হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রচলিত ইসলাম ইসলাম নয় কেন

Untitled-16-300x227আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর সময় এই দীনের মূলমন্ত্র রাখা হয়েছে-একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)- এবং পরে যোগ হয়েছে তদানীন্তন নবীর নাম। এই কলেমার মূলমন্ত্রে কখনো এই ইলাহ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ স্রষ্টা ব্যবহার করেন নি। এটা এই জন্য যে তিনি ‘একমাত্র’ হুকুমদাতা, একমাত্র সার্বভৌমত্বের মালিক যার আদেশ-নিষেধ ছাড়া আর কারো আদেশ নিষেধ গ্রাহ্য নয়, যার বিধান এবং নির্দেশ জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি ব্যাপারে অলংঘনীয়। কলেমার এই ঘোষণামতে কেউ যদি তাঁর কতগুলি আদেশ-নির্দেশ মেনে নিলো কিন্তু অন্য কতকগুলি অস্বীকার করল, তবে তিনি আর তার ‘একমাত্র’ ইলাহ রইলেন না। সংক্ষেপে এই দীনের ভিত্তি তওহীদের মর্মার্থ হচ্ছে আমি জীবনের প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য আছে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি যে বিভাগেই হোক না কেন, সেই ব্যাপারে আমি আর কারও কোনো বক্তব্য, নির্দেশ মানি না। যে বিষয়ে আল্লাহ অথবা তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য নেই সে বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। এর ঠিক বিপরীত হচ্ছে শেরক। সেটা হচ্ছে, জীবনের যেখানে, যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য বা বিধান আছে, সেখানে তাদের সেই বিধানকে অমান্য করে অন্য কারও তৈরি বিধান মানা। আজ এই শেরক-এ পুরো মানবজাতি আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। অথচ যে বা যারা আল্লাহর তওহীদে থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোনো একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরি আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে তাকে বা তাদের আল্লাহ মাফ না করার অঙ্গীকার করেছেন (সুরা নেসা ৪৮)। তাদের কোনো আমলই আল্লাহ গ্রহণ করবেন না।
আল্লাহর এই সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারেন আমরা কিভাবে কাফের মোশরেক হোলাম, আমরা তো নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্ব করি। তাদের এই মনোভাবের জবাবে বলতে চাই মক্কার কাফের মোশরেকরা রসুল (সা.) কে এই কথাই বলতো। রসুলাল্লাহর সমসাময়িক সময়ের যাদেরকে আমরা কাফের মোশরেক বলে জানি, অর্থাৎ আবু জেহেল, আবু লাহাব, ওতবা, শায়েবা, তাদের ধর্মীয় অবস্থা বর্তমান মুসলিম দাবিদারদের থেকে মোটেই আলাদা নয়। আমাদের মাঝে একটা ভুল ধারণা আছে যে তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখত না, আল্লাহকে আল্লাহ বলে মানতো না ইত্যাদি ইত্যাদি। আল্লাহর কোর’আন এবং ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানি করত, রোজা রাখত, আল্লাহর নামে কসম করত, আমাদের মতই এব্রাহীমকে (আ.)-তারা জাতির পিতা বলে বিশ্বাস করত, এব্রাহীম (আ.)-কে তাদের নবী হিসাবে মানতো। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে-শাদির কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো- বেস্মেকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ করছি) হে আল্লাহ, অর্থাৎ আমাদের মতোই। আরবের মোশরেকরা আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিল এ কথায় সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোর’আন- সুরা যুখরুফ- ৯)। এমন আয়াত আরও আছে। ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হলেন তারা আল্লাহকে গভীরভাবে বিশ্বাস করত। তারা হাবল লা’ত, মানাতের পূজা করত ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা আল্লাহ বলে বিশ্বাস করত না, ওগুলোকে স্রষ্টা বলেও মানতো না। তারা বিশ্বাস করত যে হাবল, লা’ত, মানাত, ওজ্জা এরা দেব-দেবী, যারা ওগুলোকে মানবে, পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা সেই আল্লাহর কাছেই সুপারিশ করবে (কোর’আন- সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার ৩)। ঠিক যেমন আজকে পীরদের ব্যাপারে মানুষ ধারণা করে থাকে।
আজকে মুসলিম নামক এই জাতি যে অবস্থায় আছে তাদের চাইতে কোন অংশে কম নয়। এরাও আল্লাহ বিশ্বাস করে, নিজেদেরকে মোহাম্মদ (সা.) এর উম্মাহ বলে বিশ্বাস করে, হজ্ব করে, কোরবানি করে, খাতনা করে। মক্কার ঐ লোকগুলো ব্যক্তি জীবনে এত কিছু করার পরও তাদেরকে আল্লাহ কাফের মোশরেক বললেন কেন? কারণ তারা আল্লাহর তওহীদ মানতো না, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মানতো না, তাদের জাতীয়, সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত করত নিজেদের সমাজপতিদের তৈরি করা আইন-বিধান দ্বারা। এজন্য আল্লাহর রসুল এসে প্রথমেই তাদেরকে অন্য কোন কিছু না বলে কেবলমাত্র তওহীদ মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন এবং প্রচণ্ড বাধা ও বিরোধিতা সত্ত্বেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কালেমার বালাগ চালিয়ে গেলেন। নবুয়তের প্রথম ১৩ বছর তিনি অন্য কোন কিছুর দিকে আহ্বান করেন নি। তিনি বলেন নি যে, তোমাদের হজ্ব হয় না, হজ্ব ঠিক করে নাও, নামাজ হয় না নামাজ ঠিক করে নাও, কোরবানি হয় না ইত্যাদি ঠিক করে নাও। এমন কি সমাজে তাঁর চোখের সামনে যে অবিচার হোত তিনি সেগুলোরও কোন প্রতিবাদ করেন নি। শুধু মাত্র নিরবচ্ছিন্নœভাবে তওহীদের ডাক দিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা হলে সমাজ থেকে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার অর্থাৎ অশান্তি দূর হয়ে যাবে।
বর্তমান দুনিয়াতে যে ইসলামটি চালু আছে তাতে এই তওহীদ নেই, সর্বত্র আল্লাহকে কেবল উপাস্য বা মা’বুদ হিসাবে মানা হচ্ছে, কিন্তু ইলাহ বা সার্বভৌমত্বের আসনে আল্লাহ নেই। তওহীদহীন ইসলাম মানেই প্রাণহীন, আত্মাহীন জড়বস্তু। মানুষ নিজেই এখন নিজের জীবনব্যবস্থা তৈরি করে সেই মোতাবেক জীবন চালাচ্ছে, মানুষ নিজেই ইলাহ অর্থাৎ বিধাতার আসনে আসীন। মানুষের তৈরি জীবন-ব্যবস্থাগুলিকেই (দীন) মানবজীবনের সকল সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান হিসাবে মনে করা হচ্ছে যদিও সেগুলির সবই মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। মানুষের ইলাহর আসন থেকে আল্লাহকে সরিয়ে (Dethroning) দিয়ে সেখানে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা- কে অর্থাৎ মানুষকে বসিয়ে (Replacement) যে ধর্ম পালন করা হচ্ছে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আমাদের বৃহত্তর ও সমষ্টিগত জীবনে গায়রুল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার ও গ্রহণ করে নিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের সার্বভৌমত্বটুকু আমরা আল্লাহর জন্য রেখেছি। সেই জাল্লে-জালাল, আযিজুল জব্বার, স্রষ্টা ভিক্ষুক নন যে তিনি এই ক্ষুদ্র তওহীদ গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ওটা তওহীদই নয়, ওটা শেরক ও কুফর।
আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনোটি স্বীকার, গ্রহণ করে নিলে সে আর মুসলিম বা মো’মেন থাকতে পারে না। কোনো লোক যদি ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী এবং জাতীয় জীবনের আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কারও যেমন- সংখ্যাগরিষ্ঠ জনংখ্যার, সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির, রাজা-বাদশাহর বা একনায়কের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী হয় তবে সে মোশরেক। আর উভয় জীবনেই কোন লোক যদি আল্লাহ ছাড়া ঐগুলির যে কোনটায় বিশ্বাস করে তবে সে কাফের। তাই যেহেতু এই মুসলিম দাবিদার জনসংখ্যাটি তাদের জাতীয় জীবনে কেউ গণতন্ত্র, কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ রাজতন্ত্র, কেউ একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্র-মন্ত্র, ism, cracy ইত্যাদি মেনে চলছে অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে ঐ সমস্ত তন্ত্রমন্ত্রের সার্বভৌমত্ব মানছে, সেহেতু তারাও কার্যতঃ (Defacto) জাতিগত হিসাবে মোশরেক ও কাফেরে পরিণত হয়েছে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...