মো. আবু ফাহাদ
এবাদত কি এ সম্পর্কে আমাদের জানতে হলে প্রথমে এবাদত শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে হবে। এবাদত শব্দটি ‘উবুদিয়্যাহ’ শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত। যার অর্থ আনুগত্য (obedience), নতি (submission), অবমানিত অবস্থা (humility) ইত্যাদি। অর্থাৎ এবাদত মানে হল নিরহঙ্কার চিত্তে আনুগত্য প্রদর্শন করা। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বিষয়টি বুঝতে পারব। সূর্যের কাজ কি? তাপ ও আলো দিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের স্পন্দন বজায় রাখা। আল্লাহ তার জন্য এই কাজ বরাদ্দ করে দিয়েছেন। এটাই সে একনিষ্ঠ আনুগত্যের সাথে পালন করে চলেছে। এটাই তার এবাদত। আবার আগুনের কাজ হলো পোড়ানো। এটা তার এবাদত। এককথায়, এবাদত হলো আল্লাহ যাকে যে কাজ দিয়েছেন, সে কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করা।
তাহলে মানুষের এবাদত কি? আল্লাহ সৃষ্টির মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই মালায়েকদের বলেছেন যে, তিনি পৃথিবীতে তার ‘খলিফা’ বা প্রতিনিধি সৃষ্টি করবেন। প্রতিনিধি বা খলিফার কাজ হলো তিনি যার প্রতিনিধি তাঁর অবর্তমানে ঠিক সেরকমভাবে কাজ পরিচালনা করা যেমনটি যার প্রতিনিধিত্ব করছেন, তিনি বর্তমান থাকলে করতেন। আল্লাহ এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন মানুষকে। যার অর্থ সৃষ্টিকে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত করা বা সৃষ্টির সেবা করা। তার দায়িত্ব হলো আল্লাহ থাকলে পৃথিবী যেমন শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনা করতেন ঠিক সেইভাবে পরিচালনা করা। যেখানে হবে শান্তিপূর্ণ সমাজ, যেখানে ফাসাদ (অন্যায়, অবিচার)-সাফাকুদ্দিমা (যুদ্ধ, রক্তপাত) কিছুই থাকবে না। এটাই তার এবাদত। ইবলিস আল্লাহকে এই চ্যালেঞ্জই দিয়েছিল যে মানুষকে দিয়ে সে ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমা করাবে। মানুষ আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। তাকে ও সমগ্র সৃষ্টিকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহ বেশকিছু বিধান (জীবনব্যবস্থা) যুগে যুগে পাঠিয়েছেন যেগুলোকে আমরা বলি ওহী বা আসমানি কেতাব। আমরা শেষ নবীর উম্মত, আর আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন আল কোর’আন। এটি গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিবে এবং সামগ্রিক জীবনে একে প্রয়োগ করে সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। মানুষকে এ জীবনবিধান দেয়ার কারণ হলো মানুষের জ্ঞান অতি ক্ষুদ্র। সে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাই সে তার এ জ্ঞানের সাহায্যে তার নিজের জন্য এমন একটা জীবনব্যবস্থা তৈরি করে নিতে পারবে না যা তাকে ও পুরো সৃষ্টিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করবে। কিন্তু আজ মানুষ ঐ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা বিধান ত্যাগ করে নিজেরা কিছু মনগড়া বিধান সংবলিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের মতো জীবনব্যবস্থা বানিয়ে সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করেছে, যার ফলে পৃথিবীতে ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমা লেগেই আছে ও দিন দিন ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। এভাবে মানুষ আল্লাহর বিধান ত্যাগ করে তার প্রকৃত এবাদত করা থেকে বিরত থাকছে এবং ইবলিসের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে পরাজিত করছে। ইবলিস আল্লাহকে এই চ্যালেঞ্জ করেনি যে, মানুষকে সে নামাজ-রোজা করতে বাধা দেবে। তার চ্যালেঞ্জ ছিল অন্য, মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকীম থেকে সরিয়ে ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমা অর্থাৎ অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত ঘটানো। যারা এ চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করাবে তারাই মো’মেন আর যারা ইবলিসকে জয়ী করাবে তারাই কাফের। এজন্যই আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম, ওতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবীগণ, রাব্বানীগণ (আল্লাহভক্ত) এবং পণ্ডিতগণও ইয়াহুদীদেরকে তদনুসারে বিধান দিত, কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল ওর (সত্যতার) সাক্ষী। সুতরাং তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর এবং আমার আয়াত নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করো না। আর আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই অবিশ্বাসী (কাফের)।” (সুরা মায়োদা, আয়াত ৪৪)। নামাজ-রোজা মানুষের ইবাদত নয়, এগুলো মানুষকে দেয়া হয়েছে যাতে করে মানুষ আল্লাহর দেয়া এবাদত যথাযথভাবে পালন করতে যে চরিত্র লাগে মানুষ সেই চরিত্র অর্জনে সমর্থ হয়। কিন্তু যে জন্য এইগুলো দেয়া, সেটাকেই ভুলে এগুলো করা আর উলুবনে মুক্তো ছড়ানো একই কথা। তাই মানুষকে তার লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তাকে কি জন্য বানানো হল? কি তার কাজ? কি তার এবাদত? এসবকিছু সম্পর্কে জানতে হবে। নতুবা মানুষ আল্লাহকে-ভগবানকে পাওয়ার জন্য মসজিদে-মন্দিরে গিয়ে নামাজ-রোজা-পূজা করতে থাকবে কিন্তু আল্লাহর বিধান সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ না করার ফলে অন্যায়-অবিচারÑঅশান্তি রক্তপাতে ডুবে থাকবে, যেমনটা গোটা মানবজাতি এখন করছে।
[কলামিস্ট: সদস্য, সাহিত্য বিভাগ, হেযবুত তওহীদ]