হেদায়াতের জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য বিশেষ দান। পবিত্র কোর’আন হচ্ছে মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াহ বা পথনির্দেশ (সুরা বাকারা ২)। তাই কোর’আন শিক্ষা দিয়ে তথা দীন শিক্ষা দিয়ে তার কোনো বিনিময় মানুষ নিতে পারে না। কোর’আনের জ্ঞান মানুষের নিজস্ব জ্ঞান বা সম্পত্তি নয় যে একে পণ্যরূপে বিক্রি করা যাবে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “পূর্ববর্তী কেতাবে লিপিবদ্ধ আছে, আল্লাহ বলেছেন, “হে আদমের সন্তান! পারিতোষিক গ্রহণ ব্যতীত শি¶া দান কর, যেরূপভাবে তোমাদের পিতা পারিতোষিক দেওয়া ছাড়া শি¶ালাভ করেছে।” (ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে কুদসি।)
কোনো নবী-রসুল ইসলাম প্রচার করে তার বিনিময় গ্রহণ করেন নি। তারা বলেছেন, হে আমার সম্প্রদায়! এর (হেদায়াতের আহ্বান) পরিবর্তে আমি তোমাদের যুক্তিসঙ্গত। জাতির ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, জেহাদ ইত্যাদি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান শর্ত। সেই ঐক্যবিনাশী কোনো কথা বা কাজ হতে দেখলে রসুল (সা.) বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেন না। এই জাতিবিনাশী কাজগুলোর একটি হচ্ছে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অতি বিশ্লেষণ। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
একদিন একজন লোক এসে আল্লাহর রসুলের (সা.) কাছে অভিযোগ করলেন, ওমুক লোক নামাজ লম্বা করে পড়ান, কাজেই তার (পড়ানো) জামাতে আমি যোগ দিতে পারি না। শুনে তিনি (সা.) এত রাগান্বিত হয়ে গেলেন যে -বর্ণনাকারী আবু মাসউদ (রা.) বলছেন যে- আমরা তাকে এত রাগতে আর কখনও দেখিনি (হাদিস- আবু মাসউদ (রা.) থেকে বোখারী।)।
একদিন আল্লাহর রসুলকে (সা.) জানানো হলো, কিছু আরব সওম রাখা অবস্থায় স্ত্রীদের চুম্বন করেন না এবং রমজান মাসে সফরে বের হলেও সওম রাখেন। শুনে ক্রোধে বিশ্বনবীর (সা.) মুখ-চোখ লাল হয়ে গেলো এবং তিনি মসজিদে যেয়ে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর হামদ বলার পর বললেন-সেই সব লোকদের কী দশা হবে যারা আমি নিজে যা করি তা থেকে তাদের বিরত রেখেছে? আল্লাহর কসম তাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে বেশি জানি এবং বেশি ভয় করি (হাদিস-আয়েশা (রা.) থেকে বোখারী, মুশলিম, মেশকাত)।
আল্লাহ যতটুকু করতে বলেছেন তার থেকে বেশি করা সীমালংঘন, জুলুম। আল্লাহর বিধানের মধ্যে কঠোরতা বা তাশাদ্দুদ আরোপ করার ফলে কী হয়? আল্লাহর দীনের যে সহজ-সরল বৈশিষ্ট্য তা হারিয়ে দীন দুর্বোধ্য, জটিল, কষ্টকর ও কঠিন হয়ে পড়ে। তখন মানুষ দীনের বিধান পালনের বিষয়ে বিরূপ হয়ে যায়। দীন সাধারণ মানুষের বোধগম্যতা ও পালনের বাইরে চলে যায়। গুটিকয়েক লোক অতি কষ্ট করে এসব নিয়ম-কানুন পালন করেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বিধি-বিধান পালনের ক্ষেত্রে বীতশ্রদ্ধ ও হতাশ হয়ে পড়ে। এমন যেন না হতে পারে সে বিষয়ে আল্লাহর রসুল সদা-সর্বদা তাঁর সাহাবিদেরকে নসিহত ও নির্দেশ দিয়ে গেছেন এবং নিজেও সে মোতাবেক আদর্শ স্থাপন করেছেন। একটি উদাহরণ দিই। আনাস (রা.) বলেন, “একবার নবী (সা.) এর সঙ্গে আমরা সফরে ছিলাম। আমাদের কেউ সিয়াম পালন করেছেন আবার কেউ ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর প্রচণ্ড গরমের সময় আমরা এক প্রান্তরে অবতরণ করলাম। চাদরবিশিষ্ট লোকেরা আমাদের মধ্যে সর্বাধিক ছায়া লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। যারা সিয়াম পালন করছিল তারা কোন কাজই করতে পারছিল না। যারা সিয়াম রত ছিল না, তারা উটের তত্ত্বাবধান করছিল, খেদমতের দায়িত্ব পালন করছিল এবং পরিশ্রমের কাজ করছিল। তখন রসুলাল্লাহ বললেন, আজ তো সওম ভঙ্গকারীরা সমুদয় সওয়াব অর্জন করে নিল (বোখারি: ২৬৯১, মুসলিম: ২৪৯৩)।
সফরে সওম রাখার কষ্টকর অবস্থা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য আল্লাহ সওম রাখতে নিষেধ করেছেন, এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর রহমত। রসুলাল্লাহর জীবদ্দশায় সওম নিয়ে কোনো কঠোরতা কেউ আরোপ করতে পারেনি। বাড়াবাড়ির আতিশয্যে যারা সফরেও কষ্ট করে সওম রাখা শুরু করলেন বিশ্বনবীর (সা.) ভর্ৎসনা শুনে তারা আবার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু আজ এই জাতিকে কে বাড়াবাড়ি থেকে ফিরিয়ে আবার ভারসাম্যে আনবে? নবী তো আর আসবেন না, সুতরাং এ কাজ তাঁর প্রকৃত উম্মাহকেই করতে হবে।
আমার দেখা একটি ঘটনা বলছি। এক ভদ্রলোক উমরা হজ্ব করতে যাবেন। তাঁর বয়স পঁচাত্তরের বেশি। তাঁর সঙ্গে অন্তত আরো চল্লিশজন সমবয়স্ক মানুষও উমরা পালন করতে যাবেন। প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে করতে রমজান মাস শুরু হয়ে গেল। পহেলা রমজান তাঁর সৌদি আরবের মক্কায় যাওয়ার ফ্লাইট। বাংলাদেশে তখন চৈত্রমাসের লম্বা দিন। ভোর চারটায় উঠে তিনি প্রথম রমজানের সেহরি খেলেন। ছয়টার মধ্যে ঢাকা বিমান বন্দরে গিয়ে চার ঘণ্টা বসে থাকলেন। অপেক্ষার পর সোয়া দশটায় বিমান উড়ল। বিমান প্রথমে গেল দুবাইতে, সেখানে কয়েক ঘণ্টার বিরতি। তারপর গেল জেদ্দা, তারপর সেখান থেকে মক্কা। বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে দশটায় তিনি মক্কায় গিয়ে পৌঁছলেন। সারা রাস্তায় এই মানুষগুলি রোজা রেখেছেন।
সৌদি আরবের সময় আমাদের দেশ থেকে তিন ঘণ্টা কম, অর্থাৎ সেখানে সূর্যাস্ত হয় বাংলাদেশের তিন ঘণ্টা পর। মুসাফির বা অসুস্থ মানুষের জন্য সওম প্রযোজ্য নয়, এ কথা পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “যে লোক অসুস্থ অথবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করে নিবে (সুরা বাকারা ১৮৫)। কিন্তু হজ এজেন্সির মুয়াল্লিম (শিক্ষক বা তত্ত্বাবধায়ক), শুনেছি তিনি নাকি একজন মুফতি, তিনি হাজিদেরকে সওম ভাঙার অনুমতি দিলেন না। যুক্তি হিসাবে বলা হল, রসুলের যুগে উত্তপ্ত মরুভূমির মধ্যে উটের পিঠে সফর করতে হত। বর্তমানে প্লেনে করে সফর আরামদায়ক। তাই বর্তমানে ঐ বিধানের সুবিধা নেওয়া চলবে না। ফলে এই বৃদ্ধ মানুগুলোকে সেদিন প্রায় সাড়ে ষোল ঘণ্টা সওম রাখতে হয়েছিল। ফ্লাইটে তাঁর চেয়েও শক্ত মানুষ ছিলেন, তাদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম জারি থাকল।
এটাই হচ্ছে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি, যা আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে হারাম, নিষিদ্ধ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণেও আল্লাহর রসুল বলেছেন, “হে মানুষ! তোমরা কখনোই দীন (বিধি-বিধান) নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না- কারণ অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।” তিনি আবু মুসা (রা.) ও মু’আয (রা.) কে ইয়ামেনে দীন প্রচার, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন, “তোমরা (দীন পালনকে) সহজ কর, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ করো না। পরস্পর মেনে ও মানিয়ে চলো, মতবিরোধ করো না। (বোখারি ৩০৩৮, মুসলিম ৪৬২৬)।
আমরা বর্তমানে যেমন দেখি, আমাদের আলেম ওলামারা রমজান মাসে বেশ আয়োজন করে প্রশ্ন-উত্তরের অনুষ্ঠান করেন। সেখানে সওম পালনের খুঁটিনাটি মাসলা-মাসায়েল নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রশ্নের সংখ্যা হাজার হাজার। বেশিরভাগই কী করলে সওম ভাঙবে তা নিয়ে, যেমন ঢেকুরের সঙ্গে আসা খাবার বা দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার গিলে ফেললে রোজার ক্ষতি হবে কিনা, রোযাদার ব্যক্তি পানিতে বায়ু ছাড়লে রোযা নষ্ট হবে কিনা, রোজা অবস্থায় এন্ডোস্কপি করা যাবে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু আল্লাহর রসুল বেশি প্রশ্ন করা অপছন্দ করতেন। ফলে তাঁর সাহাবিরাও তাঁকে খুব কমই প্রশ্ন করতেন।
ইমাম দারিমি (রহ.) তাঁর সুনান আদ-দারেমি নামক হাদিস গ্রন্থে এ সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীদের কিছু মতামত উল্লেখ করেছেন। যেমন ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “আমি রসুলাল্লাহর সঙ্গীদের চাইতে উত্তম কোনো মানব দল কখনো দেখিনি। রসুলাল্লাহর গোটা যিন্দেগীতে তাঁরা তাঁকে মাত্র তেরটি প্রশ্ন করেছেন। এর সবগুলোই কোর’আনে উল্লেখ হয়েছে। যেমন: ‘হে নবী! এরা তোমাকে হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধান জিজ্ঞেস করছে’। অথবা হে নবী তাঁরা তোমার নিকট হায়েয সংক্রান্ত বিধান জানতে চাচ্ছে’ -প্রভৃতি।
অতঃপর হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: “সাহাবীগণ কেবল সেইসব প্রশ্নই করতেন, যা ছিল তাঁদের জন্যে উপকারী।” তাঁরা প্রশ্ন করতেন নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে। সম্ভাব্য পরিরিস্থিতি কল্পনা করে কোনো প্রশ্নই তারা করতেন না। এমন প্রশ্ন কেউ করলে উমর (রা.) তাকে রীতিমত অভিশাপ দিতেন। উমার (রা.) মিম্বারে আরোহণ করে বলেছেন, “আমি আল্লাহর নাম নিয়ে যা ঘটেনি সে সম্পর্কে কোন ব্যক্তি কর্তৃক প্রশ্ন করাকে নিষিদ্ধ করছি। কারণ যা কিছু ঘটবে তার সব কিছুরই বিবরণ আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন (দারেমি ১/৫০)।
কাসেম (রা.) লোকদের সম্বোধন করে বলেন: “তোমরা এমনসব বিষয়ে প্রশ্ন করছ, যেসব বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্যে আমরা কখনো মুখ খুলিনি। তাছাড়া তোমরা এমনসব বিষয়েও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছ যা আমার জানা নেই। সেগুলো যদি আমার জানা থাকত, তবে তো নবী করীমের (সা.) ফরমান অনুযায়ী সেগুলো তোমাদের বলেই দিতাম।”
উমার ইবনে ইসহাক (রহ) বলেছেন: “রসুলাল্লাহর অর্ধেকের বেশি সাহাবীর সংগে সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি তাঁদের চাইতে অধিক জটিলতামুক্ত এবং কঠোরতা বর্জনকারী মানব গোষ্ঠীর সাক্ষাত পাইনি।”
মূলত সাহাবীরা রসুলাল্লাহকে যা করতে দেখতেন, যেভাবে করতে দেখতেন সেটার অনুসরণ করতেন। এটাই ছিল রসুলাল্লাহর শিক্ষাদানের পদ্ধতি। তিনি কখনও ব্যাখ্যা করে বলেননি যে ওজুর চার ফরজ না ছয় ফরজ, কয়টা ওয়াজিব, কয়টা সুন্নত ইত্যাদি। এগুলো বহু পরে ফকিহরা গবেষণা করে বের করেছেন।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে মসলা জানতে চাইলে বিশ্বনবী (সা.) প্রথমে তা সরলভাবে বলে দিতেন। কিন্তু কেউ যদি আরও একটু খুঁটিয়ে জানতে চাইতো তাহলেই তিনি রেগে যেতেন। কারণ তিনি জানতেন ঐ কাজ করেই অর্থাৎ অতি বিশ্লেষণ ও ফতোয়াবাজি করেই তার আগের নবীদের জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। কিন্তু তাঁর অত ক্রোধেও, অত নিষেধেও কোনো কাজ হয় নি। পরবর্তীতে তাঁর জাতিটিও ঠিক পূর্ববর্তী নবীদের (আ.) জাতিগুলোর মতো দীন নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে অতি মুসলিম হয়ে মসলা-মাসায়েলের তর্ক তুলে বিভেদ সৃষ্টি করে হীনবল, শক্তিহীন হয়ে শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের গোলামে পরিণত হয়েছে।
লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ
যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]