হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মো’জেজা: কী কেন কীভাবে?

আরশাদ মাহমুদ

ইসলামী পরিভাষায় মো’জেজা হলো অলৌকিক ঘটনা (গরৎধপষব), যা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সংঘটন করতে পারে না। যেমন- মৃতকে জীবিত করা, নবজাতককে দিয়ে কথা বলানো ইত্যাদি। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে এ ধরনের অলৌকিক কাজ সম্ভব নয়, এমনকি নবী-রসুলদের পক্ষেও সম্ভব নয়। আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী (র.) এভাবে মো’জেজার সংজ্ঞা পেশ করেছেন- “মো’জেজা এমন বিষয়, যা সাধারণ ও চিরাচরিত নিয়মের ব্যতিক্রম, প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বানযুক্ত এবং মোকাবেলার আশঙ্কামুক্ত (আল ইতকান, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা: ৩০৩)। ইমাম কুরতুবি বলেন, “মো’জেজাকে মো’জেজা বলা হয়, কেননা, মানুষ এর অনুরূপ কিছু পেশ করতে অক্ষম হয়ে থাকে।” (তাফসীরে কুরতুবী, মুকাদ্দিমা, পৃ. ৬৯) এই অর্থে মো’জেজা বলতে আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত মানুষের সাধ্যাতীত যে কোনো অলৌকিক ঘটনাকেই বোঝায়।
কোর’আন হাদিসে মো’জেজা
শুরুতেই বলা দরকার কোর’আন হাদিসে কিন্তু মো’জেজা শব্দটি নেই। কোর’আনে অলৌকিক ঘটনা বা বিষয় বোঝাতে যে আরবি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাহলো- আয়াত (চিহ্ন), ইংরেজিতে যাকে বলে ঝরমহ. (সুরা শুয়ারা-১৫২) ব্যাংক যেমন আপনাকে না দেখে আপনার সিগনেচার (ঝরমহধঃঁৎব) দেখেই আপনাকে সনাক্ত (ঠবৎরভু) করতে পারে, তেমনি আল্লাহও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে এমন আয়াত বা সিগনেচার রেখেছেন, যা দেখে মানুষ আল্লাহর অস্তিত্ব, পরাক্রম, উলুহিয়াত ও রবুবিয়্যাত সম্পর্কে বুঝতে পারে। তবে কোর’আনে ব্যবহৃত আয়াত ছাড়াও হাদিসে বোরহান (দলিল, প্রমাণ) শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে আল্লাহর নিদর্শন বোঝানোর জন্য। আল্লাহ বলেন, হে লোকসকল! তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ (বোরহান) এসে গেছে (সুরা নিসা ১৭৪)।
মো’জেজা শব্দটি প্রচলিত হবার আগে, রসুল (সা.) ও সাহাবা-আজমাইনদের যুগে আল্লাহর নিদর্শন বোঝাতে এই দুইটি শব্দই (আয়াত ও বোরহান) প্রচলিত ছিল এবং স্বভাবতই আল্লাহর সব ধরনের নিদর্শনকেই আয়াত, বোরহান শব্দে প্রকাশ করা হতো। কিন্তু “আয়াত” শব্দের ভিন্ন অর্থ, গভীরতা ও ব্যাপকতার কারণে পরবর্তী যুগের আলেমরা ভিন্ন একটি আরবি শব্দ “মোজেজা”কে বেছে নেন অলৌকিক ঘটনা বোঝাতে। এক্ষেত্রে দু’টো সমস্যা দাঁড়ায়। প্রথমত- আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন বা আয়াত থাকলেও শুধুমাত্র নবী-রসুলদের দ্বারা প্রকাশিত ঘটনাগুলোই মো’জেজা হিসেবে আখ্যায়িত হতে থাকে; দ্বিতীয়ত- মো’জেজা শব্দের সীমাবদ্ধতা যেহেতু সাধারণ মানুষের মনে একটা ভুল ধারণার জন্ম হয় যে, নবী-রসুলরা বোধহয় নিজের ক্ষমতা দিয়েই মো’জেজা সংঘটন করতেন। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাওলানা এস. এম. মতিউর রহমান নূরী তাঁর মো’জিযাতুন্নবী” গ্রন্থে লিখেছেন-“মো’জেজা শব্দটি শ্রবণ করিবা মাত্রই সাধারণ মানুষের অন্তরে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, ইহা স্বয়ং নবীর নিজস্ব ক্ষমতায় অনুষ্ঠিত ঘটনা, তাঁহারই অংগ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছে।” পক্ষান্তরে আয়াত শব্দটিতে এমন কোনো বিভ্রান্তির স্থান ছিল না।
এরপর একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, কোনো ঘটনাকে মো’জেজা হতে হলে অবশ্যই সেটা নবুয়্যতের দাবির সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। যেমন- আল্লামা মীর সায়্যিদ শরিফ জুরজানী মো’জেজার সংজ্ঞায় বলেন, “. . . মো’জেজা নবুয়্যতের দাবির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার দ্বারা এমন ব্যক্তির সত্যবাদিতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য, যিনি দাবি করেন যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত (আততা’রীফাত: পৃ. ২২৫)।
শুধু নবী-রসুলদের মাধ্যমেই মো’জেজা প্রকাশিত হয়?
যেহেতু মো’জেজা শব্দটিই কোর’আন হাদিসের কোথাও নেই, কাজেই এই দাবি কেউ করতে পারে না যে, শুধু নবী রসুলদের মাধ্যমেই মো’জেজা প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক মাওলানা এস. এম. মতিউর রহমান নূরী তার মো’জিযাতুন নবী গ্রন্থে আরও লিখেছেন- ‘প্রেরিত পুরুষগণ দ্বারা বা নবী ও রসূলগণ দ্বারা যে সব অস্বাভাবিক অবস্থা, ঘটনা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয়, সাধারণতঃ উহাকে “মোজিযা” বলা হইয়া থাকে; কিন্তু কয়েকটি দিকের বিচারে এই পরিভাষা ভ্রান্ত বলিয়াই প্রতীয়মান হয়। প্রথমতঃ এই কারণে যে, পবিত্র কোর’আন ও হাদিসের কোথাও এই শব্দটির (মো’জেজা) প্রয়োগ বা ব্যবহার হয় নাই। উহার পরিবর্তে এই পর্যায়ের ব্যাপার সমূহের নিমিত্ত “আয়াত” (নিদর্শন), বোরহান (অকাট্য দলিল ও প্রমাণ) শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।”
যদি পবিত্র কোর’আনে বা হাদিসে এরকম কোনো দলিল থাকত যে, একমাত্র নবী-রসুলদের ক্ষেত্রেই মো’জেজা ঘটে, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটে না, তাহলে সেটা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ থাকত না। তেমনটা নেই। বরং কোর’আনে আল্লাহ তাঁর নিজের উলুহিয়্যাতের সত্যতা প্রমাণের জন্যও বহু নিদর্শনের উদাহরণ দিয়েছেন, যার সাথে নবুয়্যতের সম্পর্ক নেই। মোদ্দাকথা, আল্লাহ যে কারো ক্ষেত্রে, যে কোনো উদ্দেশ্যে, যে কোনো অলৌকিক ঘটনা বা বিষয় ঘটাতে পারেন, সেটাকে আমরা আয়াত, বোরহান, বা মো’জেজা যাই বলি না কেন। যেহেতু কোর’আনে মোজেজা শব্দটিই নেই, তাই এ শব্দটি কেবল নবী-রসুলদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তার কোনো প্রমাণ নেই। এ শব্দটিকে নব-রসুলদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করেছে পরবর্তী যুগের আলেমগণ, অর্থাৎ এটা মানুষের মতামত, আল্লাহ বা রসুলের মতামত নয়।
মুসা (আ.) এর হাতের লাঠি দিয়ে তিনি অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন ফেরাউনের দরবারে, যা ছিল আল্লাহর স্পষ্ট আয়াত বা মো’জেজা। যার উদ্দেশ্য ছিল নবী মুসা (আ.) এর নবুয়্যতের সত্যতা প্রমাণ করা। আবার কোর’আনে বর্ণিত হস্তিবাহিনীর ঘটনাও কি আল্লাহর আয়াত বা মো’জেজা নয়? অথচ তখন কোনো নবী ছিলেন না। আবাবিল পাখির বাহিনী পাঠিয়ে আল্লাহ কোনো নবীকে সত্যায়ন করেননি, বরং তাঁর ঘর কাবাকে সত্যায়ন করেছিলেন। আবার পবিত্র কোর’আনে বর্ণিত আসহাবে কাহফের ঘটনাও ছিল একটা মো’জেজা (সুরা কাহফ: ৯-২২)। সংক্ষেপে ঘটনাটা হলো- খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে মোশরেক বাইজেন্টাইন শাসকের অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঈসা (আ.) এর অনুসারী কয়েকজন মো’মেন যুবক একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিলেন। তাদের সঙ্গে ছিল একটি কুকুর। আল্লাহ তাদেরকে ওই গুহার ভেতরেই শত শত বছর অলৌকিকভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন এবং যখন তাদের ঘুম ভাঙে তারা ভাবেন মাত্র একদিন বা দিনের কিছু অংশমাত্র তারা ঘুমিয়েছেন। প্রায় তিনশ’ বছর পর যখন তারা বাইরে বের হলেন, দেখলেন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। তারা নবী-রসুল ছিলেন না, অথচ পবিত্র কোর’আনে এই ঘটনাকে আল্লাহ তাঁর আয়াত বা নিদর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা কাহফ: ৯, ১৭)। আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ এই ঘটনাকে গুহাবাসী যুবকদের কারামত বলেছেন কিন্তু কারামত শব্দটি এখানে প্রযোজ্য নয়, কারণ ওই যুবকরা আধ্যাত্মিক সাধনা করে আত্মার শক্তি বাড়িয়ে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই অলৌকিক কার্য সাধন করেননি, তারা জানতেনও না এমন কিছু ঘটবে। পুরো ঘটনাই আল্লাহর হুকুমে হয়েছে।
একইভাবে ঈসা (আ.) এর মা মরিয়ম, পবিত্র কোর’আনে যার নামে একটি আলাদা সুরাই আছে, সেই মারিয়মও (আ.) নবী-রসুল ছিলেন না, অথচ তিনি আল্লাহর কুদরতে কুমারী হয়েও সন্তান জন্মদান করেছিলেন। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ বনি ইসরাইলীদের সামনে আয়াত বা মো’জেজা প্রদর্শন করেছিলেন (সুরা মারিয়াম: ২১)। আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শনই যদি মো’জেজা হয়, তাহলে কি আর এই কথা বলার অবকাশ থাকে মো’জেজা কেবল নবী-রসুলদের সাথেই ঘটবে?
মো’জেজা কি কেবল ব্যক্তি বিশেষের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়?
অনেকে মনে করেন মো’জেজা কেবল ব্যক্তি বিশেষের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। এই ধারণাও সঠিক নয়। ব্যক্তি বিশেষ ছাড়াও আল্লাহর বিভিন্ন সৃষ্টির মাধ্যমেও প্রকাশিত হতে পারে। যেমন পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ তা’আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালার যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও জমিনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সে সমস্ত বিষয়ের মাঝে নিদর্শন (আয়াত) রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে।” (সুরা বাকারা ১৬৪)
মো’জেজা ও কারামতের পার্থক্য:
অলৌকিক ঘটনা দুই রকম। একটাকে বলা হয় কারামত, অন্যটি মো’জেজা। অনেকে পীর-দরবেশদের কারামতির সাথে মো’জেজাকে গুলিয়ে ফেলেন। দু’টোকে একই বিষয় মনে করেন। পার্থক্য হিসেবে বলেন যে, নবীদের সাথে ঘটলে সেটা মো’জেজা, আর অন্যদের বেলায় কারামতি। আসলে কিন্তু তা নয়। মূল পার্থক্য হচ্ছে- আধ্যাত্মিক সাধকরা বিশেষ প্রক্রিয়ার (তরীকা) মাধ্যমে বহুদিন কঠোর সাধনা করে আত্মার ঘষামাজা করে অসাধারণ শক্তি অর্জন করে পানির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন, ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারেন ইত্যাদি অনেক রকম অলৌকিক কাজ করতে পারেন। এগুলো কারামত। একজন সাধককে দীর্ঘদিন কঠিন রিয়াযতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ক্ষমতা অর্জন করতে হয় ওই কাজগুলো করার জন্য এবং তারপর তিনি সেটা যখন খুশি প্রদর্শন করতে পারেন। পক্ষান্তরে মো’জেজা কোনো নবীর ইচ্ছামাফিক ঘটে না এবং তার জন্য কোনো নবীকে কঠোর সাধনা বা রিয়াযতও করতে হয় না। মো’জেজা কেবল আল্লাহর ইচ্ছাধীন। যেমন সমুদ্র ভাগ হবার একটু আগেও মুসা (আ.) জানতেন না কীভাবে তিনি সঙ্গীদের নিয়ে লোহিত সাগর পার হবেন।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মো’জেজা ও যুক্তিগ্রাহ্য মো’জেজা:
মো’জেজা দুই রকমের হতে পারে। আল্লামা সুয়ূতীর ভাষায়- বনি ইসরাইলের নবীগণের অধিকাংশ মো’জেজা ছিল ইন্দ্রিয়গাহ্য। কেননা সে যুগের মানুষের মেধা ছিল দুর্বল এবং তাদের সূক্ষ্ম বিষয় উপলব্ধির মতো জ্ঞান ছিল কম। আর এই উম্মতের সামনে প্রকাশিত নবী করিম (সা.) এর অধিকাংশ মো’জেজা হলো যুক্তিগ্রাহ্য। অর্থাৎ চিন্তা করে যুক্তিবুদ্ধি ব্যবহার করে এই মো’জেজাগুলো বুঝতে হবে। এর কারণ প্রথমত এই যে, এ উম্মতের মেধা ও বোধশক্তি পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের তুলনায় প্রবল ও ঋদ্ধ। এ কারণেই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বারবার প্রশ্ন করেছেন, আফালা তা’কিলুন- তোমরা কি তোমাদের বুদ্ধি কাজে লাগাবে না (সুরা আম্বিয়া ১০), অথবা এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন (সুরা রাদ ৩)। দ্বিতীয়ত এই ইসলামী শরিয়ত কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। তাই এ উম্মতের জন্য যুক্তিগ্রাহ্য ও স্থায়ী মো’জেজা প্রদান করা হয়েছে, যাতে জ্ঞানবান লোকেরা তা দেখতে পায়। (আল ইতকান, খ. ৪, পৃ. ৩০৩)। আমাদের রসুলের শ্রেষ্ঠ মো’জেজা হচ্ছে আল কোর’আন। তিনি আল্লাহর রসুল না হলে এই অলৌকিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কেতাব তিনি কোথায় পেলেন? তবে কোর’আন যে মানুষের রচনা নয় তা যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগ কোরেই বুঝতে হয়।
রাসূল (সা.) কি নিজে মো’জেজা ঘটাতে পারতেন?
প্রকৃতপক্ষে কোনো নবীই নিজের ক্ষমতায় ও নিজের ইচ্ছায় মো’জেজা ঘটাতে পারতেন না। একবার কাফের মোশরেকরা রসুলাল্লাহর কাছে গিয়ে বলল, ‘আমরা কখনই তোমার উপর ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য মাটি থেকে প্রস্রবন উৎসারিত করবে, অথবা তোমার খেজুরের ও আঙ্গুরের এক বাগান হবে, যার ফাঁকে ফাঁকে তুমি অজস্র ধারায় প্রবাহিত করে দেবে নদী-নালা। অথবা তুমি যেমন বলে থাকো, সে অনুযায়ী আকাশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে আমাদের উপর ফেলবে, অথবা আল্লাহ ও মালায়েকদেরকে আমাদের সামনে উপস্থিত করবে, অথবা তোমার একটি সোনার তৈরি ঘর হবে, অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে, কিন্তু তোমার আকাশ আরোহণে আমরা কখনো ঈমান আনবো না যতক্ষণ তুমি আমাদের প্রতি এক কিতাব নাযিল না করবে যা আমরা পাঠ করব।’ তাদের সমুদয় দাবির জবাবে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বললেন, ‘বলুন, পবিত্র মহান আমার রব! আমি তো হচ্ছি শুধু একজন মানুষ ও রসুল।’ (বনি ইসরাইল: ৯০-৯৩)।
আসলে মো’জেজা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ারে। আল্লামা যফর আহমদ উসমানী তার আহকামুল কুরআনে লিখেছেন- মো’জেজা নবী ও রসুলদের ইচ্ছাধীন নয় যে, তারা ইচ্ছা হলেই তা দেখাতে পারবেন। (খ. ১, পৃ. ৩৯-৪০)
Gospel of Barnabas- এ ঈসা (আ.) বলছেন, “আমি কি মৃত জীবিত করি? আল্লাহ আমাকে আদেশ করেন- ঈসা! তুমি অমুক মৃত লোককে আদেশ কর জীবিত হবার জন্য। আমি ঐ মৃতের কাছে যেয়ে আদেশ করি জীবিত হয়ে ওঠার জন্য। সে লোক জীবিত হয়ে ওঠে। জীবিত করেন আল্লাহ। আমি তো শুধু তাঁর আদেশ পালন করি।”
নবী-রসুল ছাড়াও কি মোজেজা হতে পারে?
পাঠক, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি। যেমন, মো’জেজা শব্দটি যেহেতু পবিত্র কোর’আন ও হাদিসে নেই এবং কোর’আনে এ বিষয় বোঝাতে আয়াত, বোরহান শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, সুতরাং কোর’আনে ব্যবহৃত আয়াত শব্দটি যে যে ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, মো’জেজা শব্দটিও সেসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়া যুক্তিসঙ্গত। কোর’আনে ব্যবহৃত “আয়াত” শব্দটি কেবল নবী-রসুলদের জন্য খাস নয়, সুতরাং মো’জেজা শব্দটিও শুধু নবী-রসুলদের জন্য খাস মনে করা ভুল হবে। দ্বিতীয়ত-এ বিষয়ে সকল মাজহাবের আলেমদের ঐকমত্য রয়েছে যে ইমাম মাহদি (আ.) ও ঈসা (আ.) নবী হিসাবে নয় বরং আখেরি নবীর উম্মত হিসাবে দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন। তাঁদের দুজনের দ্বারাই বহু অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হবে, অথচ তারা কেউ নবী-রসুল নন। এখন যদি আমরা বলি মো’জেজা কেবল নবী-রসুলদের জন্যই খাস, তাহলে ইমাম মাহাদী ও ঈসা (আ.) এর মাধ্যমে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটবে, সেগুলোকে আমরা কী বলব?
পরিশেষে বলতে হয়, এই মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র অনু-পরমাণু থেকে আরম্ভ করে কোটি কোটি আলোকর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে প্রাকৃতিক আইনের ভিত্তিতে। এই আইন লঙ্ঘন করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র যিনি এই আইনের স্রষ্টা, তিনিই এখতিয়ার রাখেন আইনের ঊর্ধ্বে উঠে এমন কিছু ঘটানোর, যা সাধারণের পক্ষে অসম্ভব। নবী-রসুলদের সত্যতা প্রমাণের জন্য মহান আল্লাহ যুগে যুগে বহু অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন যাতে তাঁর প্রেরিত নবী-রসুলদের ব্যাপারে মানুষের কোনো সন্দেহ না থাকে এবং নবী-রসুলদেরও আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় হয়। আবার কখনও তাঁর কোনো বান্দাকে রক্ষা করার জন্য (আসহাবে কাহফের ঘটনা), কখনও অত্যাচারী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য (হস্তি বাহিনীর ঘটনা) আল্লাহ অলৌকিকভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন, যা নিঃসন্দেহে ছিল আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন। আল্লাহ যেহেতু পবিত্র কোর’আনে সব ধরনের নিদর্শনকেই আয়াত শব্দ দ্বারা প্রকাশ করেছেন, কাজেই আমাদেরও উচিত হবে মো’জেজা শব্দকে কেবল নির্দিষ্ট অর্থে সীমাবদ্ধ না করে আল্লাহর সব ধরনের অলৌকিক ঘটনাকেই মো’জেজা শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা।
আর কোনো নবী-রসুল আসবেন না। নবুয়্যতের রাস্তা বন্ধ। কিন্তু আল্লাহর নিদর্শনের রাস্তা তো বন্ধ হয়নি, অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়নি। আল্লাহ এখনও তাঁর কোনো বান্দাকে রক্ষা করার জন্য, সত্যায়ন করার জন্য, সাহায্য করার জন্য, বা মানবজাতিকে কোনো সত্য উপলব্ধি করানোর জন্য অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারেন। নিঃসন্দেহে তা হবে আল্লাহর মো’জেজা, তাই নয় কি? আজকের এই প্রবন্ধ থেকে আশা করি বিজ্ঞ আলেমরা সেই চিন্তার খোরাক পাবেন।
[লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭১৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...