর আল্লাহর অর্পিত কাজ একাগ্রচিত্তে চালিয়ে গেলেন, পার্থিব সমস্ত কিছু উৎসর্গ করে চালিয়ে গেলেন। কারণ তাদের কাছে ঐ কাজ ছিল বিশ্বনবীর সুন্নাহ। বিশ্বনবীর সংসর্গ যারা লাভ করেছিলেন; সরাসরি তাঁর কাছ থেকে এই দীন শিক্ষা করেছিলেন; এই দীনের উদ্দেশ্য এবং সেই উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া শিক্ষা করেছিলেন তারা তাঁর ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ঐ ৬০/৭০ বছর পর বিশ্বনবীর সাক্ষাৎ সঙ্গীরা (রা.) শেষ হয়ে যাবার পরই পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই সংগ্রাম যেই মুহূর্তে বন্ধ হলো জাতি হিসাবে ত্যাগ করা হলো সেই মুহূর্ত থেকে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী শেষ হয়ে গেল। সেই জন্য মহানবী তাঁর সুন্নাহ বলতে শুধু তাঁর নিজের সুন্নাহ বললেন না। বললেন- “আমি ও আমার সঙ্গীরা যার উপর আছি” এবং অন্য সময় এও বললেন যে “আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।”