১৩ নভেম্বর ২০১৬ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণের জন্য দেশের প্রথিতযশা প্রগতিশীল ধ্যানধারণার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাবিদগণকে নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠক করেছে হেযবুত তওহীদ। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির গোলটেবিল কক্ষে “সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় ভারাক্রান্ত বিশ্ব: পরিত্রাণের পথ” শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দৈনিক বজ্রশক্তির উপদেষ্টা ও দৈনিক দেশেরপত্রের সাবেক সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী। অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রাখেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি সাইফুল হক, ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগরীর প্রেসিডেন্ট আবুল হোসেন, হেযবুত তওহীদের সাহিত্য সম্পাদক রিয়াদুল হাসান, দৈনিক বজ্রশক্তির উপদেষ্টা উম্মুততিজান মাখদুমা পন্নী প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বজলুর রশিদ ফিরোজ, দৈনিক বজ্রশক্তির প্রকাশক ও সম্পাদক এস এম সামসুল হুদাসহ আরও অনেকে। কীভাবে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা যাবে এ বিষয়ে বক্তাগণ বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হেযবুত তওহীদের আমীর মসীহ উর রহমান।
বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবী আজ সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতায় ভারাক্রান্ত। এ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সম্প্রতি নাসির নগরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে এবং বিগত সময়গুলোতে যে ভয়াবহ জঙ্গিবাদী কর্মকা- ঘটানো হয়েছে তা মূলত একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের অংশ। এই ষড়যন্ত্র কেবল দেশের বিরুদ্ধেই নয় এটি পবিত্র ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধেও। এই জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা আসলে ইসলাম থেকে সৃষ্টি হয়নি। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে এগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এর বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীব্যাপী ইসলামের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে, মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বলে প্রচার করা হচ্ছে। কাজেই এই সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও যাবতীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আজ সকলকে সোচ্চার করে তুলতে হবে। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী মানুষদের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশে হেযবুত তওহীদের এমাম এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো মানবতা আর মানুষের ইবাদত হলো নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য চেষ্টা করা। জঙ্গিবাদ কীভাবে সৃষ্টি হলো তা তিনি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরে বলেন এই জঙ্গিবাদ আসলে সাম্রাজ্যবাদীদের একটি ষড়যন্ত্র, এটা ইসলাম থেকে সৃষ্টি হয়নি। বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, একটার পর একটা মুসলিম দেশ এই জঙ্গিবাদকে ইস্যু করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে কাজেই এখন আমাদেরকে ভাবতে হবে গভীরভাবে, আমাদের দেশটাও যেন আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো না হয় সে জন্য আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং জঙ্গিবাদ উভয়ই আসলে ধর্মকে ব্যবহার করে ঘটানো হয়। এ কারণে এই কর্মকা-গুলো নির্মূল করতে হলে শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি একটি সঠিক আদর্শ লাগবে, সেই আদর্শই তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ। এটা মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে মানুষ এই বিকৃত আদর্শ পরিত্যাগ করবে।
বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি কমরেড সাইফুল হক বলেন, বর্তমানে যে জঙ্গিবাদ নিয়ে সারা পৃথিবী টালমাটাল সেই জঙ্গিবাদ শব্দটা কিন্তু আমাদের বাবা-দাদারা জানতেনই না, অথচ তারা ইসলাম মানতেন। যে ধর্ম মানবতার কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, ঐক্যের কথা বলে, শান্তির কথা বলে সেই ধর্মকে ব্যবহার করেই আজ জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ আসলে ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না। এই জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছে সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর দেশগুলো। তিনি হেযবুত তওহীদের এই উদ্যোগের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে বলেন এখন সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে যেন বাংলাদেশকে কেউ ইরাক-সিরিয়া বানাতে না পারে।
হেযবুত তওহীদের সাহিত্য সম্পাদক রিয়াদুল হাসান ইসলামের দৃষ্টিতে শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদী ও গোড়াপন্থীরা শিল্প-সংস্কৃতিকে ইসলামে নিষিদ্ধ বলে প্রচার করে থাকে এবং অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের এই ফতোয়াকে বিশ্বাস করে শিল্প-সংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথচ কোর’আন-হাদিস অনুযায়ী গান, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি নিষিদ্ধ নয় বরং এগুলোকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হলো যাবতীয় অশ্লীলতা। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা যেমন কোনো সমাধান হতে পারে না ঠিক তেমনি অশ্লীলতা নিষিদ্ধ করতে গিয়ে শিল্প-সংস্কৃতিকেই নিষিদ্ধ করা নিতান্ত মূর্খতা।
ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগর প্রেসিডেন্ট কমরেড আবুল হোসেন বলেন, জঙ্গিবাদ শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব নয়, এর জন্য লাগবে একটি আদর্শ আর সেই আদর্শ হলো মানবতাবাদ। এই জঙ্গিবাদ সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য হলো পেট্রো ডলারের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি। সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের স্বার্থে এটি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে সাম্প্রদায়িক হামলা চলছে, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর, সাঁওতালদের উপর যে হামলা চলছে তার উদ্দেশ্য আসলে তাদের সম্পত্তি দখল করা। তাদেরকে যদি কোনোভাবে দেশ থেকে অত্যাচার করে বিদায় করা যায় তবে তাদের সম্পত্তিটা দখল করা যাবে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। এই সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের কারণে। এখন ৭২ এর সংবিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি মানুষের মননের পরিবর্তনের জন্য সুস্থ সাংস্কৃতিক রেনেসা হওয়া দরকার।
দৈনিক বজ্রশক্তির উপদেষ্টা উম্মুততিজান মাখদুমা পন্নী এই জঙ্গিবাদ নির্মূলে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, সমাজের সকল ক্ষেত্রে নারীদের অবদান রাখতে হবে। নারীরা মাতা, বোন, কণ্যা, সহধর্মিনী সুতরাং তাদের দৃষ্টি রাখতে হবে পরিবার থেকে যেন কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত না হতে পারে। এই কাজে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
অনুষ্ঠানে বক্তাগণ বলেন, জঙ্গিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎস একই, সেটা হলো ধর্মবিশ্বাসের অপপ্রয়োগ। ধর্মবিশ্বাসী মানুষদেরকে একটি বিকৃত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ করে এই কাজে লিপ্ত করানো হয়, কাজেই এর বিরুদ্ধে কেবল শক্তি প্রয়োগ করে পূর্ণরূপে সফল হওয়া সম্ভব নয়। এটি নির্মূলের জন্য প্রয়োজন এর বিরুদ্ধে একটি সঠিক আদর্শ তথা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মাঝে উপস্থাপন করা। ষড়যন্ত্রকারীরা কোর’আন-হাদিসের যে সমস্ত অংশ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে সরলপ্রাণ মানুষকে বিপথগামী করে সেই আয়াতগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসাবে এবং একজন মো’মেন হিসাবে ইমানী কর্তব্যবোধ থেকে দেশের বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।
আমাদের এই উপমহাদেশে শত শত বছর হিন্দু-মুসলিম একত্রে বসবাস করে আসছে। তাদের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ব্রিটিশরা যখন এখানে শাসন প্রতিষ্ঠা করল তখন এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিল। তখন থেকে শুরু হলো সাম্প্রদয়িক দাঙ্গা, স্বার্থ উদ্ধার করল ব্রিটিশরা। আজও কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য কখনো ধর্মকে ব্যবহার করে আবার কখনো বা অন্য কোনো ইস্যুতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে সংঘাতের মতো ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। বক্তারা এই স্বার্থ উদ্ধারের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে জঙ্গিবাদ ও সম্প্রদায়িকতা বিরোধী হেযবুত তওহীদের কার্যক্রমের উপর নির্মিত সংক্ষিপ্ত এক প্রামাণ্যচিত্র প্রদার্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাভিশন, এস এ টিভি, দেশ টিভি, নিউজ ২৪, দীপ্ত টিভি, বৈশাখী টিভি, মোহনা টেলিভিশন, জেটিভি অনলাইলন সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গণমাধ্যমকর্মীগণ উপস্থিত ছিলেন।