শিরোনাম দেখে অনেকে হয়তো অবাক হচ্ছেন এবং ভাবছেন আসলেই কি ফেরেশতারা মানুষ সৃষ্টির পক্ষে ছিলেন না? হ্যাঁ পাঠক, আসলেই তাই। যে সময়ের কথা বলছি তখন আল্লাহ আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন, পাহাড়-পর্বত, গ্রহ-নক্ষত্র, ফেরেশতাকূল (মালায়েক) সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু তখনও মানুষ সৃষ্টি করেননি। তারপর হঠাৎ একদিন আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের ডেকে বললেন- “নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা প্রেরণ করতে চাই।” আর তা শুনেই ফেরেশতারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে পবিত্র কোর’আনের সুরা বাকারায় আল্লাহ বলেছেন-
‘স্মরণ করো যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, “আমি পৃথিবীতে খলিফা সৃষ্টি করছি”, তারা বলল, “আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে ফাসাদ (অন্যায়-অবিচার) ও সাফাকুদ্দিমা (যুদ্ধ-রক্তপাত) করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।” (বাকারা: ৩০)
পাঠক লক্ষ করুন- এই আয়াতে আল্লাহ কিন্তু বলেননি তিনি পৃথিবীতে মানুষ নামের একটা সৃষ্টি পাঠাবেন। তেমনটা বললে হয়তো ফেরেশতারা কোনো আপত্তিই করতেন না। কারণ আল্লাহ ইতোমধ্যেই অগণিত জীব সৃষ্টি করেছেন, ফেরেশতারা তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। কিন্তু এবার আল্লাহ বললেন “খলিফা” সৃষ্টি করবেন। বোঝা গেল এই নতুন প্রাণীটি অন্যান্য প্রাণীর মতো হবে না বা ফেরেশতাদের মতোও হবে না। তারা হবে অনন্য। প্রশ্ন হলো- খলিফা শব্দ দ্বারা আল্লাহ কী এমন বুঝালেন, যা শুনেই ফেরেশতারা বলে উঠল- “তারা তো পৃথিবীতে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করবে?”
খলিফা অর্থ কী?
খলিফা আরবি শব্দ, যার অর্থ প্রতিনিধি। প্রতিনিধি শব্দটিকে একটু ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, কারণ এই শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্বের বিরাট রহস্য। প্রতিনিধি হলো এমন কেউ, যে অন্যের পক্ষ হতে দায়িত্ব পালন করে। যেমন, আপনার একটা দায়িত্ব আপনার প¶ থেকে আমি পালন করলে আমাকে বলা হবে আপনার প্রতিনিধি। তাই নয় কি? ধরুন, জাতিসংঘে একটা সম্মেলন হবে সেখানে সকল দেশের রাষ্ট্রীয় নেতারা একত্রিত হবেন। কোনো কারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেখানে নিজে যেতে পারলেন না। তাহলে তিনি কী করবেন? তিনি অবশ্যই সেখানে তার পক্ষে প্রতিনিধি পাঠাবেন। সমস্যা হলো- প্রতিনিধি পাঠানো মানে বিমানের টিকিট কিনে একজনকে প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া নয়। যাকে পাঠানো হবে, তাকে সেই অথরিটিও দিতে হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিনিধিত্ব করার। আর এটাই মারাত্মক। কারণ, অথরিটি পাবার পর সেই প্রতিনিধি যদি প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা অনুসরণ না করেন, যদি তিনি নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত দিয়ে আসেন, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশ।
এবার দেখুন মানুষ সৃষ্টির ব্যাপারটি। আল্লাহ যখনই বললেন মানুষকে খলিফা হিসেবে বা প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে পাঠাব, তখনই মালায়েকরা বুঝে গেল এই নতুন সৃষ্টিটির মধ্যে আল্লাহর স্পেশাল অথরিটি থাকবে, ক্ষমতা থাকবে। আর সেই ¶মতাগুলোর মধ্যে একটি হলো- স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি, যা খুবই বিপদজনক। এতদিন আল্লাহ যত সৃষ্টি করেছেন, কোনোটারই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ছিল না। আল্লাহ সূর্য সৃষ্টি করেছেন, যেভাবে বলে দিয়েছেন সেভাবেই সূর্য আলো ও তাপ বিকিরণ করে যাচ্ছে। তার একবিন্দুও ¶মতা নাই আল্লাহর এই হুকুম অমান্য করার। একইভাবে ফেরেশতাদেরও ¶মতা নেই আল্লাহর হুকুম অমান্য করার। কিন্তু যখনই আল্লাহ খলিফা বা প্রতিনিধি বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠাতে চাইলেন, তখনই ফেরেশতারা বুঝে গেলেন আল্লাহ এবার এমন একটা সৃষ্টি করতে চলেছেন যেটার মধ্যে আল্লাহর হুকুম মানা ও অমান্য করার ¶মতা থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেখতে চান- তারা কি আল্লাহর দেওয়া হুকুম বিধান মোতাবেক পৃথিবীকে পরিচালনা করে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে, নাকি খেলাফত বাদ দিয়ে নিজেরাই সর্বেসর্বা বিধানদাতা, আইনদাতা হয়ে যায়। আল্লাহর খেলাফত করলে তারা সফল হবে, কিন্তু যদি এই নতুন সৃষ্টি আল্লাহর হুকুম অমান্য করে, আল্লাহকে হুকুমদাতা বলে না মানে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তারা ফাসাদ (অন্যায় অবিচার) ও সাফাকুদ্দিমায় (যুদ্ধ রক্তপাত) পতিত হবে। আর সেটারই আশঙ্কা করেছিলেন ফেরেশতারা। বলেছিলেন- “আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করতে চান যারা পৃথিবীতে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা করবে?”
পাঠক! মালায়েকদের সেই আশঙ্কা অমূলক ছিল না তার প্রমাণ মানবজাতির ইতিহাসের দিকে তাকালেই পাওয়া যায়। মানবজাতি তার ইতিহাসজুড়ে বহু সফলতার গল্প রচনা করেছে, শহর বন্দর অট্টালিকা বানিয়েছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আকাশের বিদ্যুৎকে চাকরের মতো ব্যবহার করছে, সমুদ্রের তলদেশ থেকে সম্পদ তুলে আনছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে, কিন্তু ফেরেশতারা যে ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমার কথা বলেছিলেন, সেই ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমা মানুষ একদিনের জন্যও বন্ধ করতে পারেনি। কারণ, মানুষ আল্লাহর খেলাফত বাদ দিয়েছে। আল্লাহর দেওয়া স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান প্রত্যাখ্যান করে নিজেই জীবনবিধান বানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাকে এতখানি ক্ষমতা দেয়নি যা দিয়ে সে একটা ত্রুটিহীন জীবনবিধান বানাতে পারে। তার বানানো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ মুখ থুবড়ে পড়েছে, আর উপহার দিয়েছে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ। এখন শোনা যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি।
তাহলে কি ফাসাদ-সাফাকুদ্দিমা থেকে বাঁচার কোনোই উপায় নেই?
উপায় আছে। তবে তার জন্য মানবজাতিকে আগে এই সত্যটা স্বীকার করতে হবে যে, তারা আজ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে নিজেরা যত আইন, কানুন, দণ্ডবিধি, ব্যবস্থা, নীতিমালা ইত্যাদি তৈরি করেছে সব ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা স্বীকার করে তাদেরকে শেকড়ে ফিরে যেতে হবে। যে উদ্দেশ্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে অর্থাৎ আল্লাহর খেলাফত করা, সেটা শুরু করতে হবে। এই ঘোষণা দিতে হবে যে, আমরা এখন থেকে আল্লাহর হুকুম ছাড়া অন্য কারো হুকুম মানবো না। এই ঘোষণার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবজাতির সফলতা। এ সেই ঘোষণা যা মানবজাতির হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধির অধ্যায়গুলোর সাক্ষী হয়ে আছে। এই ঘোষণা ১৪০০ বছর আগের আরব থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে অর্ধেক পৃথিবীর চেহারা বদলে ফেলেছিল। অর্ধপৃথিবীর মানুষকে ভাই বানিয়ে দিয়েছিল, নিপীড়িত মানুষের মানবাধিকার ও নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই ঘোষণা এমন নিরাপত্তা উপহার দিয়েছিল যে, মানুষ ঘরের দরজা খুলে ঘুমাত, কোনো চোর ডাকাতের ভয় ছিল না। আদালতে মাসের পর মাস অপরাধ সংক্রান্ত কোনো মামলা আসত না। নারীরা শত শত মাইল পথ একাকী চলে যেত, মনে কোনো ভয় জাগ্রত হতো না। আজও সেই ঘোষণাই পারে মানবজাতিকে ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা থেকে মুক্ত করতে ইনশা’আল্লাহ।