সাইফুর রহমান
কয়েক শতাব্দী আগে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা যখন সামরিক শক্তিবলে মুসলিম ভূখণ্ড পদানত করে এবং এই মুসলিম নামধারী জনসংখ্যাকে পদানত গোলামে পরিণত করে তখনও এ জাতির অনেকের মধ্যেই ইসলামের চেতনা, আল্লাহর হুকুমের প্রতি আনুগত্য ও মুসলিম হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের অনুভূতি কিছু হলেও অবশিষ্ট ছিল, তাদের উপর আল্লাহ ও রসুলের হুকুম কী, এ ব্যাপারে তারা সচেতন ছিলেন অর্থাৎ আগুনের শিখা না থাকলেও ঈমানের উত্তপ্ত কয়লা তখনও গনগন করছিল। এ কারণে খ্রিস্টানরা ক্ষমতা লাভ করলেও তাদের কর্তৃত্ব নিষ্কণ্টক ছিল না। বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনচেতা মুসলিমদের বিদ্রোহ লেগেই ছিল। পাক ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতিও এর ব্যতিক্রম নয়। হাজী শরিয়তুল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়ার ফারায়েজী আন্দোলন, নুরুদ্দিন বাকের মোহাম্মদ জঙ্গের ফকীর সন্ন্যাসী আন্দোলন, ১৮৫৭ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম, শহীদ তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার ঘটনাগুলি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এ ঘটনাগুলির প্রত্যেকটিতে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতবর্ষকে দারুল হারব (যুদ্ধক্ষেত্র) ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। হাজার হাজার মুসলিম এসব আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিয়েছিলেন এবং বহু সংখ্যক জীবন উৎসর্গও করে গেছেন।
এ অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হিসেবে খ্রিস্টানরা যে কয়টি শয়তানী চক্রান্ত করলো তার একটি হচ্ছে নিজেদের তৈরি করা আল্লাহর সার্বভৌমত্বহীন, সম্পূর্ণরূপে জিহাদবিমুখ, ভীরু, কাপুরুষ এবং খ্রিস্টান শাসকদের অনুগত নিবীর্য চরিত্রের মানুষে পরিণত করার জন্য বিকৃত ইসলাম তৈরি করে মাদ্রাসার মাধ্যমে এ জাতির চরিত্রে, আত্মায় গেঁড়ে দেওয়া। (কেরামত আলী জৈনপুরী রচিত মুকাশাফাত-ই-রাহমা গ্রন্থে ১৩ পৃ:)। তারা অনেক গবেষণা করে একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করলো যাতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও জিহাদকে বাদ দেওয়া হলো এবং ব্যক্তিগত জীবনের মাসলা মাসায়েল, ফতোয়া, দোয়া কালাম, মিলাদের উর্দূ ফার্সী পদ্য বিশেষ করে যে বিষয়গুলি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই বহু মতবিরোধ সঞ্চিত ছিল সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করলো। এই আত্মাহীন মৃত ইসলামটিকে জাতির মনে মগজে গেঁড়ে দেওয়ার জন্য এই উপমহাদেশের ভাইসরয় (Viceroy) বা বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংকস ১৭৮০ সনে ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলো। সেখানে নিজেরা অধ্যক্ষ থেকে ১৯২৭ সন পর্যন্ত ১৪৬ বছর ধরে মুসলিম জাতিকে সেই বিকৃত ইসলাম শেখালো। এই শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে অংক, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির কোনো কিছুই রাখা হলো না, যেন মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এসে আলেমদের রুজি-রোজগার করে খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই দীন, ধর্ম বিক্রি করে রোজগার করা ছাড়া আর কোনো পথ না থাকে। খ্রিস্টানরা এটা এই উদ্দেশ্যে করলো যে তাদের মাদ্রাসায় শিক্ষিত এই মানুষগুলো যাতে বাধ্য হয় দীন বিক্রি করে উপার্জন করতে এবং তাদের ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে বিকৃত ইসলামটা এই জনগোষ্ঠীর মন-মগজে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। খ্রিস্টানরা তাদের এই পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্য লাভ করলো। তাদের এই মাদ্রাসা প্রকল্পের মাধ্যমে দীনব্যবসা ব্যাপক বিস্তার লাভ করলো এবং এর মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দুদের ব্রাহ্মণ, আচার্য, খ্রিস্টানদের পাদ্রী, ইহুদিদের রাব্বাই, সাদ্দুসাই, ফরিশি, বৌদ্ধদের শ্রমণ, ভিক্ষুদের মতো একটি স্বতন্ত্র পুরোহিত শ্রেণি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলো।
যে ২৬ জন খ্রিস্টান পণ্ডিত অধ্যক্ষ পদে থেকে কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় ৭৬ বছর ধরে মুসলিম দাবিদার ছাত্রদেরকে বিকৃত ইসলাম শিখিয়েছেন তাদের তালিকা
১. এ.এইচ. স্পিঙ্গার এম.এ. (১৮৫০)
২. উইলিয়াম ন্যাসলীজ এল.এল.ডি (১৮৭০)
৩. জে. স্যাটক্লিফ এম.এ. (১৮৭৩)
৪. এইচ. এফ. ব্রকম্যান এম.এ. (১৮৭৩)
৫. এ. ই. গাফ এম.এ. (১৮৭৮)
৬. এ. এফ. আর হোর্নেল (C.I.P.H.D (১৮৮১)
৭. এইচ প্রথেরো এম.এ. (অস্থায়ী) (১৮৯০)
৮. এ. এফ. হোর্নেল (১৮৯১)
৯. এফ. জে. রো এম.এ. (১৮৯১)
১০. এ. এফ. হোর্নেল (১৮৯২)
১১. এফ. জে. রো এম.এ. (১৮৯৫)
১২. এ. এফ. হোর্নেল (১৮৯৭)
১৩. এফ. জে. রো (১৮৯৮)
১৪. এফ. সি. হল (বি.এ.টি.এস.সি) (১৮৯৯)
১৫. স্যার অর্যাল স্টেইন পি.এইচ.ডি (১৮৯৯)
১৬. এইচ. এ. স্টার্ক বি.এ. (১৯০০)
১৭. লে. কর্ণেল জি.এস.এ. রেঙ্কিং (১৯০০)
১৮. এইচ. এ. স্টার্ক বি.এ. (১৯০১)
১৯. এডওয়ার্ড ডেনিসন রাস (১৯০৩)
২০. এইচ. ই. স্টেপেল্টন (১৯০৩)
২১. এডওয়ার্ড ডেনিসন রাস (১৯০৪)
২২. এম. চীফম্যান (১৯০৭)
২৩. এডওয়ার্ড ডেনিসন রাস (১৯০৮)
২৪. এ. এইচ. হারলি এম.এ. (১৯১১)
২৫. মি. জে. এম. ব্রটামলি বি.এ (১৯২৩)
২৬. এ. এইচ. হার্টি এম.এ. (১৯২৫)
দীর্ঘ ১৪৬ বছর (১৭৮০ সালে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ৭০ বছর মুসলিম নামধারী মোল্লাদেরকে অধ্যক্ষ পদে রেখে পরিপূর্ণ সন্তষ্ট না হয়ে ১৮৫০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ৭৬ বছর খ্রিস্টান পণ্ডিতরা নিজেরা সরাসরি অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত থেকে) এ খ্রিস্টান ইসলাম শিক্ষা দেবার পর ব্রিটিশরা যখন নিশ্চিত হলো যে, তাদের তৈরি করা বিকৃত ইসলামটা তারা এ জাতির হাড়-মজ্জায় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে এবং আর তারা কখনও এটা থেকে বের হতে পারবে না তখন তারা ১৯২৭ সনে তাদের আলীয়া মাদ্রাসা থেকেই শিক্ষিত মাওলানা শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন আহমেদ (এম.এ.আই.আই.এস) এর কাছে অধ্যক্ষ পদটি ছেড়ে দিলো (আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আঃ সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুণ, ইসলামী ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ, Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal” by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islamic Foundation Bangladesh), মাদ্রাসা-ই-আলীয়ার ইতিহাস, মাওলানা মমতাজ উদ্দীন আহমদ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ)। তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত আলীয়া মাদ্রাসার Syllabus ও Curricullum শুধু ঐ মাদ্রাসায় সীমিত না রেখে ব্রিটিশ শাসকরা তা বাধ্যতামূলকভাবে এই উপমহাদেশের সর্বত্র বেশির ভাগ মাদ্রাসায় চালু করলো। উপমহাদেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান হবার পর ঐ আলীয়া মাদ্রাসা উভয় পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পরও খ্রিস্টানদের তৈরি বিকৃত ইসলামের সেই পাঠ্যক্রমই চালু থাকে; শুধু ইদানীং এতে কিছু বিষয় যোগ করার চেষ্টা হচ্ছে যাতে মাদ্রাসায় শিক্ষিত দাখেল, ফাযেল ও আলেমরা দীন বিক্রি করে খাওয়া ছাড়াও ইচ্ছা হলে অন্য একটা কিছু করে খেতে পারে। যা হোক মুসলিম বলে পরিচিত জনসংখ্যাটি যাতে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য খ্রিস্টানরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তাদের তৈরি যে প্রাণহীন, আত্মাহীন বিকৃত ইসলামটা ১৪৬ বৎসর ধরে শিক্ষা দিয়েছিলো সেই বিকৃত, আত্মাহীন ইসলামটাকেই প্রকৃত ইসলাম মনে করে আমরা প্রাণপণে তা আমাদের জীবনে কার্যকরী করার চেষ্টায় আছি।
আমরা বারংবার এই বিষয়টিই বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, ধর্মব্যবসায়ী আলেম মোল্লাদের কাছ থেকে আপনারা যে ইসলামটি শিখেছেন এবং প্রাণপনে মানার চেষ্টা করছেন সেটা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়, বরং এটা ব্রিটিশদের শেখানো বিকৃত ও বিপরীতমুখী ইসলাম। এ কথাটি শুধু আমাদের কথা নয়। উপরোক্ত ‘আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস’ গ্রন্থের ভূমিকায় উক্ত মাদ্রাসার এককালের অধ্যক্ষ জনাব মোহাম্মদ ইয়াকুব শরীফ সত্যের খাতিরে বিবেকের তাড়নায় লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, “মুসলিমদের ইসলাম শিখানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে নি বরং মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।” উপকারী ফল আঙ্গুরের রস থেকে তৈরি হলেও যেমন মদ স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তেমনই কল্যাণকর, শান্তিদায়ক ইসলাম থেকে তৈরি বর্তমানের বিকৃত ইসলামটিও মানবসমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্রকৃত ইসলামটি মুসলিম জাতিকে সমস্ত পৃথিবীর কর্তৃত্বকারী শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিল আর বর্তমানের বিকৃত ইসলামটি মুসলিমদের নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত, সর্বনিকৃষ্ট দাসজাতিতে পরিণত করেছে; সুতরাং সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় দুটি এক জিনিস নয়। এই প্রচলিত ইসলামটি তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ খ্রিস্টানদের হাতে।