ইলিয়াস আহমেদঃ
কালের ইতিহাসে সবকিছুই লেখা হয় না আবার কিছু কিছু জিনিস ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনও পড়ে না। আসলে এসব ইতিহাসও নয়, বলতে গেলে একেকটা বহমান ঘটনার বৃত্তান্ত। তেমনি একটি বৃত্তান্ত হলো- নগরসভ্যতার ¯পর্শ পেয়েও কোনো এক সমাজের স্বাভাবিক যুবকটি হঠাৎ করেই গেরুয়া বসনে উধাও হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন পর তার মুখ ভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ আর মাথাভর্তি চুলের নিথর দেহটি পাওয়া গেলো সমাজ-নগর-দেশ থেকে বহুদূরের কোনো এক গুহায় অথবা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট এক ঝোঁপঝাড়ে। সেই গেরুয়া বসনের যুবকটির কাছ থেকে পৃথিবী কিছুই পায় নি, সমাজ-দেশ-পরিবার তার দ্বারা উপকৃত হতে পারে নি। অথবা এটাও তো আমরা শুনে থাকব, কোনো এক মুদি দোকানদার বাবার সঙ্গে সেই কিশোরকাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সেই মুদি দোকান আর সংসারের দেখভাল করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি তার প্রাত্যহিক রুটিন ছিলো একই। দোকান অভিমুখী একই রাস্তায় যাতায়াত। তার দ্বারা পরিবার ব্যতীত মানবসমাজ তেমন উপকৃত হতে পারে নি। আচ্ছা, আমাদের কি মনে আছে ঐ যুবকটির কথা, যে কলেজ পাস করার পর সওদাগরী অফিসে একটা চাকরি পেয়েছিল? তারপর বিয়ে-সংসার। সেই সকাল থেকে বিকেল অবধি একটানা অফিস করার পর ক্লান্ত পায়ে সে বাজার করে বাড়ি ফিরত আর গিন্নী বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকত? আমাদের কি মনে আছে তাদের কথা? সারাজীবন অফিস আর সংসার করে করে বার্ধক্যে বেচারা বিষাদময় হতাশায় ভুগছিল- সারাজীবন সে কী করেছে? না পেরেছে জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে, না তার দ্বারা মানবসমাজ তেমন কিছু উপকৃত হয়েছে। নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে ভাবতে একসময় তার চিন্তাভাবনা থেমে যায় চিরতরে।
আবহমান জীবনযাপন আর ইতিহাস থেকে বের হয়ে যুগের হাওয়ায় এবার চলুন একটু ভাসি প্রগতির প্যারাস্যুটে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় চরম উন্নতির ফলে আমরা আজ অনায়াসেই কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে পারি, অন্যের সংস্কৃতি লালন করতে পারি। সদ্য উদ্ভব হওয়া কোনো সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারি। যেখানে সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটতে আগে সময় লাগত শত শত বছর সেখানে বছরে বছরে আমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মানদণ্ড ও সামাজিক অনুসর্গ-উপসর্গের পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু সংস্কৃতিতে নয়, এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যের কারণেই মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রিক, রোম, পারস্য নামের আজ অঞ্চলভিত্তিক কোনো সভ্যতা নেই। সব সভ্যতা মিলে আজ গ্লোবাল ভিলেজে একাকার হয়ে গেছে। যান্ত্রিক প্রগতির সাথে সাথে পাল্টে গেছে আমাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যান-ধারণা। গভীর রাতের পুকুরে ভাসমান আলেয়া আজ অবমুক্ত মিথেন, ঝাঁড়-ফুঁকে আজকাল তেমন একটা বিশ্বাস নেই মানুষের, যতোটা বিশ্বাস আছে একজন ডাক্তারের প্রতি। তাই বলে কুসংস্কারের বিশ্বাসী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ, মানসিক জরাবাতিকগ্রস্থ শ্রেণিটি যে নেই তা কিন্তু না। বরং তাদের সংখ্যাই প্রগতি ও আধুনিক চিন্তাধারার জনসংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি। এই যে বৃহৎ এক জনশক্তি যাদের একটু সচেতনতায় পৃথিবীতে নেমে আসত শান্তি, যারা ইচ্ছে করলেই পারত পৃথিবীটাকে সুন্দর করে সাজাতে, যারা ইচ্ছে করলেই পারত স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করতে তারা যেমন মৃত, বিকৃত, কুসংস্কারময় ধর্মকে আঁকড়ে ধরে বুঁদ হয়ে আছে অন্যদিকে যারা অশ্লীল-কুরুচিপূর্ণ পোষাক পরিধান করে, বিবিধ মাদকতা আর উন্মাদনায় ডুবে থাকে, নারী অধিকারের নামে তাকে শোবিজের হাঁটে নগ্ন-পোশাকে উপস্থাপন করে, তার দেহকে বিজ্ঞাপনের সামগ্রী বানায়, উদারতার নামে সমকামিতার কীর্তন করে, অর্থাৎ কথিত প্রগতিবাদীরা তারাও ভিন্ন ধাঁচের জরা-বাতিকগ্রস্থতায় আক্রান্ত। একজন কুসংস্কারে বিশ্বাসী আরেকজন অতি সংস্কারে বিশ্বাসী, একজন ধর্মান্ধতায় বুঁদ অন্যজন ধর্মহীনতায় বুঁদ, একজন আপাদমস্তক আবৃত করার পক্ষে অন্যজন যতদূর সম্ভব নগ্নতার পক্ষে। শান্তিলাভকে যদি উন্নতির মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে কোনটি শান্তিদায়ী। আমি বলব, দুটি শ্রেণির মধ্যে ফলাফলগতভাবে তেমন একটা পার্থক্য নেই। অর্থাৎ দুটো শ্রেণিই ভারসাম্যহীন, পরস্পরের প্রতি চরম বিদ্বেষে ভারাক্রান্ত অন্তর নিয়ে যাদের প্রতিটি দিন কাটে। কথা বলার সুযোগ পেলেই তারা একে অপরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে। তাই আসুন, যারা শান্তি চাই, তারা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে উভয়ের থেকে সমদূরত্বে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রশ্ন করি- এই উভয়ের মধ্যে কোনটাকে আমরা গ্রহণ করব- অন্ধত্ব না প্রগতি?
এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ধর্মান্ধতা-কূপমণ্ডূকতা-গোঁড়ামি-সাম্প্রদায়িকতা-কুসংস্কারমনার নামে স্থবিরতা মানবসমাজের গতিময়তাকে রুদ্ধ করে, পথিককে নতুন পথ সৃষ্টি করার প্রেরণা যোগায় না বরং প্রাচীন কানাগলিতে চলার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে, তথা শান্তি প্রতিষ্ঠায় এ সকল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয় কখনই কাম্য নয়। কারণ প্রকৃতি যেখানে নিয়ত গতিময়, পরিবর্তনশীল সেখানে আমরা মানুষ কোন যুক্তিতে অনড়, অচল একটি অবস্থানকে নিয়তির মতো ধরে রেখে স্থবিরতার পরিচয় দেব?
প্রাণিভূগোলে ‘মহাদেশীয় সঞ্চারণ’ (Continentall drift) নামে একটা তত্ত্ব আছে, যেখানে সময়ের প্রেক্ষিতে সাতটা মহাদেশের পরস্পর থেকে ক্রমমান দূরে সরে যাওয়ার ব্যাপারটা আলোকপাত করা হয়েছে। এই ‘মহাদেশীয় সঞ্চারণ’ দুয়েক দিনে হঠাৎ করেই সম্ভব হয় নি বা সে অনুযায়ী ঘটছেওনা; সময়ের প্রেক্ষিতে খুব ধীরে সেটা ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে। অর্থাৎ পৃথিবী শুধু আহ্নিক আর বার্ষিক গতিতেই গতিশীল এমনটি নয়, আন্তঃঅভ্যন্তরীণেও চলছে গতিময় পরিবর্তন। পৃথিবীতে অবস্থিত যত সৃষ্টি আছে সব কিছুই গতিশীল। অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে সবকিছু। ইলেকট্রনের প্রদক্ষিণ, আয়নের ছোটাছুটি, কোষের বিভাজন কেনোটাই স্থবিরতার পরিচয় দেয় না। জড় থেকে জীব সবাই তার নিজস্বগতিতে গতিশীল। কেউ থেমে নেই। আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভিদকে স্থির মনে হলেও তার অভ্যন্তরীণে মূল থেকে পাতায় পাতায় চলছে শ্বসন, প্রস্বেদন তথা আয়নের ছোটাছুটি, কোষের বিভাজন। অবাত শ্বসন-সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পন্নে সে সর্বদাই গতিশীল। এককোষী প্রাণী অ্যামিবা পর্যন্ত স্থির নয়, ক্ষণপদ সৃষ্টির মাধ্যমে সে ছুটে চলে জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখতে। সৃষ্টির সেরা মানুষের অভ্যন্তরেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে জৈবিক গতিময় ব্যবস্থা। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ, ধমনী-শিরার মাধ্যমে ক্রমাগত রক্তসঞ্চালন, কোষের বিভাজন ও দেহের বৃদ্ধি সবকিছুই প্রকৃতির সদাগতিয়মতার দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শুধু পৃথিবী ও তার সৃষ্টিতেই এই গতিময় অবস্থা বিরাজমান তা নয়, ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআনেও বলা হয়েছে, সৃষ্টির শুরু থেকেই মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। আল্লাহ বলেন, “আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই এর সম্প্রসারণকারী” (সুরা যারিয়াত ৪৭)। যদিও কয়েক দশক আগে এই তত্ত্বের ধ্যন-ধারণা ও প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী হাবল-এর (Hubble) মতো বিজ্ঞানীরা। যে কোনো অবস্থান থেকে দেখলে মনে হবে বাকি সবকিছু পিছিয়ে যাচ্ছে। এই সম্প্রসারণ দূরবর্তী ৩ঈ-২৯৫ গ্যালাক্সির জন্য প্রতি সেকেন্ডে ৯০,০০০ মাইল। যাইহোক, মূলকথা হলো পৃথিবীসহ মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সবই সাম্যাবস্থায় পরিণত হওয়ার অভিপ্রায়েই হোক আর অন্য কোনো অবস্থায় পরিণত হওয়ার লক্ষ্যেই হোক, ক্রমবর্ধমান গতিশীল। অর্থাৎ এতেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রাকৃতিকভাবেই পৃথিবীসহ মহাবিশ্বে যা কিছু আছে সবকিছুতেই গতিময় (Dynamic) একটা অবস্থা বিদ্যমান। পার্থক্য শুধু কার্যে-ক্ষেত্রে-ধরণে। কিন্তু সবার লক্ষ্যই যেন এক, অভিন্ন- এক মহা উদ্দেশ্য সাধনে সবাই মহা ব্যতিব্যস্ত- কেউ থেমে নেই।
এ থেকে বুঝা যায়, সৃষ্টিগত ভাবেই আমরা মানুষ গতিশীল। আমাদের অস্তিত্বজুড়ে স্পন্দন। গতিহীনতাই মৃত্যু। তাই জরা-বাতিকগ্রস্থতা, পিছুটান, স্থিতিশীল থাকা আমাদের সাজে না। সে অনুযায়ী স্থবিরতা আমাদের কখনোই কাম্য নয়, প্রগতিই আমাদের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত এবং অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি বর্তমান সভ্যতায় প্রগতি বলতে যা বুঝায় তা সর্বদাই শান্তিময় ও কল্যাণকর নয়। প্রগতির নামে আজ যা চলছে তা সবই শুধু স্থবিরতার নয় পশ্চাদগামিতার পরিচয় দেয়। যেমন প্রগতিবাদীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে যথেচ্ছ ইন্দ্রিয় উপভোগের স্বাধীনতা, এর মধ্যেই চলে আসে নগ্নতা, অশ্লীলতা, নারীদেহের বাণিজ্যিক ব্যবহার ও প্রদর্শনী, সমকামিতা ইত্যাদির অধিকার। এগুলো কোনটা প্রগতির পরিচয় বা নব আবিষ্কার? এর সবগুলোই সুদূর অতীতের বর্বর অসভ্যতার যুগগুলোতে মানুষ মাড়িয়ে এসেছে। প্রগতির পক্ষে যারা তাদের এটাতো মাথায় রাখতে হবে, প্রগতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মানবতার কল্যাণ। যে প্রগতি দিয়ে মানবতার কল্যাণ হয় না বরং যার ফলে বিদ্বেষ বাড়ে, পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত বাড়ে অপরাধ, ভারসাম্যহীনতা; যে প্রগতি মানুষকে শান্তি দিতে পারে না সেটা কখনই প্রকৃত অর্থ প্রগতি হতে পারে না- সেটা প্রগতির নামে প্রতারণা, পশ্চাদগামিতা। আজ অধিকাংশ মানুষই মনে করছেন, যে যত বেশি আধুনিক যান্ত্রিক প্রগতি ও সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে সে ততোই সপ্রতিভ, প্রগতিমনা, আধুনিকমনা। তাই যে ফেসবুক বোঝে না, তাকে ব্যাকডেটেড মনে করা হয় আর যে নায়ক-নায়িকাদের অনুকরণে পোশাক-আশাক পরে অষ্টবক্রকলেবর হয়ে নাকমুখ বাঁকা করে স্মার্টফোনে সেলফি তুলে থ্রিজি কানেকশান ব্যবহার করে আপলোড করতে পারে তাকেই আপটুডেট মনে করা হয়। সারাদিনরাত সামাজিক যোগাযোগ সাইটে বুঁদ হয়ে থাকা, বার-পার্টি-কনসার্টে, থার্টিফার্স্ট, ভালোবাসাদিবস, বন্ধুদিবস ইত্যাদিতে মাদকসেবনের পাশাপাশি রাতবেরাত বন্ধু-বান্ধবীর সাথে আড্ডা দেয়া, ডেটিং করা (বিস্তারিত না বললেও চলবে), ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে টিভির সামনে বসে খেলা-সিনেমা-সিরিয়াল দেখা, ঘরে কিংবা সাইবার ক্যাফেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ক¤িপউটারে গেম খেলা, সানগ্লাস আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে অস্বাভাবিক গতিতে বাইক চালিয়ে নায়কত্ব দেখানো, মুখে বাংরেজি বুলি ও খিস্তি-খেউড়, ইভটিজিং করা প্রভৃতি আধুনিক ও প্রগতিমনার অন্যতম শর্ত। আরেকটু আধুনিক হতে হলে এগুলোর পাশাপাশি ধর্মকে গালিগালাজ করতে হবে। যে যত বেশি এগুলোর সাথে আপডেট সে তত আধুনিক, তত স্মার্ট, তত প্রগতিশীল। কিন্তু আসলেই কি তাই? না। এগুলো আধুনিক যুগের অন্ধত্ব।
প্রতিটি জিনিসের ভালো মন্দ নির্ভর করে তার ব্যবহারের উপর। একটা মোবাইল বা ক¤িপউটারের আবিষ্কারে কোনো দোষ নেই, বরং আশীর্বাদ। এই যান্ত্রিক প্রযুক্তিকে যতক্ষণ মানবকল্যাণে ব্যবহার করা হবে ততক্ষণ সেটা প্রগতির পরিচয় দেবে কিন্তু যখনই সারা দিনরাত কেউ অপ্রয়োজনে টিভি-ক¤িপউটার-ইন্টারনেট-সামাজিক যোগাযোগ সাইটে বুঁদ হয়ে থেকে তার জীবন থেকে মূল্যবান সময়-শ্রম নষ্ট করে, অনুৎপাদনশীল, স্থবির, গতিহীন হয়ে বসে থাকবে তখন সেটা সার্বিক দিক দিয়ে কখনই প্রগতিশীলতার পরিচয় দেয় না। বরং সেই যান্ত্রিক প্রগতি তখন সার্বিক অধোঃগতির পরিচয় বহন করে। তাই যান্ত্রিক প্রগতির সাথে সার্বিক প্রগতিকে গুলিয়ে ফেলাটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল। যান্ত্রিক প্রগতিকে যদি আমরা সার্বিক প্রগতির লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চাই, তবে এমন কিছু সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যা আমাদের মন ও দেহের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ। এটা ভুললে চলবেনা যে, আমরা যন্ত্র নই, আমরা আÍা ও দেহের সমন্বয়ে মানুষ। যদি আÍা না থাকত তবে আমরা পুরোপুরি যান্ত্রিক প্রগতির উপর নির্ভরশীল হয়ে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে পারতাম। কিন্তু আমাদের আÍা সবসময় কর্মপালনে ব্যস্ত থাকতে চায় না, আÍা নির্দিষ্ট সময়ে নীরবতা চায়, চিন্তা ও কল্পনা করতে চায়। বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতায় ডুবে থেকে ক্লান্তি-শ্রান্তির পর অবশেষে পাশ্চাত্য দেশগুলোর মানুষ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, আমরা আসলেই শুধু দেহনির্ভর নয়, আমাদের আÍা বলেও কিছু একটা আছে। সেই আÍিক প্রশান্তির জন্য তারা বেছে নিয়েছে বিভিন্নরকম মেডিটেশন পদ্ধতি ও ধর্মান্তরিত হওয়ার সংস্কৃতি।
অতএব সিদ্ধান্ত এই দাঁড়ালো যে, মানবকল্যাণের লক্ষ্যে যে যান্ত্রিক প্রগতি সেটাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে হবে। আর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের দেহ ও মনের সাথে যা ভারসাম্যপূর্ণ তথা স্রষ্টার দেয়া জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই যে, যান্ত্রিক প্রগতির স্রষ্টা ও মালিক মানুষ নিজেই। কারণ, স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মাঝে কেবল মানুষকেই জ্ঞান নামের অমূল্য এক স¤পদ দান করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি আদমকে শিক্ষা দিলে সমস্ত বস্তুর নাম (সুরা বাকারা ৩১)। সেই জ্ঞান কী করে ব্যবহার করতে হয় সেটার জন্য তিনি দিয়েছেন বুদ্ধি-বিবেক। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর আল্লাহ তাকে জানালেন কোনটি তার জন্য ভুল এবং কোনটি সঠিক” (সুরা শামস ৮)। আর আমরা মানুষতো শুধু আল্লাহর দেওয়া অকল্পনীয় শক্তিশালী মস্তিষ্কটি খাটাচ্ছি আর পরিশ্রম করেছি, স্রষ্টাও তাই চেয়েছেন। ঐশী গ্রন্থ কোর’আনে তিনি বলেছেন, “আমি (আল্লাহ) মানুষকে শ্রমনির্ভরশীল করে সৃষ্টি করেছি” (সুরা বালাদঃ ৪)।
নদীর স্রোতধারা, ঝর্ণার প্রবাহ, সমুদ্রের ঢেউ, মেঘের বৃষ্টি, রৌদ্রের প্রখরতা, সূর্যের উদয়াচল থেকে অস্তাচল প্রত্যেকেই তার নিজস্ব জগতে গতিশীল (উুহধসরপ), কিন্তু মহা উদ্দেশ্য সাধনে সামষ্টিকভাবে প্রত্যেকেই অবদান রেখে চলেছে। প্রত্যেকের এই গতিময় অবস্থাই তাদের স্ব স্ব প্রগতির পরিচয় দেয়। তারা স্থির নয়, তারা থেমে নেই। তাদের মাঝে নেই জরা-বার্ধক্য-কূপমণ্ডূকতা-গোঁড়ামির মতো স্থবিরতা। কারণ বার্ধক্য তো তা-ই, মৃত্যু তো তারই হয় যে অনুৎপাদনশীল (টহঢ়ৎড়ফঁপঃরাব), যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো কিছুই রেখে যেতে পারে না। যে কেবলমাত্র নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রচেষ্টা করে, আÍকেন্দ্রিকতায় বুঁদ থাকে সে কখনোই প্রগতিবাদী হতে পারে না, সে স্থবির-জরাবাতিকগ্রস্থতায় যে আক্রান্ত হয়ে একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। আর যারা পরার্থে আÍত্যাগ করে তারাই প্রগতিবাদী তারাই শহীদ, তাদের কোনো মৃত্যু নেই। অমরত্বের আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। অমরত্বের আকাক্সক্ষাতেই আদম (আ.) ও মা হাওয়া গন্দম খেয়েছিলেন। আমরাও চাই অমর হতে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে, ইতিহাসের পাতায়, আমাদের কীর্তির মন্দিরে। কিন্তু সেই অমরত্বের পথ সবার ভাগ্যে জোটে না। সেই সুযোগ পৃথিবীতে আবার সৃষ্টি হয়েছে। আসুন, মানবকল্যাণকে সামনে রেখে সকল ধরণের জরা-বার্ধক্য-কূপমণ্ডূকতা-কুসংস্কার-গোঁড়ামি-ধর্মান্ধতা-অন্ধবিশ্বাস-একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি ডিঙ্গিয়ে ঝরনার মতো উদ্দাম ও তটিনির মতো চঞ্চল হই। ধর্মের নামে স্থবিরতা নয়, নয় প্রগতিবাদী ভুতের উল্টোমুখী গতি, আসুন সত্যিকার প্রগতিবাদী হই।