এসলামে আকিদার গুরুত্ব অনেক বেশি। আকিদা বোলতে কী বোঝায় তা পরিষ্কার বুঝে নেয়া প্রত্যেকটি মোসলেমের অতি প্রয়োজনীয়। কারণ দীনের সব প্রধান প্রধান পণ্ডিতদের সম্মিলিত অভিমত এই যে, পরিপূর্ণ ঈমান থাকা সত্ত্বেও আকিদার ভুলে একজন মো’মেনের কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হোয়ে যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ একজন মানুষ আল্লাহ, রসুল, কোর’আন, কেয়ামত, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম, মালায়েক ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ ঈমানদার হোয়েও আকিদা ভুল হওয়ার দরুন কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হোয়ে যেতে পারে। ঐ সব বিষয়ে ঈমান পূর্ণ হোলেও যদি মানুষ মোশরেক ও কাফের হোতে পারে তবে অবশ্যই আকিদা ঈমানের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি প্রয়োজনীয়। আসলেও তাই, আকিদা ঈমানের চেয়ে সূক্ষ্মতর, কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। তার প্রমাণ বর্তমান দুনিয়ার মোসলেমদের অবস্থা। কোটি কোটি মানুষের মোকাম্মেল ঈমান, আল্লাহ, রসুল, কোর’আন ইত্যাদির উপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও তারা শেরক ও কুফরের মধ্যে ডুবে আছে, আকিদার ভুলের-বিকৃতির জন্য, কিন্তু বুঝতে পারছেনা। আকিদা হোল কোন একটি জিনিস বা ব্যাপার সমগ্রভাবে দেখা বা বোঝা । কোন বস্তু বা পদার্থ হোলে সেটির সমগ্রটিকে চোখ দিয়ে দেখে সেটা কী, সেটা দিয়ে কী কাজ হয় এবং সেটার উদ্দেশ্য কী এ সমস্তই সঠিকভাবে বুঝে নেয়া হোল আকিদা এবং কোন বস্তু বা পদার্থ না হোয়ে যদি কোন বিষয় হয় তবে সেটাকে চোখ দিয়ে নয়, বুদ্ধি, যুক্তি, চিন্তা দিয়ে সেটার সামগ্রিক রূপটাকে ধারণা করা, সেটার কাজ কী, সেটার উদ্দেশ্য কী এ সমস্তই সঠিক বুঝে নেওয়া হোল আকিদা। অন্যভাবে বলা যায় যে আকিদা হোল দৃষ্টি। বস্তু বা পদার্থ হোলে দৈহিক চক্ষু দিয়ে সে জিনিস বা বস্তুটিকে সম্পূর্ণভাবে দেখা, আর বিষয় হোলে বুদ্ধি, মনের চোখ দিয়ে সামগ্রিকভাবে দেখা ও বোঝা। দুটো উদাহরণের চেষ্টা কোরছি। প্রথমটা বস্তু। সেই সর্বজনবিদিত অন্ধের হাতি দেখার উপমাটাই নেওয়া যাক। পাঁচ জন অন্ধ, তাদের দৃষ্টিশক্তি নেই বোলে হাতড়িয়ে হাতি দেখে পাঁচ জনে হাতি সম্বন্ধে পাঁচ রকম সিদ্ধান্তে উপনীত হোল। যে শুড় হাতড়ালো তার কাছে হাতি একটা অজগর সাপের মত, যে পা হাতড়ালো তার কাছে থামের মত, যে পেট হাতড়ালো তার কাছে জালার মত, যে কান হাতড়ালো তার কাছে কুলোর মত, আর যে লেজ হাতড়ালো হাতি তার কাছে চাবুকের মত। সবগুলো অভিমতই অবশ্য ভুল। এই ভুলের কারণ মাত্র একটা- সেটা হোচ্ছে এ লোকগুলির দৃষ্টিশক্তি নেই তাই তারা চোখ দিয়ে সমস্ত হাতিটাকে সমগ্রভাবে দেখতে পারে না। যদি দৃষ্টি থাকতো তবে সমগ্র হাতিটাকে একবারে দেখতে পেতো, হাতি দিয়ে কি হয়, ওটার উদ্দেশ্য কি সবই সঠিক হোত, অর্থাৎ হাতি সম্বন্ধে তাদের আকিদা সঠিক হোত। তাদের হাতড়াবার প্রয়োজনই হোত না, যেমন বিশ্বনবীর (দ:) আসহাবদের হাতড়াবার অর্থাৎ ইসলামকে বিশ্লেষণ করার কোন প্রয়োজন হয় নি। কারণ তাদের আকিদা শেখা ছিল স্বয়ং রসুলের (দ:) কাছ থেকে।
বস্তু বা পদার্থ না হোয়ে কোন বিষয় হোলে তখন দৈহিক চক্ষু না হোয়ে প্রয়োজন হবে মস্তিষ্কের, বুদ্ধির, মনের চোখের, যুক্তির চোখের। উদাহরণরূপে ধরুন, আপনাকে চোখ বেঁধে স্টেশনের দাঁড়ানো ট্রেনের একটা বগী অর্থাৎ কামরায় নিয়ে যেয়ে আপনার চোখের বাঁধন খুলে দিলাম। তারপর আপনাকে বোঝালাম এই যে, আপনাকে যেখানে নিয়ে এসেছি এটা একটা বসবাস করার ঘর। এই দেখুন এই যে গদীমোড়া বিছানা, এ যে টেবিল, ইলেকট্রিক বাতি, পাখা, মাথার কাছে পড়ার বাতি, দরজা, জানালা, এই যে পাশেই টয়লেট, পেশাব-পায়াখানা-হাতমুখ ধোয়ার বেসিন, পানি ইত্যাদি বসবাস করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই আছে। সুতরাং আপনি এখানে সুখে বসবাস কোরুন। অতি শক্তিশালী যুক্তি। আপনি যদি ঐ যুক্তি শুনে বিশ্বাস করেন যে ট্রেনের ঐ কামরা সত্যই বসবাস করার জন্য তৈরি করা হোয়েছে তবে আপনার আকিদা অর্থাৎ ঐ কামরার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ধারণা ভুল হোল। বসবাস করার সমস্ত আয়োজন ওখানে থাকা সত্ত্বেও ওটার উদ্দেশ্য বসবাস করার জন্য নয়, ওটার উদ্দেশ্য আপনাকে সিলেট বা চট্টগ্রাম বা দিনাজপুর নিয়ে যাওয়া। আপনি শুধু ওটাকে আংশিকভাবে দেখছেন বোলে বুঝতে পারছেন না ওর আসল উদ্দেশ্য কী। আপনি কামরাটা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে খানিকটা দূরে থেকে কামরাটাকে দেখুন। এবার আপনি দেখতে পাবেন ঐ কামরার নিচে চাকা লাগানো আছে অর্থাৎ ওটার চলার জন্য। তারপর আরও একটু দূরে যেয়ে দেখলে সম্পূর্ণ ট্রেন, সেটার ইঞ্জিন, রেলের লাইন সব চোখে পড়বে। এইবার আপনি আপনার বুদ্ধি, যুক্তি, ব্যবহার কোরলেই বুঝতে পারবেন যে বসবাস করার সব রকম ব্যবস্থা থাকলেও ঐ কামরার উদ্দেশ্য তা নয়, ওর আসল উদ্দেশ্য হোল আপনাকে দূরে কোন গন্তব্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। এইবার আপনার আকিদা সঠিক হোল। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে, একবারে সম্পূর্ণভাবে কোন বস্তু, পদার্থ বা বিষয়কে না দেখে ওগুলোর অংশ বিশেষকে দেখে ওগুলো সম্বন্ধে সঠিক আকিদা করা যায় না। নাট-বল্টু দেখে যেমন কখনও বলা যাবে না যে ওটা কেমন ইঞ্জিনের অংশ, তেমনি কোন জীবন-ব্যবস্থা, দীনের কোন অংশ দেখে বলা যাবে না, ওর সমগ্র রূপটি কি, ও উদ্দেশ্য কি। ঠিক ওমনিভাবে ওমুক কাজ কোরলে অত হাজার সওয়াব লেখা হয়, ওমুক দোয়া পড়লে অত লক্ষ সওয়াব হয় থেকেও ইসলামের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাবে না। অনেকটা এই ভাবেই এই শেষ জীবন-ব্যবস্থা, শেষ ইসলামের প্রকৃত আকিদা লুপ্ত হোয়ে গেছে। বসবাসের আসবাবপত্র দেখে ট্রেনের কামরাকে তাই মনে কোরে সেখানে আরামে বাস কোরতে থাকলে যা হবে আজ মোসলেম উম্মাহর তাই হোয়েছে। আজ তার কোন গন্তব্যস্থান নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের কামরায় সে বাস কোরছে। এই আকিদা বিকৃতির মূলে সেই অতি বিশ্লেষণ, সেই ভারসাম্যহীন বিকৃত-সুফীবাদ, সেই সেরাতুল মোস্তাকীম, সহজ-সরল পথকে ত্যাগ। (চোলবে এনশাআল্লাহ)