-দিল আফরোজ
নারী ও পুরুষ বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার দরুন আল্লাহর অনন্য সৃষ্টি নৈপুণ্যের স্বাক্ষর, এদের উভয়ের সমন্বয়েই মানবজাতি। তাই মানব সভ্যতার যে কোনো অগ্রগতিতে এদের উভয়ের সমন্বিত অংশগ্রহণ অপরিহার্য। মানুষ যেমন এক পায়ে চলতে পারে না, তেমনি মানবজাতির অর্ধাংশ নারী, সেই নারীকে বর্জন করে মানবজাতিও চলতে পারবে না, মুখ থুবড়ে পড়বে। এই সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে ধর্মব্যবসায়ী আলেমগণ। তারা তাই নারীদেরকে ফতোয়ার চোখ রাঙানি দেখিয়ে তাদেরকে জাতীয়-সামাজিক জীবনের কর্মকাণ্ড থেকে অপসারণ করে গৃহকোণে বন্দী রাখতে চান, তাদের মেধা ও মননকে আবদ্ধ রাখতে চান কালো বোরকার ঘেরাটোপে।
কিন্তু যুগের প্রয়োজনে মুসলিম নারীদেরকেও সমাজের বহিরাঙ্গণে কাজ করতে হচ্ছে। ধর্মের প্রচলিত শিক্ষা তাদের অনেকের হৃদয়েই একটি কাঁটার খোঁচা সৃষ্টি করে যে, আমি যে পরপুরুষদের সঙ্গে কাজ করছি, সর্বত্র বিচরণ করছি এতে আমার পাপ হচ্ছে। পরহেজগার নারী বলতেই বোঝায় পর্দাবন্দী রক্ষণশীল নারী; অন্তর্মুখী, অধোমুখী, নির্বিরোধী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীন চরিত্রই যেন তার ধার্মিকতার পরিচয়। আসলে এই ধারণা প্রকৃত ইসলামের ধারণাই নয়, এটি মুসলিম জাতিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলার একটি ষড়যন্ত্রমাত্র যার হাতিয়ার এই ধর্মব্যবসায়ীরা। তাদের যে অংশটি ধর্মবিশ্বাসকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতাতে চায়, তারা ধর্মপ্রিয় নারীদেরকে সহজলভ্য ভোটব্যাংক হিসাবে ব্যবহার করে।
ধর্মের ফতোয়া দ্বারা নারীদেরকে এভাবে পশ্চাৎবর্তী করে রাখায় ধর্মবিদ্বেষী শ্রেণি ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর সুযোগ লাভ করে। দেখা যায় তাদের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার অধিকাংশই নারী সংক্রান্ত। পাশাপাশি পশ্চিমা নগ্ন সংস্কৃতির জোয়ার নারীকে প্রবলবেগে ভাসিয়ে নিতে চাচ্ছে। তারা স্বাধীনতার নামে পারিবারিক বন্ধনকেও ছিন্ন করে সেই জোয়ারে গা ভাসাচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থ মনোবিকাশ ও সুস্থ সমাজের কথা তারা ভাবছে না। পরিণামে নিরাপত্তা, অধিকার সবকিছু হারিয়ে আমাদের তরুণীরা লক্ষ্যহীন তরণীর মতো ভেসে যাচ্ছে যুগের স্রোতে। তাদের রূপকে লোভনীয় পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, আর নারীরাও এই দেহ-প্রদর্শনীকে ‘উদারতা’ বলে মনে করছে। শুধু তা-ই নয়, নারী যখন মাটি কাটছে, ইটভাটায় ইট টানছে, ইট-পাথর ভাঙছে তখন একে বলা হচ্ছে নারী তার অধিকার পেল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই সব কঠোর কায়িক পরিশ্রমের কাজ করা নারীর অধিকার নয়, বরং অধিকার হারানোর ফল।
অর্থাৎ নারী যদি ধার্মিক হয় তাহলে তাদেরকে বন্দী থাকতে হচ্ছে যা সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আর যদি বন্দী না থাকে তাহলেই তাকে ‘ধর্মহীন’ হয়ে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করা হচ্ছে। এই কড়াই আর চুলো এই দুটো অপশনই তাদের সামনে উন্মুক্ত আছে। কিন্তু ধর্ম কি সত্যিই নারীকে এই বন্দীত্ব বরণে বাধ্য করে? না। আল্লাহ প্রেরিত মহামানবগণ এর প্রমাণ দিয়েছেন, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের শিক্ষাকে কুক্ষিগত করে নিজেরা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা সমাজের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। তারাই ধর্মের নামে নারীর উপর নিষ্পেষণ চালিয়েছে। আল্লাহর রসুল উম্মতে মোহাম্মদীর নারীদেরকে এমন মর্যাদায় উন্নীত করেছিলেন যে, তারা সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে ভূমিকা রাখতেন।
আমাদের জীবনচিন্তা, সংস্কৃতি, জীবনব্যবস্থা থেকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে যদি পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয় তাহলে নৈতিকতা হারিয়ে যাবে, সকল বন্ধন লুপ্ত হয়ে সমাজকে অপরাধপ্রবণ ও অনিরাপদ করে তুলবে। আবার যদি সম্পূর্ণ বস্তুবাদী হয়ে যাই তাহলে মানুষ মানবেতর জীবে পরিণত হবে। এটা আজকের বাস্তবতা। এই উভয় পথের মাঝামাঝি একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবন আমাদেরকে যাপন করতে হবে। সেই জীবনব্যবস্থার রূপটি কেমন হবে সেটাই তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ।