চৌদ্দশ’ বছর আগে আল্লাহর রসুল যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন, তখন আরবজাতি ছিল বহু গোত্রে বিভক্ত। তাদের মধ্যে অনৈক্য এতটাই প্রকট ছিল যে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোত্রে গোত্রে লেগে যেত ভয়াবহ যুদ্ধ। এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের বিবাদ সৃষ্টি হলে তা জিঁইয়ে থাকত যুগের পর যুগ, এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম। এই বিবাদ-বিভক্তি তাদেরকে তৎকালীন বিশ্বের সম্ভবত সবচেয়ে দরিদ্র, উপেক্ষিত ও অবহেলিত জাতিতে পরিণত করেছিল। তখনকার সভ্য জাতিগুলোর কাছে তারা বর্বর মরুবাসী বলেই পরিচিত ছিল। সর্বদা অন্তর্দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত সেই জাতিকেই আল্লাহর রসুল এমন ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করলেন যাদের পরবর্তী কীর্তি ইতিহাস হয়ে আছে। তৎকালীন পৃথিবীর দুই পরাশক্তি পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য তাদের দাপটের সামনে তুলোর ন্যায় উড়ে গেল। মানবজাতির ইতিহাসে রচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। আল্লাহর রসুলের ওফাতের পর তাঁর নিজ হাতে গড়া, তাঁরই আদর্শে উজ্জীবিত ঐ জাতি দুই যুগেরও কম সময়ের মধ্যে অর্ধপৃথিবীতে শান্তির পতাকা উড়ালেন। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অবিচার, জুলুম, অপরাধকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তার এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। একটি জাতির এই আমূল পরিবর্তনের পশ্চাতে অনেকে অনেক কারণ খুঁজে পেতে পারেন। তবে বর্বর এই মরুবাসীদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত ঐক্যহীন কোনো জাতির পক্ষে বিরাট কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। এটা প্রাকৃতিক যে ঐক্য চিরকালই অনৈক্যের উপর বিজয়ী হবে। আর ইসলামকে আল্লাহ বলেছেন ‘প্রাকৃতিক জীবনব্যবস্থা’। সুতরাং ইসলাম যে এককালে পৃথিবীময় বিজয়ী হয়েছিল তার পেছনেও প্রাকৃতিক কারণগুলো উপলব্ধি করতে হবে। এই ঐক্যকে আল্লাহর রসুল এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, ঐক্য ভঙ্গের কোনো কারণ দেখতে পেলে তাঁর মতো মহামানবও রাগে, ক্ষোভে লাল হয়ে যেতেন। তিনি অনৈক্য সৃষ্টিকারীকে কাফের বলে অভিহিত করেছেন।
ইতিহাস বলে, মুসলিম উম্মাহ যতদিন ঐক্যবদ্ধ ছিল ততদিন পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতি, এককথায় পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে যখনই ঐক্য বিনষ্ট হতে লাগল, আল্লাহর রসুলের বক্তব্য মোতাবেক জাতি কুফরে নিমজ্জিত হতে থাকল। ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকেও লা’নত আসতে শুরু করল। যে মুসলিম জাতির একজন নেতার অধীনে একজাতি, একপ্রাণ হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে যাওয়ার কথা, তারাই যখন পরবর্তী নেতাদের আকীদার বিকৃতি, ক্ষমতার লোভ আর অদূরদর্শীতা, ধর্মের পণ্ডিত সেজে বসে থাকা আলেমশ্রেণির পরস্পরবিরোধী ফতোয়ার দ্বারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ল, অসংখ্য মাজহাব, ফেরকা, তরিকায় আলাদা হয়ে গেল, তখন আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সাবধানবাণী অনুযায়ী পৃথিবীতে তারা তাদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব্ও হারিয়ে ফেলল। মূলত জাতি হিসেবে তারা তখন আর মুমিনই রইল না। কোর’আনের বহু আয়াত ও আল্লাহর রসুলের বহু সহীহ হাদিস প্রমাণ করে, ঐক্যহীন, বিভক্ত, নিজেদের মধ্যে কোন্দলরত জাতি কখনো মুমিন হতে পারে না। একসময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মুসলিম বলে পরিচিত জাতি-গোষ্ঠীগুলো যখন একে একে পরাজিত হয়ে ইউরোপের তৈরি শাসনব্যবস্থা মেনে নিল তখন তাদের মুসলিম পরিচয়টিও তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। আজকের মুসলিমরা স্বীকার করুক আর নাই করুক, প্রকৃতপক্ষে জাতি হিসেবে তারা না মুসলিম, না মুমিন। উম্মতে মুহম্মদী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। কারণ, যে উম্মাহ তথা জাতিকে আল্লাহর রসুল গড়ে গিয়েছিলেন নিজেদের সর্বস্ব কোরবানি করার বিনিময়ে হলেও সমস্ত পৃথিবীর অন্যায়, অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য, আজকে নিজেরাই অগণিত অন্যায়ে নিমজ্জিত এই জাতিটিই সেই উম্মতে মুহম্মদী, এটা নির্বোধ ব্যতীত কেউ দাবি করতে পারে না।
আজ পৃথিবীব্যাপী, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি যে দ্বন্দ্ব তা মুসলিম নামধারী জাতির ঐক্যের ওই অবক্ষয়েরই চূড়ান্ত পরিণতি। আজ নিজেদের মুসলিম বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও সৌদি আরব ও ইরানের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে নানামুখী তৎপরতায় ব্যস্ত। অতীতে আমরা মধ্যপ্রাচ্যে বহুবার এই শিয়া-সুন্নি বিভাজনকে কেন্দ্র করে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত প্রত্যক্ষ করেছি। বর্তমানে সিরিয়াযুদ্ধ, আইএস সংকটের মূলেও রয়েছে এই দ্বন্দ্ব। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া হামলাসহ বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় সবচেয়ে বড় মদদদাতার পরিচয় দিয়ে এসেছে মুসলিম বিশ্বের মোড়লখ্যাত সৌদি আরব। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টায় ইরানও বরাবরই যেকোনো সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তাদের মধ্যেও এক আল্লাহ, এক রসুল ও এক কোর’আনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো প্রচেষ্টাই দেখা যায়নি। আজ সিরিয়ায় যে সংকট চলছে তাতে কোটি কোটি মুসলিম মানবেতর জীবনযাপন করছে, লাখ লাখ সিরীয় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। কোথাও আশ্রয় না পেয়ে সীমান্তে তাবু গেড়ে প্রচণ্ড শীতে দুর্বিষহ সময় পার করছে। এই ঘোর সংকটকালেও মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রভাবশালী দেশ দুটিকে দেখা যায় শিয়া-সুন্নি ইস্যুতে রাজনীতি করতে। একপক্ষ আমেরিকার দালাল, আরেকপক্ষ রাশিয়ার চাটুকার সেজে বসে আছে। অথচ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোই যদি ঐক্যবদ্ধ হতো তবে সেই অঞ্চলের যাবতীয় সমস্যার সমাধান তারা নিজেরাই করতে পারত। সেখানকার বিভিন্ন দেশে গত কয়েক দশক ধরে যে মানবিক অবক্ষয় চলছে তার অবসান ঘটতে পারতো তাদের হাতেই। শুধু তাই নয়, ভূ-গর্ভস্ত তেল যা আজকের সভ্যতার প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে তার বলতে গেলে একমাত্র মালিক এই মধ্যপ্রাচ্য। এই সম্পদের জোরে খুব সহজেই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী অঞ্চল বলে প্রতিষ্ঠা পেত। কিন্তু তাদের চিন্তা-ভাবনার ক্ষুদ্রতা, তাদের কর্মকাণ্ড তাদেরকে দিনে দিনে অধিক ঐক্যহীন করছে। আর ফলশ্র“তিতে ওই অঞ্চলটিও অধিকতর সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে।
সৌদি আরবে একজন শীর্ষস্থানীয় শিয়া নেতাকে সন্ত্রাস বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ফুঁসে ওঠেছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ ইরানিরা গত রবিবার নিজ দেশে সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায়। এর পরদিনই সৌদি আরব ও আরো তিনটি সৌদিপন্থী বলে পরিচিত দেশ ইরানের সাথে কুটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। সৌদি আরব দেশটিতে ইরানিরা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে অভিযোগ এনে রিয়াদ থেকে ইরানি দূতাবাসে কার্যরত সকলকে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করেছে এবং তেহরান থেকেও নিজ দেশের কূটনীতিকদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। ইরান সৌদি আরবের অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, সৌদি আরবের এই ঘোষণায় শিয়া নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা ধামাচাপা পড়বে না। এর আগে দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়তাল্লাহ খামেনি বলেছেন, সৌদি আরবকে তার এই কৃতকর্মের ‘খোদায়ি শাস্তি’ পেতে হবে।
মুসলিম জাতি যখন আজ পদে পদে অপমানিত, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমরা যখন অবহেলিত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত, তাদের গায়ে যখন ‘সন্ত্রাসী’ সিল এটে দেওয়া হয়েছে, তাদের যুবক তরুণরা যখন পথহারা হয়ে জঙ্গিবাদের মতো বিকৃত আদর্শের শিকার, তাদের একেকটি ভূ-খণ্ড যখন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের কোপানলে পুড়ে ছাই, তাদের কামান আর গোলায় মুসলিম যুবকদের বুক যখন জর্জরিত, তখন এই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব নিজেদের ভাগ্যের সাথে এক চরম পরিহাস ছাড়া আর কি হতে পারে? আজ যেখানে পৃথিবীময় বিরাজিত অন্যায় ও অশান্তিকে দূর করার জন্য মুসলিম জাতির দিকে দিকে ঐক্যের আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়ার সময় তখন এই জাতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলো উন্মত্তের ন্যায় একে অপরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ। তাদের এই মূর্খতা, তাদের এই চিন্তার ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা নিশ্চিতভাবে তাদের নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল দেখে আসছি। এই মধ্যপ্রাচ্যকে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের খেলার মাঠ বানিয়ে নিয়েছে। তাদের সভ্যতার অপরিহার্য উপাদান তেলের খোঁজে ও তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা ‘অস্ত্রব্যবসা’কে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারা বারবার এই মধ্যপ্রাচ্যকে টার্গেট করেছে। কিন্তু এটা আল্লাহর লা’নতের ফল হতে পারে যে, সেখানকার মুসলিমরা তাদের বরাবরই সাম্রাজ্যবাদীদের টোপ গিলেছে।
আমাদের এদেশের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ মানুষও নিজেদের মুসলিম বলে বিশ্বাস করি। অথচ আমরাও অনৈক্যে নিপতিত। আমরা একসাথে নামাজ পড়ি, কোরবানি দেই, মসজিদে গিয়ে ইবাদত বন্দেগি করি। তখন আমরা সবাই মুসলিম। অথচ সেখান থেকে বের হয়ে আমরা হয়ে যাই ভিন্ন দল, মত ও পথের অনুসারী। আমরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অপর ভাইয়ের জীবন ও সম্পদের সর্বনাশ করতেও পিছপা হই না। আমাদের মধ্যেও সেই জাহেলিয়াতের যুগের অনৈক্য, বিবাদ, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত, সংঘর্ষ, অন্যায়, অশান্তি চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। এই হানাহানির সুযোগে আমাদের দেশকে নিয়ে শুরু হয়েছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। সময় এসেছে আমাদের এই সংকটকে, পাশাপাশি পুরো বিশ্বের সংকটকে উপলব্ধি করার। আজ এদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে ঐক্যের ডাক। দল-মত নির্বিশেষ সকল স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তথা মানবতা, ন্যায়, সত্য, হকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ছড়িযে পড়ছে দিকে দিকে। এই জাতির প্রতিটি সদস্যের উচিত সেটি আহ্বান কতটা সঙ্গত, কতটা সময়ের দাবি তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। আমরা বিশ্বাস করি, জাতি যদি আবার ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তবে এই ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত মিলে হবে এক অপরাজেয় শক্তি। এই জাতির ভাগ্যকে নিয়ে নোংরা খেলা করবে তেমন কোনো শক্তিই পৃথিবীতে থাকবে না যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। কেবল মুসলিম জাতি নয়, পুরো মানবজাতিকে আমরাই পারি ঐক্যসূত্রে গাঁথতে। ইস্পাতকঠিন ঐক্য আমাদের পরিণত করে দিতে পারে পৃথিবীর পরাশক্তিতে।