চৌদ্দশ’ বছর থেকে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা চলে আসছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবৎ বহু ইসলামী চিন্তাবিদ, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মজ্ঞানী তথাকথিত আলেম মাওলানারা দাজ্জালকে নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, গবেষণ া করেছেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ তারা রসুলাল্লাহর দাজ্জাল সম্পর্কিত রূপক বর্ণনাগুলিকেই বাস্তব হিসেবে ধরে নিয়ে এক মহা শক্তিশালী দানবের আশায় বসে আছেন। তাদের এই বিকৃত আকিদার ফলশ্র“তিতে তারা ইতোমধ্যেই পৃথিবীতে আসা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারী এবং নিজেকে রব দাবিদার দাজ্জালকে চিনতে পারছেন না। তারা বুঝতে পারছেন না যে তাদের অজান্তেই মানবজাতির মহাবিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে আজ থেকে ৪৭৭ বছর আগেই দাজ্জালের জন্ম হয়েছে এবং বর্তমানে সে তার শৈশব-কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উপনীত। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা, এ যামানার এমাম, এমামুযয্মান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী কোর’আন-হাদিস-বাইবেল, ইতিহাস এবং আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ইহুদি-খ্রিস্টান সভ্যতাই হলো রসুলাল্লাহ বর্ণিত দানব দাজ্জাল। দাজ্জাল সম্পর্কে লেখা যামানার এমামের “দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’!” বইটি পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচিত এবং আলোড়িত বিষয়, যা ছিল ২০০৮ সালের বাংলাদেশের বেস্ট সেলার বই। পাঠকদের ব্যাপক চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা বইটির বিশেষ বিশেষ অংশ পত্রিকায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এই লেখাটিও উক্ত বই থেকেই সম্পাদিত।]
দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের কথা বলার পর আল্লাহর রসুল তার সম্বন্ধে বেশ কতকগুলি চিহ্ন বলে গেছেন যাতে তাঁর উম্মাহ দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনতে পারে ও সতর্ক হয়, তাকে গ্রহণ না করে এবং তার বিরোধিতা করে, তাকে প্রতিরোধ করে। তন্মধ্যে এখানে ২টি হাদিস উল্লেখ করছি। এক দিক দিয়ে বিষয়টি তুলনামূলকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে আমরা যদি চিনতেই না পারি তবে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা বহু বেশি হয়ে যায়। এ অনেকটা এমন যে শত্র“ যদি বন্ধু সেজে আমাদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং আমরা তাকে শত্র“ বলে না চিনি তবে বিপদের ঝুঁকি কত বেশি হয়ে যায়। এ জন্যই বোধহয় আল্লাহর রসুল দাজ্জালকে যাতে আমরা সহজেই চিনতে পারি সেজন্য অনেকগুলি চিহ্ন বলে গেছেন। কিন্তু ঐ সঙ্গে এ কথাও বলে গেছেন যে প্রকৃত মো’মেন ছাড়া, মহাপণ্ডিত হলেও দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনতে পারবে না, যদিও দাজ্জালের কপালে “কাফের” শব্দটি লেখা থাকবে। আর মো’মেন নিরক্ষর হলেও দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে চিনতে পারবে। [আবু হোরায়রা (রা:), এবং আনাস (রা:) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জাল ইহুদি জাতির মধ্যে থেকে উত্থিত হবে এবং ইহুদি ও মোনাফেকরা তার অনুসারী হবে। [ইবনে হানবাল (রাঃ) থেকে মুসলিম]
এই হাদিসটির বিশেষ ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না কারণ বর্তমানের জড়বাদী (Meterialistic) সভ্যতা যে ইহুদি জাতি থেকে জন্মেছে তা দাজ্জালের আবির্ভাবের গুরুত্বের এক নম্বর হাদিসেই বিশ্লেষণ করেছি। তাছাড়া এই সভ্যতার প্রচলিত নামই হচ্ছে ইহুদি-খ্রিস্টান যান্ত্রিক সভ্যতা (Judeo-Christian Technological Civilization)। নামকরণেই বংশ পরিচয় স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। ইহুদি ও খ্রিস্টানরা যে এর অনুসারী হবে তা তো স্বাভাবিক কিন্তু মহানবী যে মোনাফেকদের অন্তর্ভুক্ত করলেন তার অর্থ হচ্ছে এই যে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জাতিটি প্রায় সম্পূর্ণটাই দাজ্জালকে তার দাবি মোতাবেক রব অর্থাৎ প্রভু বলে মেনে নেবে এবং নিয়েছে। মোনাফেকদের সংজ্ঞা অর্থাৎ ‘মুখে এক কথা বলা আর কাজে অন্যটা করা’ অনুযায়ী এরা মোনাফেকের পর্যায়ে পড়ে। নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দিয়ে, নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাহ ও নানাবিধ এবাদত করেও আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের শেখানো মানুষের সার্বভৌমত্বকে জাতীয় জীবনে স্বীকার করে নেয়া যদি মোনাফেকী না হয় তবে আর মোনাফেকী কী?
আল্লাহর রসুল বলেছেন- দাজ্জাল নিজেকে মানুষের রব, প্রভু বলে ঘোষণা করবে এবং মানবজাতিকে বলবে তাকে রব বলে স্বীকার করে নিতে। [বোখারী]
দাজ্জালের এই দাবি “আমাকে প্রভু বলে স্বীকার করো” এর অর্থ কী? এর অর্থ হচ্ছে এই যে দাজ্জাল পৃথিবীর মানুষকে বলবে যে, আমি মানুষের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা দিচ্ছি, যে আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, শিক্ষা-ব্যবস্থা দিচ্ছি তা তোমরা গ্রহণ ও প্রয়োগ করো। তোমরা বহু পুরাতন বেদ, মনু-সংহিতা ও কোর’আন-হাদিস নিঃসৃত যে আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি ইত্যাদি জীবনে প্রয়োগ করছিলে তা পুরানো, অচল ও বর্বর; ওগুলো ত্যাগ করে আমি যে অতি আধুনিক আইন-কানুন দিচ্ছি তা গ্রহণ করো ও তোমাদের সমষ্টিগত জীবনে প্রয়োগ করো। তাহলে তোমরা আমাদের মতো সভ্য হবে, সমৃদ্ধিশালী, ধনী ও শক্তিশালী হবে। তোমাদের জীবন যাত্রার মান আমাদের মতো উন্নত হবে। আমরা যেমন স্বর্গসুখে আছি তোমরাও এমনি স্বর্গসুখ ভোগ করবে। দাজ্জাল রব, প্রভুূ হবার দাবি করছে কিন্তু স্রষ্টা হবার দাবি করছে না। পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিস্টান যান্ত্রিক সভ্যতা ও শক্তি ঠিক এই প্রভুত্বের, রবুবিয়াতের দাবিই করছে, মানুষের স্রষ্টা হবার দাবি করছে না। সে বলছে ব্যক্তিগত জীবনে তোমরা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, জৈন, বৌদ্ধ যা থাকতে চাও থাকো এবং যত খুশি তোমাদের আল্লাহকে, ঈশ্বরকে, গডকে, এলীকে ডাকো। যত খুশি নামাজ পড়ো, রোযা করো, হজ্ব করো, প্রার্থনা করো আমার কোন আপত্তি নেই কিন্তু সমষ্টিগত জীবনে আমার রবুবিয়াহ্, প্রভুত্ব মেনে নাও। এখানে তোমাদের স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে আমি যে জনগণের, একনায়কের, কোন বিশেষ শ্রেণির, সংখ্যাগরিষ্ঠের অর্থাৎ এক কথায় মানুষের সার্বভৌমত্ব সৃষ্টি করেছি, তার যে কোন একটাকে মেনে নাও।
আজ মানবজাতি দাজ্জালের ঐ দাবি মেনে নিয়েছে এবং মেনে নেয়ায় দাজ্জাল মানবজাতিকে তার কাছে যে জান্নাতের মতো জিনিসটি আছে তাতে প্রবেশ করিয়েছে। তাই আজ সমস্ত মানবজাতি জাহান্নামের আগুনে পুড়ছে। সমস্ত পৃথিবীতে কোথাও শান্তি নেই। একটি মাত্র দম্পতি থেকে সৃষ্ট হয়েও, একটিমাত্র জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়েও (কোর’আন- সুরা বাকারা, আয়াত ২১৩; সুরা ইউনুস, আয়াত ১৯; সুরা নেসা, আয়াত ১) মানুষ একে অপরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করছে, আগুনে পুড়িয়ে মারছে, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে। দাজ্জালের অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে মানুষের মধ্যে কেউ কোটি কোটি মুদ্রার মালিক হয়ে জঘন্য বিলাস-ব্যাসনের মধ্যে ডুবে আছে আর কেউ না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে, খেতে, পরতে দিতে না পেরে নিজেদের ছোট ছোট বাচ্চা সন্তানদের হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যা করছে, মা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করছে, পেটের সন্তান অন্যের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে; আল্লাহর দেয়া দণ্ডবিধি প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের দণ্ডবিধি গ্রহণ করায় সর্বরকম অপরাধ চুরি- ডাকাতি, হাইজ্যাক, অপহরণ, ছিনতাই, খুন-জখম, ধর্ষণ প্রতি দেশে, প্রতি জাতিতে ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে চোলেছে; আল্লাহর দেয়া শিক্ষা-ব্যবস্থা ত্যাগ করে দাজ্জালের দেয়া আত্মাহীন, আল্লাহহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে মানুষ তার নৈতিক চরিত্র হারিয়ে পশুর পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে।
সাজদা অর্থ আত্মসমর্পণ, কাউকে সাজদা করার অর্থ তার কাছে আত্মসমর্পণ করে তার আদেশ নির্দেশ মেনে চলা- তাই আল্লাহ তাঁকে ছাড়া আর কাউকে সাজদা করা নিষেধ করেছেন। কিন্তু মুসলিমসহ সমস্ত মানবজাতি আজ দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিস্টান যান্ত্রিক সভ্যতার পায়ে আত্মসমর্পণ করেছে, তার পায়ে সাজদায় পোড়ে আছে। এক কথায় এবলিস মানবজাতিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব থেকে, তওহীদ থেকে বিচ্যুত করে তাকে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমায় পতিত করার যে চ্যালেঞ্জ আল্লাহকে দিয়েছিল আজ তাতে সে সক্ষম হয়েছে, আজ সে জয়ী অবস্থায় আছে।