সুলতানা রাজিয়া
সমাজে নারী পুরুষের সঠিক অবস্থান ও নারী নেতৃত্ব নিয়ে বিস্তর মতভেদ থাকলেও তবে সকল আলেমই সুরা নেসার ৩৪ নং আয়াতটিকে ভিত্তি করে নিজেদের উপস্থাপন করেন। এ আয়াতটির অনুবাদ করা হয়, “পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে।”
এ আয়াতে সমাজের ক্ষুদ্রতম সংগঠন পরিবারে নারী ও পুরুষের কার কী অবস্থান, অধিকার ও কর্তব্য সেই মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে। এখানে আল্লাহ পুরুষের ক্ষেত্রে বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ‘কাওয়্যামুনা’ যার অর্থ হচ্ছে সুঠাম ও সুডৌল দেহবিশিষ্ট, মানুষের গঠন কাঠামো, ঠেক্না, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক, অভিভাবক, শাসক, নেতা (আরবি-বাংলা অভিধান ২য় খন্ড, পৃ ৫৩১- ই.ফা.বা.)। সুতরাং এই আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, পুরুষের দেহকাঠামো নারীর তুলনায় অধিক পরিশ্রমের উপযোগী, আল্লাহই তাকে রুক্ষ পরিবেশে কাজ করে উপার্জন করার সামর্থ্য বেশি দান করেছেন, তাই পুরুষের দায়িত্ব হলো সে পুরুষ শক্তি সামর্থ্য প্রয়োগ করে, কঠোর পরিশ্রম করে রোজগার করবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলিয়ে, শিল্পকারখানায় কাজ করে উপার্জন করবে এবং পরিবারের ভরণপোষণ করবে।
অপরদিকে নারীদেরকে আল্লাহ সন্তান ধারণের ক্ষমতা দিয়েছেন, সন্তানবাৎসল্য, চিত্তকোমলতা ও সেবাপরায়নতা দান করেছেন। তাই প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মূল কাজ হচ্ছে সন্তানধারণ করা, তাদের লালন-পালন করা, রান্না-বান্না করা এক কথায় গৃহকর্ম করা। আল্লাহ যেমন কোন প্রাণী সৃষ্টি করার আগেই তার জীবনোপকরণ বা রেজেকের বন্দোবস্ত করে রাখেন এবং সময়মত সরবরাহ করে যান, একটি পরিবারে পুরুষেরও অনেকটা সেই ভূমিকা, তবে ক্ষুদ্র পরিসরে।
সালাহ বা নামাজ হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির মডেল। এখানে প্রথম সারিতে পুরুষ এবং দ্বিতীয় সারিতে নারী। বাস্তব জীবনেও এই মডেলের রূপায়ণ ঘটা ইসলামের কাম্য। উপার্জন করা পুরুষের কাজ, তাই বলা যায় জীবিকার রণাঙ্গনে মেয়েরা দ্বিতীয় সারির সৈনিক। কখনও কখনও যদি অবস্থার প্রয়োজনে নারীকে প্রথম সারিতে গিয়ে জীবিকার লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হয় তাতে কোনো বাধা নেই। শোয়াইব (আ.) বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং তাঁর পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর দুই তরুণী কন্যা তাঁদের পশুপালের দেখাশোনা করতেন (সুরা কাসাস ২৩)। রসুলাল্লাহর অনেক নারী আসহাব পরিবারে পুরুষ সদস্য না থাকায় বা পুরুষ সদস্যরা জেহাদে অধিক ব্যস্ত থাকায় নিজেরাই কৃষিকাজ করে, কুটির শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করতেন, অনেকে ব্যবসাও করতেন।
যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রথম সারিতে থেকে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পুরুষদের কারণ তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য। সেখানে নারীর স্বাভাবিক অবস্থান দ্বিতীয় সারিতে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সৈনিকদের খাদ্য, পানি, যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের আনুষঙ্গিক উপাদান সরবরাহ, আহতদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া, নিহতদেরকে দাফন করা ইত্যাদি। রসুলাল্লাহর সময় নারীরা এই দায়িত্বগুলো পালন করেছেন। তবে যুদ্ধে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারা অস্ত্র হাতেও যুদ্ধ করেছেন। রসুলাল্লাহর সময়ে নারীদেরকে মাসলা মাসায়েলের জাল বিস্তার করে কোনো কাজে অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হয় নি। উটের যুদ্ধে উম্মুল মো’মেনীন আয়েশার (রা.) নেতৃত্বে বহু সাহাবি যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধটি নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও “নারী নেতৃত্ব হারাম” বলে তখন কেউ ফতোয়া দিয়েছেন বলে জানা যায় না।
আল্লাহর বিধানমতে কেবল একটি মাত্র পদ নারীকে দেওয়া বৈধ নয়, সেটি হলো- সমস্ত পৃথিবীময় উম্মতে মোহাম্মদী নামক যে মহাজাতি সৃষ্টি হবে সে জাতির এমামের পদ। আল্লাহ স্রষ্টা হিসাবে জানেন যে নারীর শারীরিক গঠন যেমন পুরুষের তুলনায় কোমল, তার দূরদর্শীতাও পুরুষের চেয়ে কম যা এই মহাজাতির কর্ণধারের থাকা চলবে না। এ কারণে নবী-রসুলের মধ্যে একজনও নারী নেই। পারস্যের সঙ্গে রোমের যুদ্ধের সময় রসুলাল্লাহ একটি পূর্বাভাষে বলেছিলেন, নারীর হাতে যে জাতি তার শাসনভার (এমামত) অর্পণ করেছে যে জাতি কখনো সফল হতে পারে না (তিরমিজি)। তবে স্বীয় যোগ্যতাবলে উম্মতে মোহাম্মদীর এমামের পদ ছাড়া অন্যান্য যে কোন পর্যায়ের আমীর বা নেতা সে হতে পারবে, কোন এলাকার প্রশাসকও (Governor) হতে পারবে। শুধু নারী হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে নেতৃত্বলাভের যোগ্যতা অযোগ্যতার মাপকাঠি নয়। পুরুষ যেহেতু পরিবারের সবাইকে ভরণ-পোষণ করাচ্ছে, লালন-পালন করছে কাজেই তার কথা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে শুনতে হবে, এটা একটি পারিবারিক শৃঙ্খলা। কিন্তু জীবনের অন্যান্য অঙ্গনে যার নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা বেশি সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তাকেই নেতা মনোনীত করার উদাহরণ আল্লাহর রসুলের হাতে গড়া উম্মতে মোহাম্মদী তাঁদের জীবনে ও কর্মে স্থাপন করে গেছেন।