রাকিব সারাবছর খুব মন দিয়ে স্কুলের বইগুলো পড়ে। কয়েকজন গৃহশিক্ষক তাকে আলাদা আলাদা বিষয়ে পাঠদান করেন। পড়াশুনার সময়ের বাইরেও সে সর্বক্ষণ বাসায় স্কুলের ইউনিফর্ম পরে থাকে। কিন্তু সে পরীক্ষায় কখনও পাস করতে পারে না। কেন বলুন তো?
কারণ সে আসলে কোনো স্কুলে ভর্তিই হয় নি। ফলে স্কুলের খাতায় তার নাম নেই। তাই যত ভালো ছাত্রই হোক না কেন তার পরীক্ষাও নেওয়া হয় না, তার পাসও করা হয় না। তার বন্ধুরা সবাই কোনো না কোনো স্কুলে পড়ে। তারা অনেকেই তার চেয়ে কম পড়াশুনা করেও একটার পর একটা ক্লাস ডিঙিয়ে যাচ্ছে, সার্টিফিকেট পাচ্ছে। কিন্তু বহু পড়েও, বহু জেনেও রাকিব কোনো সনদ পাচ্ছে না, যোগ্যতার স্বীকৃতি বা পুরস্কার কিছুই তার জুটছে না। যখন তার বয়স হলো, সে দেখল কোনো চাকরির ইন্টারভিউতে বসার সুযোগ তার নেই।
আজ মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠীর অবস্থা এই রাকিবের মতো। কীভাবে? আসুন বিচার করি। প্রথম কথা হচ্ছে, ইসলামের যাবতীয় আমল কার জন্য? এর উত্তর হচ্ছে- মো’মেনের জন্য। আল্লাহ কোর’আনে মো’মেনদেরকে সম্বোধন করেই বিভিন্ন আমল করার আদেশ নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন-
হে মো’মেনগণ! তোমরা দৃঢ় সংকল্প (সবর) ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা কর। (সুরা বাকারা -১৫৩)।
হে মো’মেনগণ! তোমাদের উপর সওম ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার (সুরা বাকারা ১৮৩)।
হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও (সুরা বাকারা ২৮২)।
এভাবে ছোট-বড় যে কোনো আমল করার নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন কেবল মো’মেনদেরকে। এসব আমল মোমেন না হয়ে কেউ করলে তা কোনো কাজে আসবে না। অর্থাৎ ইসলামের যে কোনো আমলের পূর্বশর্ত হলো মো’মেন হওয়া। কেউ যখন মো’মেন হলো তখন আল্লাহর খাতায় তার নাম উঠল। এরপর থেকে তার আমল শুরু। আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ দুই প্রকার – মো’মেন ও কাফের। তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ কাফের এবং কেউ মো’মেন (সুরা তাগাবুন ২)। কাফের অবস্থায় মানুষ অনেক আমল করতে পারে কিন্তু সেগুলোর কোনো প্রতিদান আল্লাহ দিবেন না। সেগুলো আমলে সালেহ বা সঠিক আমল হিসাবে পরিগণিত হবে না। তাদের আমলের পরিণাম কী হবে সেটাও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন-
“আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলিকণারূপে করে দেব” (সুরা ফোরকান ২৩)।
“যারা কাফের, তাদের কর্ম মরুভুমির মরীচিকা সদৃশ, যাকে পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করে। এমনকি, সে যখন তার কাছে যায়, তখন কিছুই পায় না এবং পায় সেখানে আল্লাহকে, অতঃপর আল্লাহ তার হিসাব চুকিয়ে দেন।” (সুরা নূর ৩৯)।
“বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে। তারাই সে লোক, যারা তাদের পালনকর্তার নিদর্শনাবলী এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের বিষয় অস্বীকার করে। ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। সুতরাং কেয়ামতের দিন তাদের জন্য আমি কোন গুরুত্ব স্থির করব না (সুরা কাহাফ ১০৩-১০৫)।
এভাবে আরো বহু আয়াত উল্লেখ করা যাবে যেগুলো দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কাফেররাও অনেক নেক আমল করতে পারে কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসবে না। তারা জাহান্নামেই যাবে। আপনি সারাদিন ফল কুড়িয়ে যদি তলাবিহীন ঝুড়িতে রাখেন তাহলে কোনো ফলই আপনার সঞ্চয়ে থাকবে না। পক্ষান্তরে মোমেনদের জন্যই আল্লাহর সকল বিজয় ও পুরস্কারের সুসংবাদ, সম্মান ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, সর্বোপরি জান্নাতের ঘোষণা।
তাই সবার আগে আমাদের এটা নিশ্চিত হতে হবে যে আমরা আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন কিনা। হ্যাঁ, দাবি তো আমরা সবাই করতে পারি, কিন্তু আল্লাহর দেওয়া যে মানদণ্ড কোর’আনে রয়েছে সেই মানদণ্ডের বিচারে যদি মোমেন না হই তাহলে সকল দাবিই অর্থহীন। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস আবু জেহেলেও ছিল, ইবলিসেরও আছে। সুতরাং আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেই কেউ মো’মেন হয়ে যায় না। একইভাবে বংশগতভাবেও কেউ মো’মেন হতে পারে না। আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা পূরণ করেই প্রত্যেক মানুষকে মো’মেন হতে হবে। এবার আসুন দেখি আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মো’মেনের কী সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলছেন,
“মো’মেন শুধু তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর তাতে কোনোরূপ সন্দেহ পোষণ করে না, এবং নিজ সম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করে দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সংগ্রাম) করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” (সুরা হুজরাত ১৫)
প্রথম শর্ত হচ্ছে আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান। মনে রাখতে হবে এই ঈমান কেবল তাঁদের অস্তিত্বে বা সত্যতায় বিশ্বাস করা নয়। এই বিশ্বাসের অর্থ হচ্ছে তওহীদের ঘোষণা- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)। আমি আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম অর্থ তাঁর দেওয়া হুকুম-বিধান, আদেশ-নিষেধ মেনে চলব। যদি তাঁর হুকুম বিধান অস্বীকারই করি, তাহলে তাঁর প্রতি ঈমান আনার দাবি অর্থহীন। একইভাবে রসুলাল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অর্থই হলো, আমরা তাঁকে আমাদের জীবনের আদর্শ হিসাবে অনুসরণ করব, আল্লাহর হুকুম মানবো তাঁর নীতি-পদ্ধতি অনুসারে। কারণ তিনিই হচ্ছেন মূর্ত কোর’আন।
সর্বশেষ তথ্যমতে, বর্তমানে আমরা মুসলমান দাবিদার এই জনগোষ্ঠীটি সংখ্যায় ১৮০ কোটি। মুখে মুখে আমরা সবাই কলেমা পাঠ করি, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান আছে বলে দাবি করি। কিন্তু আমাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করি পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতার তৈরি হুকুম দিয়ে। অথচ তওহীদের ঘোষণাই হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ নাই কোনো হুকুমদাতা আল্লাহ ছাড়া। এই বাণী উচ্চারণের পর আল্লাহ ব্যতিরেকে আর কারো হুকুম মেনে চলার কোনো সুযোগ থাকে কি? যদি কেউ মানে তাহলে কি সে তওহীদের দাবিতে সত্যবাদী হবে? অবশ্যই নয়।
জীবনের যে অঙ্গনেই সেটা হোক সামাজিক অঙ্গন, বিচারিক অঙ্গন, অর্থনৈতিক অঙ্গন বা রাজনৈতিক অঙ্গন- যেখানে আল্লাহর কোনো আদেশ বা নিষেধ আছে সেখানে সেই আদেশ বা নিষেধের লংঘন করে, অস্বীকার করে অপর কারো আদেশ-নিষেধ মানবো না- এটাই হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার একটি চুক্তি। এই চুক্তির নাম তওহীদ। এই চুক্তি করেই একজন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে ইসলামের বিভিন্ন আমল করতে শুরু করে। তওহীদের চুক্তিতে না এসে কেউ যদি সারাজীবন লক্ষরকমের আমল দিয়ে পৃথিবী পূর্ণও করে ফেলে সে আমল আল্লাহ কবুল করবেন না, যে বিষয়ে একটু আগেই বলে এসেছি। এখন আরেকটি ঘটনা হাদিসগ্রন্থ থেকে উল্লেখ করছি। কোনো একটি যুদ্ধ শুরু হবে এমন সময়ে লৌহ বর্মে আবৃত এক ব্যক্তি রসুলাল্রাহর (সা.) নিকট এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি আগে যুদ্ধে শরীক হবো, না ইসলাম গ্রহণ করব?’ তিনি বললেন, ‘ইসলাম গ্রহণ কর, অতঃপর যুদ্ধে যাও।’ অতঃপর সে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে যুদ্ধে গেল এবং শাহাদাত লাভ করল। রসুলাল্লাহ বললেন, ‘সে কম আমল করে অধিক পুরস্কার পেল।’ (বারা রা. থেকে বোখারি, হাদিস নং ২৮০৮)
এই ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলেন কী কলেমার সাক্ষ্য প্রদান করে? নিশ্চয়ই তওহীদের ঘোষণা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – মোহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ পড়েই তিনি ইসলামে আসলেন। এই সাক্ষ্য দিয়ে তিনি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হলেন, মোমেনের খাতায় তার নাম উঠালেন। এরপর আমলের মাঠে বা যুদ্ধের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর কারণেই তিনি পুরস্কার লাভ করলেন।
আজকে মুসলিম দাবিদার এই জনগোষ্ঠী মুখে এই কলেমা হরদম পাঠ করেও কলেমার অঙ্গীকার পুরোপুরি ভঙ্গ করেছে। এই অঙ্গীকার তারা ভঙ্গ করেছে বহু শতাব্দী আগেই, যখন তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার দাসে পরিণত হয়ে আল্লাহর হুকুম-বিধানের পরিবর্তে তাদের তৈরি হুকুম-বিধান, জীবনব্যবস্থা বা দীনকে গ্রহণ করে নিয়েছে তখনই। সেই থেকে এই জাতির নাম আল্লাহর সংজ্ঞায়িত মো’মেনের খাতা থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। কারণ তারা মোমেনের সংজ্ঞায় বর্ণিত দু’টো শর্তের প্রথম শর্তটিই ভঙ্গ করে ফেলেছে। আর দ্বিতীয় শর্ত অর্থাৎ সম্পদ ও জীবন কোরবানি করে জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) এটা তো তারা ত্যাগ করেছে প্রায় তেরশ বছর আগেই। জেহাদ ত্যাগ করার কারণেই তো আল্লাহ তাদের বিষয়ে শত্রুর মনে থাকা ভয় দূর করে দিয়েছেন। ফলে সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম ধীরে ধীরে অন্য জাতির দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে পড়েছে, অপমানিত লাঞ্ছিত হচ্ছে, তাদের নারীরা বে-ইজ্জত হচ্ছে, তাদের শিশুরা উদ্বাস্তু শিবিরে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেন হয়েছে? তাদের মধ্যে দাড়ি-টুপি-জোব্বা পরিধানকারীর কি কোনো অভাব রয়েছে? তাদের রাষ্ট্রগুলোতে কি মসজিদ-মাদ্রাসা কম আছে? তাদের শিশু থেকে বৃদ্ধ অধিকাংশ মানুষ কি রোজা রাখছে না? সবই আছে। তাদের সমাজে আছে কোটি কোটি আলেম, মুফাসসির, তার্কিক, ফকিহ, পীর-মুর্শিদ, স্কলার। কিন্তু যেটা নেই সেটা হলো তওহীদ। তারা আল্লাহকে তাদের একমাত্র হুকুমদাতা, ইলাহ হিসাবে মানছে না। ফলে তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন নেই। তাই তাদের জন্য আল্লাহর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, সুসংবাদ নেই, জান্নাতের ঘোষণাও তাদের জন্য নয়। তাদের সব আমলই উলু বনে মুক্তো ছড়ানো। তাদের অবস্থা শুরুতে রাকিব নামে যে ছাত্রটির কথা বললাম তার মতো। দিনরাত পড়াশুনা করেও সে কোনো সনদ পাবে না, পাস পর্যন্ত করবে না কারণ সে কোনো স্কুলের খাতায় নাম লেখায় নি।