রাকীব আল হাসান
আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ চান তাঁর প্রিয় সৃষ্টি মানুষ যেন অন্যায়, অবিচার, অশান্তির মধ্যে পতিত না হয়। তারা যেন সুখ-শান্তির মধ্যে বসবাস করতে পারে। মানুষের জন্যই তিনি এই পৃথিবীকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সজ্জিত করেছেন আর নিয়ামত স্বরূপ দিয়েছেন আলো, পানি, বাতাস, বৃক্ষরাজি, তরুলতা, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী, পশু-পাখি, ফুল-ফল, শস্য ইত্যাদি। মানুষের স্বাভাবিক প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু দেওয়ার পর এই পৃথিবীকে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি ও শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার দায়িত্ব আল্লাহ পাক এই মানুষকেই দিলেন। মানুষকে আল্লাহ বানালেন তার প্রতিনিধি, খলিফা। (সুরা বাকারা- ৩০)।
কিন্তু এই পৃথিবী পরিচালিত হবে কীভাবে? কোন নীতি অনুসরণ করে চললে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি হবে না? পৃথিবী পরিচালনার বিধান কী হবে? মানবসমাজ পরিচালনার বিধান কি মানুষ নিজেই তৈরি করে নেবে, নাকি আল্লাহ পাক এই পৃথিবী পরিচালনার জন্য মানুষকে একটি নিখুঁত বিধান দিবেন?
এ কথা সকল যুক্তির ঊর্ধ্বে যে, কোনো জিনিসের স্রষ্টাই ঐ জিনিসের ন্যায়সঙ্গত বিধাতা। কারণ যিনি সেটা সৃষ্টি করেছেন তার চেয়ে ঐ জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণ, ব্যবহার, পরিচালনা-পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এইজন্য তিনি একটি জীবনবিধান পাঠিয়েছেন। আল্লাহর প্রদত্ত এই জীবনব্যবস্থারই নাম হচ্ছে দীনুল হক বা সত্য দীন অর্থাৎ ইসলাম। ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণ আল্লাহ পাঠিয়েছেন তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল মোহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে। আল্লাহ তাঁকে এই দীনটি সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাঁকে এই দায়িত্ব অর্পণের পর ধারণাগতভাবে এই পৃথিবীতে প্রচলিত সকল জীবনব্যবস্থা, বিধি-বিধান মানবজাতির ন্যায়সঙ্গত বিধাতা আল্লাহ কর্তৃক বাজেয়াপ্ত (Banned) ঘোষিত হয় এবং রসুলাল্লাহ হয়ে গেলেন পৃথিবীতে তখন আল্লাহ’র পক্ষ থেকে একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ। এজন্যই আল্লাহ তাঁর রসুলকে বলেছেন এই ঘোষণা দেওয়ার জন্য যে, ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসুল’ (সুরা আরাফ ১৫৮)। যেহেতু এই সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা ও মালিক (রাজা) আল্লাহ, কাজেই এখানে স্রষ্টা ও মালিকের বিধানই কার্যকরী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। যখনই মানুষ আল্লাহর বিধান প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের মনমতো চলবে, নিজেদের তৈরি করা বিধান দিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে তখনই অন্যায়-অবিচারে-অশান্তি সৃষ্টি হবে। যেমন আজ পৃথিবীব্যাপী হচ্ছে।
মানুষের প্রতি মানুষের স্রষ্টা, প্রভু ও বিধাতা আল্লাহর কথা, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের আদেশকারীর (আমীর)’ (সুরা নিসা ৫৯)। তাহলে, “তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে (সুরা আহযাব ৭১)”।
দ্বিতীয়ত আল্লাহ বলেন, “সৃষ্টি যার বিধান তার (সুরা আরাফ-৫৪)।” অতএব যারা আল্লাহর সৃষ্টি পৃথিবীতে বসবাস করে আল্লাহকে বিধাতা মানতে চায় না, তাদের প্রতি আল্লাহর কথা, “নভোম-ল ও ভূম-লের প্রান্ত অতিক্রম করো যদি তোমাদের সাধ্যে কুলায় (সুরা রহমান ৩৩)। প্রভুর এই ঘোষণা মোতাবেক পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান বৈধ নয়। যেহেতু আল্লাহই সকলকে সৃষ্টি করে তাদের আহার, বাসস্থান, আলো, পানি, বায়ু সমস্তকিছু নিরন্তরভাবে যোগান দিয়ে যাচ্ছেন, তাই এখানে তিনি ছাড়া আর কারও বিধান বৈধ হতে পারে না। যারা অন্য কোন বিধান দিয়ে পৃথিবী চালাতে চায় তাদের উচিত নিজেরা একটি অনুরূপ নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করা, সেখানে মানবজাতির বিকাশ ঘটানো এবং তাদের লালন পালনের যাবতীয় বন্দোবস্ত করা, আলো, পানি, বায়ু, খাদ্য সরবরাহ করা, অতঃপর তাদের বিধাতা হিসাবে নিজেদের তৈরি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি দিয়ে তাদেরকে শাসন করা। এখানে যারা আল্লাহর হুকুম দিয়ে শাসন করবে না তারা আল্লাহর ভাষায় কাফের জালেম ও ফাসেক অর্থাৎ হুকুম অস্বীকারকারী, অন্যায়কারী, অবাধ্য (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)। একজন প্রতাপশালী সম্রাট তার হুকুম অমান্যকারী, অবাধ্য প্রজাদের বেলায় যে কাজটি করে থাকেন আল্লাহও সেটাই করবেন, সেটা হচ্ছে তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া। এটাই আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যখন কোন জনপদ ধ্বংস করতে চাই তখন তার সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিদেরকে সৎকর্ম (আল্লাহর বিধান মানা) করতে আদেশ করি, কিন্তু তারা সেখানে অসৎকর্ম (আল্লাহর বিধান অমান্য করা) করে; অতঃপর ঐ জনপদের প্রতি দণ্ডাজ্ঞা ন্যায়সঙ্গত হয়ে যায় এবং আমি সেটা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি (সুরা বনী এসরাঈল ১৬)।
যারা বলে যে, ‘না। আমরা স্রষ্টার বিধান মানবো না’, স্রষ্টার ঘোষণা (সুরা রহমান ৩৩) মোতাবেক তাদের উচিত হবে এই পৃথিবীর অনুরূপ আরেকটি গ্রহ এবং আরেকটি মানবজাতি সৃষ্টি করে সেখানে গিয়ে তাদের তৈরি সব জীবনব্যবস্থা, আইন-কানুন, তন্ত্রমন্ত্র, মতবাদ (Ism, Cracy) ইত্যাদি কায়েম করা। এই সব তন্ত্রমন্ত্রের ধারকদের এই পৃথিবী শাসনের অধিকার নেই। কারণ:
(১) যেহেতু তারা মানুষের স্রষ্টা নয়, একটি অনু পরমাণুরও স্রষ্টা নয়। [তারা কি এমন কাউকে শরীক সাব্যস্ত করে, যে একটি বস্তুও সৃষ্টি করেনি, বরং তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে (সুরা আরাফ ১৯১)। তারা একটি খেজুর বিচীর খোসারও মালিক নয় (সুরা ফাতির ১৩)]
(২) যেহেতু তারা এই সৃষ্টিকে লালন পালন করে না। [আমি তোমাদের জন্যে জীবিকার উপকরণ সৃষ্টি করছি এবং তাদের জন্যেও যাদের অন্নদাতা তোমরা নও।…আমিই জীবনদান করি, মৃত্যুদান করি এবং আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী। (সুরা হেজর ২১-২৪)]
(৩) যেহেতু তারা তাদের তৈরি হুকুম ও বিধান দ্বারা মানবসমাজে আজ পর্যন্ত শান্তি আনতে পারে নি। বরং তাদের তৈরি বিধানগুলিই সকল অন্যায় ও অশান্তির কারণ। [তাদেরকে যখন বলা হয় তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, তারা বলে, আমরা সংস্কারক মাত্র। সাবধান! তারাই হল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী অথচ তারা তা বুঝছে না।” – সুরা বাকারা (১১-১২), “জলে স্থলে যতো বিপর্যয়, এ সবই মানুষের নিজেদের কর্মের ফল” (সুরা রুম; আয়াত-৪১)।]
তাই বিধান দেওয়ার এখতিয়ার কেবলমাত্র আল্লাহরই (সুরা আহযাব ৪০)। কাজেই আমরা যদি চাই পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ করতে ও পরকালে জান্নাতে যেত তবে অবশ্যই আল্লাহর হুকুম, বিধান দিয়ে পৃথিবী পরিচালনা করতে হবে, আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে মানতে হবে। আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসাবে মানাই হলো কলেমার দাবি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল। এটা কেবল যিকিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই কলেমার দিকে, তওহীদের দিকে, আল্লাহর হুকুম তথা সত্য ও ন্যায়ের দিকে আহ্বান করছে হেযবুত তওহীদ। এটাই মানবজাতির মুক্তির পথ।