মানবজাতির ইতিহাসে যত বিপর্যয় ঘটেছে তার পেছনে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস বিজড়িত রয়েছে। পৃথিবীর বহু বড় বড় জাতি মোনাফেকদের কারণে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, স্বকীয়তা সব হারিয়ে গোলামীর জিঞ্জির পরতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় প্রায় ২০০ বছর ইংরেদের দাসত্ব করতে বাধ্য হয়েছিল তার পেছনেও ছিল মীর জাফরসহ বহু কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক। ইসলামের ইতিহাসে মোনাফেকদের সর্দার হিসাবে কুখ্যাত চরিত্রের নাম আবদাল্লাহ ইবনে উবাই।
আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পরিচয়: ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রে জন্ম নেয় আব্দাল্লাহ ইবনে উবাই। শৈশবে অন্য দশজন শিশুর মতো বেড়ে উঠলেও তার মধ্যে ছিল মানুষকে সহজে আকর্ষণ করার মতো অনেক বৈশিষ্ট্য। কৈশোর থেকেই সে সমাজের নেতৃত্ব লাভ করেছিল। ক্রমেই ইয়াসরিবের একজন ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে সে প্রাধান্য বিস্তার করে। গোত্রীয় লোকজন নিজেদের ছোট-বড় সমস্যা নিয়ে হরহামেশাই তার দ্বারস্থ হতো। সে আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে এমনভাবে বিবাদ মীমাংসা করত যে, অনেকটা বানরের রুটি ভাগ করার মতো। আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় দীর্ঘদিন ধরে বুয়াসের যুদ্ধে একে অপরের মোকাবেলা করছিল। এই যুদ্ধে উভয় গোত্রের খ্যাতনামা সরদারদের অনেকেই নিহত হয়। তারা বার বার এই বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে চাইলেও আবদাল্লাহ ইবনে উবাইসহ কতিপয় ইহুদি নেতৃবৃন্দের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠে নি। যখনই বিবাদ মীমাংসা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিত ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে তা ছাইচাপা আগুনের মতো আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। এই পরিস্থিতিতে আবদাল্লাহ ইবনে উবাই ইয়াসরিবে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির কোন সুযোগই হাতছাড়া হতে দেয় নি। ইয়াসরিববাসীগণ তাকে তাদের সর্বসম্মত নেতারূপে ঘোষণার উপক্রমও করছিল। এমনকি তার অভিষেকের উদ্দেশ্যে একটি মুকুটও তৈরি করছিল। এমনি সময় তথায় রসুলাল্লাহর আবির্ভাব ঘটে এবং আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের বাদশাহী ও সরদারীর স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যায়।
রসুলাল্লাহর মদিনায় আগমন: মক্কার কোরায়েশদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও হজ্বের মওসুমে আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষজন রসুলাল্লাহর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। তেমনিভাবে ইয়াসরিবের আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের কতিপয় লোকেরাও রসুলাল্লাহকে (সা.) দেখলেন, তাঁর কথা শুনলেন। তাদের মনের গহীনে রেখাপাত করলো যে, এই সোনার মানুষটিকে যদি মদিনায় নেওয়া যায় তাহলে তাদের উভয় গোত্রের সুদীর্ঘ বছর থেকে চলতে থাকা বুয়াস যুদ্ধের একটা সুরাহা করা যাবে। তারা রসুলাল্লাহকে আমন্ত্রণ জানালেন। রসুলাল্লাহও সময় পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সর্বোপরি আল্লাহর হুকুমে তাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন। অবশেষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে প্রিয়নবী মোহাম্মদ (সা.) ইয়াসরিবে আগমন করলে সেখানকার অধিবাসীগণ তাঁকে স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে চলতে থাকা রক্তক্ষয়ী বুয়াস যুদ্ধের অবসান ঘটে। মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে সেখানে তিনি একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সেই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাচিত হন।
মোনাফেকী শুরু: রসুলের আগমনে ইয়াসরিববাসী এতই আহ্লাদিত যে, তারা নিজেদের জন্মভূমির নাম পরিবর্তন করে মদিনাতুন্নবী রেখেছে। রসুলাল্লাহকে মনেপ্রাণে সবাই গ্রহণ করলেও মেনে নিতে পারে নি মদিনার অধিবাসী আবদাল্লাহ ইবনে উবাইসহ কতিপয় লোক। তারাও জনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে লোক দেখানোর ইসলাম গ্রহণ করে। মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও, লোক দেখানো ইসলামের অনুশাসন পালন করলেও ভিতরে ভিতরে তারা ইসলামের সাধনে লেগে গেল। মক্কায় ইসলামের শত্রু ছিল কোরায়েশ মোশরেকরা আর মদিনায় ইসলামের শত্রু হিসেবে দেখা দিল আবদাল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার নেতৃত্বে গড়ে উঠা মোনাফেক দল। সে অতি গোপনে মদিনার অন্যান্য ইহুদি গোত্রের সাথে হাত মিলালো এবং মক্কার কোরায়েশদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। মোনাফেক, ইহুদি ও কোরায়েশ ঐক্যজোট হয়ে ইসলামকে সমূলে ধ্বংস করার চেষ্টায় মেতে উঠল। সংঘটিত হলো বদরের যুদ্ধসহ ছোট বড় অনেক ঘটনা দুর্ঘটনা। অতঃপর ইসলামের বিজয় হলো, অপশক্তি পরাজিত হলো, ঘোষিত হলো: সত্য সমাগত, মিথ্যা দূরীভূত, নিশ্চয়ই মিথ্যা দূর হবারই (সুরা বনি ইসরাইল- ৮১)।
আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের রসুল ভক্তি: রসুলাল্লাহর মদিনা আগমনের পরে অন্যান্যদের সাথে আবদাল্লাহ ইবনে উবাইও তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল। সে রসুলাল্লাহর পিছনে সালাহ কায়েম করত, প্রথম কাতারে থাকত, যুদ্ধের ময়দানেও গিয়েছিল। কিন্তু রসুলাল্লাহর আদর্শকে অন্তরে ধারণ না করার কারণে শেষ পর্যন্ত মোনাফেক সরদার হিসাবেই স্বীকৃতি পায়। আরবের ঐ জাতিদের অনেকে যমযমের পানি শুধু খাওয়া নয়, তা দিয়ে তারা গোসলও করেছিল তারপরেও তারা পবিত্র হয় নি। কারণ, তাদের অন্তর নাপাকিতে পরিপূর্ণ ছিল।
আনসার ও মোহাজেরদের মধ্যে বিবাদের চেষ্টা: যখন মক্কা থেকে কেরে মোহাজেরগণ মদিনায় আগমন করলেন তখন তাদেরকে মদিনার আনসারগণ আপন রক্ত-সম্পর্কীয় ভাইয়ের চেয়েও বেশি আপন করে নিয়েছিল। থাকা, খাওয়া, বাসস্থান ইত্যাদিসহ সর্বদিকে সর্বোচ্চ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আনসার ও মোহাজেরদের এই ভ্রাতৃত্বকে প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যুতে নষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকতো এই মোনাফেক দল। যাদের নেতৃত্বে ছিল আবদাল্লাহ ইবনে উবাই। প্রায়ই কথায় কথায় মোহাজেরদিগকে ইতর, ছোটলোক, মক্কা থেকে পলায়নকৃত ইত্যাদি বলে অপমান করার চেষ্টা করা হতো।
ওহুদ যুদ্ধ: বদরের যুদ্ধে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর মুসলিমগণ খুশিতে আত্মহারা হলেও খুশি হোতে পারে নি আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দল। তার কপটতা ধরা পড়ে ওহুদ যুদ্ধের সময়। হেজরির ৩য় সনে যখন ওহুদ যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো তখন রসুলাল্লাহ তাঁর সাহাবিদেরকে নিয়ে এক পরামর্শ সভায় বসলেন। সভায় আনসার মোহাজের প্রত্যেকে নিজ নিজ মন্তব্য প্রকাশ করলেন। তেমনি আবদাল্লাহ ইবনে উবাইও একটি মন্তব্য প্রকাশ করলো। সর্বসম্মতিক্রমে রসুলাল্লাহ ১৪ শওয়াল শুক্রবার জুম্মার সালাহ কায়েম করে মদিনা থেকে তিন মাইল উত্তরে অবস্থিত ওহুদের উদ্দেশ্যে এক হাজার সৈন্যের নেতৃত্ব দিয়ে রওনা হলেন। দেড় মাইলের মতো পথ অতিক্রম করার পর আবদাল্লাহ ইবনে উবাই তার মতামতকে কেন গ্রহণ করা হলো না এই অযৌক্তিক অজুহাত তুলে তিন শ’ মোজাহেদ নিয়ে মদিনায় ফিরে গেল। ওহুদে কি ঘটেছিল তা ইতিহাসের অংশ। সেখানে যে যুদ্ধ হয়েছিল তা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সাত শ’ লোক নিয়েই ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হলো, এর মধ্য দিয়ে মোনাফেক সরদারের চেহারা উন্মোচিত হলো। এ যুদ্ধ থেকে ফিরে যাবার ঘটনায় মুসলমানদের মধ্যে কারা মোনাফেক ও দুর্বল ঈমানদার তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য বিশ্বনবী মোহাম্মাদ (সা.) মোনাফেকদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং তাদেরকে তাদের নীতি ও আচরণ পরিবর্তন করতে ও পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন।
বনু নাজিরের উৎখাত: একদা রসুলাল্লাহ আমর ইবনে উমাইয়া (রা.) কর্তৃক নিহত বনু আমীরের লোক দু’টির রক্তপণ আদায়ের ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়ার জন্য তাদের মিত্র গোত্র বনী নাজিরের কাছে গেলেন। তখন তারা বলল: হে আবুল কাসিম! আপনি যেহেতু বিভিন্ন ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করছেন সেহেতু এ ব্যাপারে আমরাও আপনাকে সাহায্য করব। এ সময় তিনি তাদের একটি ঘরের দেওয়ালের পাশে উপবিষ্ট ছিলেন। এ সময় তারা রসুলাল্লাহকে ঘরের ছাদের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলো। ঠিক এই মুহূর্তে রসুলাল্লাহকে আল্লাহ কর্তৃক বনু নাজিরের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে অবহিত করা হলো এবং তিনি সাথে সাথে সেখান থেকে প্রস্থান করে মদিনায় চলে আসলেন। এসেই সাহাবিদেরকে বনু নাজিরের উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন এবং যথা সময়ে বনু নাজিরকে অবরোধ করলেন। এ সময় মোনাফেক নেতা আবদাল্লাহ ইবনে উবাইসহ খাজরাজ গোত্রের কতিপয় ব্যক্তি বনু নাজিরের কাছে এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে, ‘তোমরা অবিচল থাক এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও, আমরা কিছুতেই তোমাদের পরিহার করব না, তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদেরকে সক্রিয় সহযোগিতা করব, তোমাদের বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বের হয়ে যাবো।’ সে মতে বনু নাজির তাদের সাহায্যের আশায় থাকলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত মোনাফেকদল তাদের কোন সাহায্য করতে পারলো না।
খন্দকের যুদ্ধ: চতুর্থ হেজরীতে খন্দকের যুদ্ধের সময়ে মক্কাবাসীসহ আরবের বিখ্যাত অনেক গোত্রই নবগঠিত মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে মদিনা অবরোধে অংশ নেয়। মদিনার সার্বভৌমত্বের বিষয়ে ইহুদিদের সাথে রসুলাল্লাহর মদিনা-সনদ নামে যে চুক্তি ছিল সেই মোতাবেক ইহুদিরা নামমাত্র অংশ নিলেও মোনাফেকদের অপতৎপরতায় তারা শত্রুপক্ষের সাথে গোপন চুক্তি করে, যে কারণে ইহুদিরা খন্দকের যুদ্ধে সার্বিক সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে। এই বিশ্বাসঘাতকার কারণেই বনী কোরায়জার অভিযান জরুরি হয়ে পড়ে।
বনী মোস্তালিক যুদ্ধ: এমনি চেহারা উন্মোচিত হয়েছিল ৫ম হিজরিতে সংঘটিত বনু মুস্তালিক যুদ্ধে। এই যুদ্ধে আবদাল্লাহ ইবনে উবাইসহ কিছু মোনাফেক অংশগ্রহণ করে। এখানেও সে শঠতার মাধ্যমে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টির অপপ্রয়াসে মত্ত হয়। একটা কূপের পানি উত্তোলনকে কেন্দ্র করে একজন মোহাজের জাহজাহ ও একজন আনসারী সিনান ইবনে জুহানীর (রা.) এর মধ্যে সামান্য বাকবিতণ্ডা হয়। এই ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে আবদাল্লাহ ইবনে উবাই মোহাজের ও আনসারদের বিবাদ উসকে দেবার অপপ্রয়াস চালায়। সে বলল যে, ‘তারা আমাদের দেশে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা সৃষ্টি করছে এবং আমাদের উপর মাতব্বরি ফলাচ্ছে। আল্লাহর কসম! এই কোরায়েশ ইতরদের আসকারা দিয়ে আমরা পূর্ববর্তী মুরব্বীদের ঐ প্রবাদ বাক্যের মতোই কাজ করছি যাতে তারা বলতেন, তুমি তোমার কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা কর যেন সে শেষ পর্যন্ত তোমাকেই খায়। আল্লাহর কসম! এবার যদি মদিনায় ফিরে যাই আমাদের মধ্যে সম্মানিতরা অপদস্থ ইতরদের অবশ্যই সেখান থেকে বের করে দিবে।” এই ঘটনাটি রসুলাল্লাহর কানে আসলে তিনি কাউকে কিছু না বলে রাজনৈতিক কারণে বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন এবং কাফেলাকে তৎক্ষণাৎ মদিনার দিকে যাত্রা করার নির্দেশ দিলেন। যদিও এমন অসময়ে তিনি কখনো কোথাও যাত্রা করেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই কথাটি প্রায় সব সাহাবিদের কানে পৌঁছে গেল। যখনই আবদাল্লাহ ইবনে উবাই শুনলো যে, বিষয়টি রসুল জানতে পেরেছেন সাথে সাথে সে তাঁর নিকট এসে আল্লাহর নামে হলফ করে বলল যে, ‘ওরা যা বলেছে, আমি তা বলি নি’ উক্ত বিষয়ে প্রখ্যাত সাহাবি উসায়দ ইবনে হুজায়র রসুলাল্লাহকে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! এর প্রতি একটু নম্র আচরণ করলেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে এমন সময় আমাদের মধ্যে নিয়ে এলেন, যখন তার স্বজাতি তার জন্যে মতির মালা তৈরি করেছিল যে, তারা তাকে সম্মানিত করলেব। যা পরে আর বাস্তবায়িত হয় নি। তাই সে ধারণা করেছে যে, আপনি তার রাজত্বটি ছিনিয়ে নিয়েছেন।’
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের বিরুদ্ধে রসুলের কৌশল: বনী মোস্তালিক যুদ্ধে শত্রুদেরকে সামাল দিয়ে আসামাত্র যায়েদ ইবনে আকরাম (রা.) রসুলাল্লাহ ও মোহাজেরদেরকে উদ্দেশ্য করে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের বলা কথাগুলো রসুলাল্লাহর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন পাশে থাকা ওমর (রা.) সাথে সাথে রসুলাল্লাহকে বললেন, “ইয়া রসুলাল্লাহ! আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে হত্যার জন্য আব্বাদ ইবনে বিশরকে নির্দেশ দেন।” তখন রসুলাল্লাহ বললেন, “লোকে বলাবলি করলেব মোহাম্মদ তার সঙ্গীদেরকে হত্যা করে থাকেন, তখন কেমন হবে? হে ওমর! তা হতে দেওয়া যায় না, বরং এখন শিবির তুলে যাত্রা করার কথা ঘোষণা করে দাও।” ওমর (রা.) তাই করলেন, এই ঘোষণার পর লোকেরা যাত্রা করার জন্য তৈরী হয়ে গেল এবং যাত্রা শুরু করলো। প্রকৃত পক্ষে এই মোনাফেক সর্দারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হাজারো প্রমাণ থাকলেও সে যেহেতু মুখে মুখে নিজেকে মুসলিম বলে স্বীকার করে, এবং তার বড় একদল অনুসারীও রয়েছে, তাই রসুলাল্লাহ তার ব্যাপারে ধৈর্য অবলম্বন করেছেন, যেন এক সময় তার কপটতার মুখোস খুলে যায় এবং তার অনুসারীরাও তার মোনাফেকী ও ভণ্ডামি সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়ে যায়। যখন তার কীর্তিকলাপ প্রকাশ পেয়ে যাবে তখন তার ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার অনুসারীরা বিদ্রোহ করতে পারবে না।
আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ব্যাপারে ওহী এবং তার পুত্রের ভূমিকা: বনী মোস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে রসুলাল্লাহ পুরো দিন সফর অব্যাহত রাখলেন, এমনকি সন্ধ্যা হয়ে গেছে তবুও সারারাত যাত্রা অব্যাহত রাখলেন, পরের দিন ভোর হয়ে যায়, দিনের আলো দেখা দেয়, প্রখর রোদ্রের উত্তাপে তাঁদের কষ্ট হোতে থাকে। তারপরে রসুল যাত্রা থামালেন এবং সবাই বিশ্রাম নিল। আবদাল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার মতো মোনাফেকদের ব্যাপারে একটি সুরা নাযেল হলো যাতে আল্লাহ মোনাফেকদের স্বরূপ উদঘাটন করলেন। আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র আবদাল্লাহর কানেও সংবাদটি পৌঁছায়। সে রসুলাল্লাহর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আবেদন করলো যে, ‘ইয়া রসুলাল্লাহ! আমি যতদূর জানতে পেরেছি, আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ব্যাপারে আপনি যা অবগত হয়েছেন তাতে আপনি তাকে হত্যা করতে মনস্থ করছেন। আপনি যদি একান্তই তা করতে চান তাহলে আমাকে নির্দেশ দেন আমি তার মস্তক আপনার দরবারে এনে উপস্থিত করব। আল্লাহর কসম! খাজরাজের প্রত্যেকটি লোক জানে আমি খুব পিতৃভক্ত। আমার আশঙ্কা হয়, পাছে আপনি অন্য কাউকে এই আদেশ দেন, সে তাকে হত্যা করে লোক সমাজে ঘোরাফেরা করলেব, আর আমি মনকে স্থির না রাখতে পেরে তাকে হত্যা করে বোসবো, পরিণামে জাহান্নামে যাবো।’ তখন রসুলাল্লাহ বললেন, “আমরা বরং তার সাথে নম্র ব্যবহার করব এবং যাবৎ সে আমাদের সঙ্গে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে উত্তমভাবে সঙ্গ দিয়ে যাবো।”
আয়েশা (রা.) এর উপর অপবাদ রটনা: আম্মা আয়েশা (রা.) এর উপর অপবাদ রটানোর কাজেও এই মোনাফেকের ভূমিকা ছিল। বনী মোস্তালিক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি শেষে ফেরার পথে আয়েশা (রা.) প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হলেন, এসময় তার গলার হারটি হারিয়ে গেলে সেটি খুঁজতে গিয়ে আরও কিছু সময় দেরি হয়ে যায়। ঐদিকে তিনি হাওদার ভিতরে আছেন ভেবে কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল। তিনি বাহিনীর অবস্থান স্থলে ফিরে এসে যখন কাউকে দেখলেন না তখন গায়ে চাদর জড়িয়ে সেখানে শুয়ে পড়লেন এবং ভাবলেন যে, ‘যখন তারা তাকে খুঁজে পাবে না তখন অবশ্যই এখানেই খুঁজতে আসবে।’ এই অবস্থায় কাফেলার শেষ যাত্রী সাফওয়ান ইবনে মু’আত্তাল সালমী (রা.) যিনি এই দায়িত্বেই ছিলেন যে, সবার পেছনে চলবেন এবং ভুলক্রমে তাদের ফেলে আসা দ্রব্যাদি কুড়িয়ে আনবেন। যথারীতি তিনি আয়েশা (রা.) কে দেখতে পেলেন এবং তার উটের উপর আরোহণ করিয়ে মদিনায় নিয়ে আসলেন। এই ঘটনা প্রত্যেক্ষ করে অপবাদকারীরা যা বলার তা বলল। এই অপবাদের প্রচার ও প্রসারে আবদাল্লাহ ইবনে উবাই ও তার সঙ্গীসাথীবৃন্দ, কবি হাসসান বিন সাবিত (রা.), মিসতাহ ও হামনা বিনতে জাহাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন কোরল। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেও তখন আউস ও খাজরাজদের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
রসুলাল্লাহকে অপমান: একদা রসুলাল্লাহ কোন এক কারণে একটি গাধায় সওয়ার হয়ে আবদাল্লাহ ইবনে উবাইর নিকট উপস্থিত হলে সে রসুলাল্লাহকে বলল, ‘আপনি আমার থেকে দূরে থাকুন, আল্লাহর কসম! আপনার গাধার গন্ধ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে (বুখারী-২৪৯৬)।’
মসজিদে দেরার নির্মাণ: তাবুক অভিযানকালে মোনাফেকরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হয়। তখন তাদের মধ্যে একটি চুক্তি অনুযায়ী স্থির হলো যে, মদিনায় তারা নিজেদের একটি পৃথক মসজিদ তৈরি করে নেবে। এভাবে সাধারণ মুসলিমদের থেকে আলাদা হয়ে মোনাফেক মুসলিমদের এমন একটি স্বতন্ত্র জোট গড়ে উঠবে যা ধর্মীয় আলখেল্লায় আবৃত থাকবে। তার প্রতি সহজে কোন প্রকার সন্দেহ করা যাবে না। সেখানে শুধু মোনাফেকরাই সংঘটিত হবে এবং তাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য পরামর্শ করলেব। এ প্রসঙ্গে তারা রসুলাল্লাহর কাছে গিয়ে বলে যে, ‘বৃষ্টি বাদলের জন্য এবং শীতের রাতে সাধারণ লোকদের বিশেষ করে উল্লেখিত দুটি মসজিদ থেকে দূরে অবস্থানকারী বৃদ্ধ, দুর্বল ও অক্ষম লোকদের প্রতিদিন পাঁচবার মসজিদে হাজিরা দেয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই আমরা শুধুমাত্র নামাযীদের সুবিধার্থে এ নতুন মসজিদটি নির্মাণ করতে চাই।’ মুখে পবিত্র ও কল্যাণমূলক বাসনার কথা উচ্চারণ করে যখন এ “দেরার” (ক্ষতিকর) মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ করে তখন রসুলাল্লাহর দরবারে হাযির হয়ে সেখানে একবার সালাহ কায়েম করে মসজিদটির উদ্বোধন করার জন্য আবেদন জানালো। কিন্তু রসুলাল্লাহ বিষয়টি এড়িয়ে গেলেন এবং যথারীতি তাবুক অভিযানে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তাঁর রওয়ানা হওয়ার পর মোনাফেকরা এ মসজিদে নিজেদের জোট গড়ে তুলতে এবং ষড়যন্ত্র পাকাতে লাগলো।
এমনকি তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, ‘ওদিকে রোমানদের হাতে মুসলমানদের মুলোৎপাটনের সাথে সাথেই এদিকে এরা আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মাথায় রাজ মুকুট পরিয়ে দেবে।’ কিন্তু তাবুকে যা ঘটলো তাতে তাদের সে আশার গুড়ে বালি পড়লো। ফেরার পথে রসুলাল্লাহ যখন মদিনার নিকটবর্তী “যী আওয়ান” নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন এ মসজিদের ব্যাপারে আয়াত নাযেল হলো। তিনি তখনই মসজিদটি ভেংগে ধূলিসাৎ করার দায়িত্ব দিয়ে কয়েকজন লোককে মদিনায় পাঠিয়ে দিলেন। সাহাবিরা তাই করলেন। এই মসজিদ সম্পর্কেই পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেন: এবং যারা (মোনাফেকরা) মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতি সাধন, কুফরি ও মো’মেনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ইতোপূর্বে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি সংগ্রাম করেছে তার গোপন ঘাটিস্বরূপ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, তারা অবশ্যই শপথ করে বলবে, আমরা সদুদ্দেশ্যেই তা করেছি। আল্লাহ সাক্ষী, তারা তো মিথ্যাবাদী। (হে রসুল) আপনি এতে কখনও সালাতের উদ্দেশ্যে দাঁড়াবেন না, যে মসজিদের (মসজিদে কুবা) ভিত্তি প্রথম দিন হতেই স্থাপিত হয়েছে তাকওয়ার উপর, সেটাই আপনার সালাতের জন্য অধিক যোগ্য (তওবা- ১০৮)।
আবদাল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু ও জানাজা: তাবুক থেকে ফিরে আসার পর বেশি দিন যেতে না যেতেই ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে মোনাফেক নেতা আবদাল্লাহ ইবনে উবাই মারা গেল। তার ছেলে আবদাল্লাহ ইবনে আবদাল্লাহ ছিলেন নিষ্ঠাবান মো’মেন। তিনি রসুলাল্লাহর খেদমতে হাযির হয়ে কাফনে ব্যবহারের জন্য রসুলাল্লাহর একটি কোর্তা চাইলেন। রসুলাল্লাহ অত্যন্ত উদার হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে কোর্তা দিয়ে দিলেন। তারপর আবদাল্লাহ তাঁকেই জানাযা পড়াবার জন্য অনুরোধ করলেন। তিনি এ জন্য তৈরিও হয়ে গেলেন। উমর (রা.) বারবার আপত্তি জানাতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি এমন ব্যক্তির জানাযা পড়াবেন যে অমুক অমুক কাজ করেছে?’ কিন্তু হুজুর ওমরের এ সমস্ত কথা শুনে মুচকি হাসতে লাগলেন। তাঁর অন্তরে শত্রু মিত্র সবার প্রতি যে করুণার ধারা প্রবাহিত ছিল তারই কারণে তিনি ইসলামের এ নিকৃষ্টতম শত্রুর মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেও ইতঃস্তত করলেন না, যদিও তিনি জানতেন যে মোনাফেকদের জন্য সত্তরবার দোয়া করলেও আল্লাহ তা কবুল করলেন না।
শেষে যখন তিনি জানাযার সালাহ পড়াবার জন্য দাঁড়িয়েই গেলেন, তখন (সুরা তওবা- ৮০) নম্বর আয়াতটি নাযিল হলো এবং সরাসরি আল্লাহর হুকুমে তাঁকে জানাযা পড়ানো থেকে বিরত রাখা হলো। কারণ এ সময় মোনাফেকদের ব্যাপারে স্থায়ী নীতি নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলিমদের সমাজে মোনাফেকদেরকে আর কোন প্রকারে শিকড় গেঁড়ে বসার সুযোগ দেয়া যাবে না এবং এমন কোন কাজ করা যাবে না যাতে এ দলটির সাহস বেড়ে যায়। এর পর রসুলাল্লাহ নিয়ম করে নিয়েছিলেন যে, কোন জানাযার শরীক হবার জন্য তাঁকে ডাকা হলে তিনি প্রথমে মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, সে কেমন ছিল। যদি জানতে পারতেন সে অসৎ চরিত্রের অধিকারী ছিল, তাহলে তার পরিবারের লোকদের বলে দিতেন, তোমরা যেভাবে চাও একে দাফন করে দিতে পার। অন্য রেওয়াত মোতাবেক, মোনাফেক আবদাল্লাহ ইবনে উবাইকে কবরে রাখার পর রসুলাল্লাহর হুকুমে তার লাশ কবর থেকে তোলা হলো এবং তাঁর দু’হাঁটুর উপর তা রাখা হলে, নবী তাকে ফুঁ দিলেন ও আপন জামাটি পরিয়ে দিলেন (বোখারী- ৫৩৭১)।
উপসংহার: আবদাল্লাহ ইবনে উবাইদের ব্যাপারে কোর’আন হাদীস ইতিহাস সর্বত্র সতর্কতা অবলম্বন করার তাগিদ রয়েছে। মোনাফেকরা ছদ্মবেশী শত্রু, তাই প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে এই ছদ্মবেশী শত্রু অধিকতর বিপজ্জনক। পবিত্র কোর’আনে মোনাফেকদের নামে একটি স্বতন্ত্র সুরা রয়েছে। পরকালে মোনাফেকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে (সুরা নিসা- ১৪৫)।