হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

মুসলিমরা আজ সংকটের সম্মুখীন

শামীমা আক্তার

পৃথিবী সম্পর্কে যারা কিছুমাত্র খবরও রাখেন তারা এ কথা শুনে নিশ্চয়ই আঁতকে উঠবেন না যে, আজ মুসলিম বিশ্বের সম্মুখে বিরাজ করছে এক ভয়াবহ সংকট। বেশিদূর যেতে হবে না, গত এক শতকের চিত্র দেখলেই বুঝা যায় মুসমানদের অবস্থা। একের পর এক মুসলিম দেশগুলো ধ্বংস করে দখল করে নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা। বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো মুসলমানদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য একজোট হয়েছে। বর্তমানে হত্যাযজ্ঞ চলছে ফিলিস্তিনে, যা মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই শুরু হয়েছে। বিগত ছয়মাসে ফিলিস্তিনের মাটি এখন যেন এক মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। ফিলিস্তিনের মুসলিমদের উপর ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হামলা ও আক্রমণ, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে হামাসের হামলায় ইসরায়েলের প্রায় ১ হাজার ২০০ জন মানুষ নিহত হলে ইসরায়েল গাজায় পাল্টা হামলা চালায় যা এখনও চলছে। তারা এ পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজার ৯১ জন বেসামরিক সাধারণ ফিলিস্তিনি মুসলমানকে হত্যা করেছে। হামলায় আহত হয়েছে ৭৫ হাজার ৮১৫ জন। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় ৪০ শতাংশই নিরপরাধ শিশু ও নারী।
এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও গত ছয় মাসে অবর্ণনীয় তাণ্ডবে গাজার অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়িঘর, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ৩৯২টি স্থাপনা, ১৮৪টি মসজিদ মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। গাজার ৩৬টি হাসপাতালের ২৪টির বেশি সেবা দিতে পারছে না। এমনকি পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবার এবং পবিত্র শবে কদরের রাতে মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদের প্রবেশদ্বার নিয়ন্ত্রণ করে নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনি। এদিকে ছয় মাস পার হলেও হত্যাযজ্ঞ বন্ধের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। গত নভেম্বরের পর নতুন যুদ্ধবিরতির সব আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হলেও তা নাকচ করে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। জাতিসংঘের সমালোচনা করে নেতানিয়াহু সরকার বলেছে, কেউ পাশে না থাকলেও গাজায় হামলা চালিয়ে যাবে তারা। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত তারা থামবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম দেশের উপর তাদের এই বর্বরোচিত হামলার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবে হামাস নির্মূল করা নাকি, মুসলিম নিধন?
নয়াদিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে যে অর্থনৈতিক করিডোরের কথা ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন; সেই করিডোরের মাধ্যমে ভারত, পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে যুক্ত করা হবে রেল ও সমুদ্রপথে। আর এ নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে ইসরায়েল, যাকে বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পোষ্য পুত্র। এখনও মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় একঘরে ইসরায়েল এই সম্ভাব্য করিডোরের মাধ্যমে ওই বিচ্ছিন্নতাকে পুরোই কাটিয়ে উঠতে চাচ্ছে। এ কারণে করিডোরের ধারণাটি প্রকাশের পরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু প্রবল উচ্ছ্বাসভরে প্রকল্পটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইসরায়েলি অনলাইন পোর্টাল ওয়াইনেট নিউজ বলছে, প্রকল্পটির ধারণা নাকি ইসরায়েল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে গেছে; এক পর্যায়ে যা ভারতকেও জানানো হলে দেশটি তা লুফে নেয়। আর এটি হলো মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি মাস্টার প্ল্যান। এই পরিকল্পনাটি সফল হওয়ার পর পরবর্তীতে ইসরায়েলের পরিকল্পনা হতে পারে লোহিত সাগর থেকে ইউরোপে বাণিজ্যিক পথ নিয়ন্ত্রণ। এতে মিশর এবং সৌদি আরবের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ হবে। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার যে স্বার্থ রয়েছে সেটা অর্জিত হবে। অন্যদিকে সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা এখনো সিরিয়ায় ফিরতে পারেনি, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুরা এখন উদ্বাস্তু রয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে লিবিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিনের নতুন উদ্বাস্তু যোগ হয়ে জাতিসংঘের হিসাবমতে মোট উদ্বাস্তু দাঁড়িয়েছে মোট ১১ কোটি। বাংলাদেশেও মিয়ানমারের ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু রয়েছে।
ভয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে, ২২ মার্চ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ক্রোকাস সিটি কনসার্ট হলের হামলায় ১৩৯ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং হামলার পর দায় স্বীকার করে জঙ্গি-গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। হামলাটি গত ২০ বছরের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা। এ ঘটনার পর রাশিয়ার জনগণের মধ্যে একটি ইসলাম বিরোধী ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক যেমনটা সৃষ্টি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার হামলার পর। সেই হামলাকে পুঁজি করেই প্রেসিডেন্ট বুশ আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল। একটি বিষয় সকলেরই জানা যে, পরাশক্তিধর প্রভুরা মুসলমান দেশগুলোকে আক্রমণ চালানোর পূর্বে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী, উগ্রবাদী, মানবতাবিরোধী ইত্যাদি তকমা ব্যবহার করে। গত শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক ব্লক যখন বিশ্বের কর্তৃত্বের আসন দখল করে তখন রাশিয়ার সমাজতন্ত্র অনেকটাই নিষ্ক্রীয় ছিল, যদিও একটি স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। নব্বই দশকের পর তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা মুসলিমদেরকে দাঁড় করিয়েছে। এক্ষেত্রে হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব তাদেরকে ইন্ধন যুগিয়েছে।
এটি কারো অজানা নয় যে সাম্রাজ্যবাদীদের সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হচ্ছে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণা। সেজন্য কোনো হামলার আগে তারা পটভূমি রচনা করে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে। এভাবে তারা হামলার পক্ষে জনমত তৈরি করে। তাদের মিডিয়াগুলো একচেটিয়াভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা করে। মুসলিমরা সন্ত্রাসী, মোহাম্মদ (সা.) সন্ত্রাসী, কোর’আনে সন্ত্রাসের কথা বলা হয়েছে ইত্যাদি অপপ্রচার করে পাবলিক সেন্টিমেন্টকে ইসলামের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়। আর ঠিক এরপর মুসলিমদের উপর হামলা চালানো হয়, নিরীহ নারী ও শিশুদের হত্যা করা হয়, নগর-বন্দর ধ্বংস করা হয়। আর এসব নৃশংশতার প্রতিবাদ হামলাকারী দেশগুলোর জনসাধারণ বা পশ্চিমা জনসাধারণ কখনো করে না।
এবার আসি বাংলাদেশের সংকট প্রসঙ্গে। আসামের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনস (এনআরসি) তালিকায় চূড়ান্তভাবে বাদ পড়ে ১৯ লাখ ৬ হাজার জনগোষ্ঠী। বাদ পড়া এই মানুষগুলো নিজেদেরকে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণে ব্যর্থ হলে তাদেরকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো বা বাংলাদেশে পুশব্যাক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যদিও নানা কারণে এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি, কিন্তু হতে পারে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাংলাদেশকে সেই অভিজ্ঞতাই দিয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই যে মুসলিমদের উপর হামলা হচ্ছে এবং সংঘাতের আশঙ্কা দানা বাঁধছে, চারদিক থেকে সংকট তাদের ঘিরে ধরছে এই অবস্থা থেকে এখন মুসলিমরা বাঁচবে কিভাবে? এই মহাসঙ্কট থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? ধ্বংসের হাত থেকে কে বাঁচাবে মুসলমানদের? দেখা যায়, যখন মুসলমান দেশগুলোর উপর যুদ্ধ বা বিপদ নেমে আসে তখন তারা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকে। অথচ তাদের জাতীয় জীবনে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ নন, আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা সেখানে কার্যকর নেই, এমনকি কার্যকর করার চেষ্টাও নেই। তারা মানুষের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করেই তাদের জীবন পরিচালিত করছে। এমন অবস্থায় আল্লাহর সাহায্য আশা করা যায় কি? আল্লাহর সাহায্য আসবে মো’মেনদের জন্য। এ জাতি তখনই মো’মেন হবে যখন তারা আল্লাহকে তাদের জীবনের একমাত্র হুকুমদাতা, সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক বলে মেনে নেবে এবং জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম-বিধান প্রতিষ্ঠা করতে সংগ্রাম করবে। তাই এখন এই সংকটময় অবস্থা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়, মুসলমানদের আল্লাহর তওহীদের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না।
[লেখক: শিক্ষার্থ, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...