রিয়াদুল হাসান:
মক্কার কোরায়েশ বংশ ছিল পুরোহিত বংশ। তখন ক্বাবা শরীফের ভিতরে ও বাইরে সব মিলিয়ে তিনশ ষাটটি মূর্তি ছিল যেগুলির পূজা অর্চনা করার সময় কোরায়েশরা পুরোহিতের কাজ করতো। এই পুরোহিতরা পূজা ছাড়াও সমাজপতির দায়িত্ব পালন করতো। রসুলাল্লাহর গোত্রীয় চাচা আমর ইবনুল হাশেম ছিল সে সময়ে আরবের মধ্যে একজন খ্যাতিমান ও বড় আলেম, পুরোহিত ও গোত্রপতি। সবাই তাকে আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা বলে ডাকতো, যেমন আলেমরা নিজেদের নামের আগে লিখে থাকেন আল্লামা (মহাজ্ঞানী)। কিন্তু যখন আল্লাহর রসুল মানবজাতির উদ্দেশ্যে তওহীদের ডাক দিলেন তখন এই আবুল হাকাম তার জ্ঞানের পরিচয় দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হলো। সে হয়ে দাঁড়াল ইসলামের কট্টর শত্রু এবং কুফরের পতাকাবাহী। তার বিরোধিতামূলক কর্মকাণ্ড ও শত্রুতা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল যে রসুলাল্লাহ তাকে “এই উম্মাহর ফেরাউন” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, ‘যে আবু জাহেলকে আবুল হাকাম বলে ডাকবে সে সাংঘাতিক ভুল করবে। তার উচিত হবে এই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা’ (আনসাবুল আশরাফ-বালাজুরি)। কেবল আবু জাহেলই নয়, এব্রাহীম (আ.) এর আনীত দীনে হানিফের
বিকৃতরূপের ধ্বজাধারী মূর্তিপূজক পুরোহিত আলেম শ্রেণীর সকলেই ছিল রসুলাল্লাহর ঘোর বিরোধী। আর সমাজের যে নিরক্ষর, সাধারণ শ্রেণির মানুষগুলি যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ক্রীতদাস তারা যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং স্বয়ং আল্লাহর রসুলের কাছ থেকে ইসলামের আকীদা শিক্ষা করলেন, তারা হয়ে দাঁড়ালেন একেকজন নক্ষত্রসদৃশ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। ইসলাম সম্পর্কে তাদের থেকে কি কারও বেশি জানা সম্ভব? নিশ্চয় নয়। কিন্তু তাদের কেউই নামের আগে আল্লামা, মাওলানা জাতীয় কোনো খেতাব ব্যবহার করেছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
আল্লাহর রসুল বলেছেন, “তোমরা কীরূপ লোক থেকে তোমাদের দীন গ্রহণ করছো তা ভালোভাবে লক্ষ করো।” (মুসলিম, তিরমিযী, মেশকাত, শরহে নববী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, লুমাত, আশয়াতুল লুমাত, তা’লীকুছ ছবীহ, মোজাহেরে হক্ব)। তাই কারো থেকে দীনের জ্ঞান অর্জন করার আগে বিবেচনা করা উচিত যে এই জ্ঞান প্রদানের ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির কোনো স্বার্থ জড়িত রয়েছে কিনা। নিশ্চয় স্বার্থ মিশ্রিত হলে যে কোনো জ্ঞানই বিষাক্ত হয়ে যায়।
এ বিষয়ে আমীরুল মু’মিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ও কা’ব ইবনুল আহবার (রা.) এর কথোপকথনটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। ওমর (রা.) একদিন কা’ব (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আলেম বা ইলমের অধিকারী কে?” তিনি উত্তরে বললেন, “যারা ইলম অনুযায়ী আমল করে।” ওমর (রা.) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “কোন জিনিস আলেমদের অন্তর থেকে ইলমকে দূর করে দেয়?” তিনি উত্তরে বললেন, “লোভ অর্থাৎ দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাসিলের আকাক্সক্ষা।” (দায়েমী, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশায়াতুল লুময়াত, তা’লীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক, মিরআতুল মানাজীহ্)।
সুতরাং নিজেদের জ্ঞানকে পুঁজি করে যারা ধর্মব্যবসায় লিপ্ত হন তারা আর আলেম থাকেন না। স্বার্থচিন্তা তাদের জ্ঞানকে লুপ্ত করে দেয়, সেই জ্ঞান দিয়ে আর কারো কোনোরূপ মঙ্গল সাধিত হয় না, কেবল তার স্বার্থোদ্ধারই হয়। একইভাবে ধর্মবিশ্বাস যখন অন্ধবিশ্বাসে পরিণত হয় তখন খোদ ধর্মই বিষে পরিণত হয়। ঠিক যেভাবে খাদ্য থেকে পুষ্টির উপাদান পরিপাকের মাধ্যমে নিংড়িয়ে নিলে সেই খাদ্য বর্জ্যে পরিণত হয়। বর্তমানে ধর্মগুলো বিষে পরিণত হয়েছে। খাদ্য হিসাবে মানুষকে বর্জ্যই গেলানো হচ্ছে। তাই ধর্ম থেকে জন্ম নিচ্ছে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষতিকার প্যারাসাইট।
যারা সত্যিকার আলেম তারা কখনওই নিজেদেরকে ‘আলেম’ বা জ্ঞানী বলে মনে করবেন না। প্রকৃত আলেম হচ্ছেন মহান আল্লাহ। তাঁর একটি নামই হচ্ছে ‘আলেম’। আল্লাহর সৃষ্টি এবং আল্লাহর দীন সম্পর্কে যারা জ্ঞান অর্জন করবেন তারাও এক প্রকার আলেম বা জ্ঞানী। যদিও বর্তমানে কেবল দীন সম্পর্কে যারা জ্ঞানী তাদেরকেই আলেম বলা হয়, এই ধারণা এক প্রকার অন্ধত্ব। আল্লাহ ‘জ্ঞান’ বলতে কি বুঝেন? মুসা (আ.) একবার আল্লাহকে সাতটি প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিলো- আল্লাহ! আপনার বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানী কে? আল্লাহ বললেন- যে জ্ঞানার্জনে কখনো তৃপ্ত হয় না এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞানকেও যে ব্যক্তি নিজের জ্ঞানের মধ্যে জমা করতে থাকে (হাদীসে কুদসী- আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বায়হাকী ও ইবনে আসাকির; আল্লামা মুহাম্মদ মাদানী (র.) এর ‘হাদীসে কুদসী’ গ্রন্থের ৩৪৪ নং হাদীস, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)। এখানে লক্ষ করার বিষয় এই যে আল্লাহ জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমটি তাঁর দেয়া জ্ঞান যা তিনি সৃষ্টির প্রথম থেকে তাঁর নবী-রসুলদের মাধ্যমে তাঁর কেতাবসমূহে মানবজাতিকে অর্পণ করে আসছেন, যার শেষ কেতাব বা বই হচ্ছে আল-কোর’আন। এটা হচ্ছে অর্পিত জ্ঞান। আর মানুষ পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে জ্ঞান অর্জন করে তা হলো অর্জিত জ্ঞান। মুসার (আ.) প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ নির্দিষ্ট করে ‘মানুষের অর্জিত জ্ঞান’ বললেন, শব্দ ব্যবহার করলেন ‘আন্-নাসু’, মানুষ। অর্থাৎ যে আল্লাহর অর্পিত জ্ঞান, অর্থাৎ দীন সম্বন্ধে জ্ঞান, এবং মানুষের অর্জিত জ্ঞান- এই উভয় প্রকার জ্ঞান অর্জন করতে থাকে এবং কখনোই তৃপ্ত হয় না অর্থাৎ মনে করে না যে তার জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ হয়েছে, আর প্রয়োজন নেই, সেই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানী, আলেম। বর্তমানে যারা নিজেদের আলেম, অর্থাৎ জ্ঞানী মনে করেন, আল্লাহর দেয়া জ্ঞানীর সংজ্ঞায় তারা আলেম নন, কারণ শুধু দীনের জ্ঞানের বাইরে মানুষের অর্জিত জ্ঞানের সম্বন্ধে তাদের সামান্যতম জ্ঞানও নেই এবং সেই জ্ঞান সম্বন্ধে পিপাসাও নেই। রসুলাল্লাহর প্রসিদ্ধ সাহাবী ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি অধিক হাদীস জানে সে ব্যক্তি আলেম নয়। বরং যার মধ্যে তাকওয়া অধিক সে ব্যক্তিই আলেম (বর্ণনা ইবনে কাসীর)।
যাই হোক, যারা সকল জ্ঞানের স্রষ্টা, উৎস আল্লাহ থেকে জ্ঞান বা এলেম অর্জন করবেন তাদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকবে। এখানে আমরা প্রকৃত আলেম বলতে বুঝবো আল্লাহর রসুলের আসহাবগণকে যাদেরকে স্বয়ং রসুল নিজে ইসলাম শিখিয়ে গেছেন, ইসলামের জ্ঞান তাদের চেয়ে বেশি আর কারও থাকা সম্ভব নয়। রসুলের আসহাবগণের পরবর্তীতে যারা আলেম হতে চান তাদের চরিত্র ও কাজ আসহাবদের মতই হতে হবে। তা না হোলে যত বড় টাইটেলধারীই হোন না কেন, যত বড় আলখেল্লাধারীই হোন না কেন তারা প্রকৃত আলেম নন। এটি আমাদের কথা নয়, রসুলাল্লাহ আখেরি যামানার ধর্মব্যবসায়ীদের বেশভ‚ষা ও আচার আচরণ সম্পর্কে এমনটাই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। তিনি বলেছেন, “শেষ যামানায় কিছু লোকের উদ্ভব হবে যারা পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ধর্মকে প্রতারণার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবে। তারা জনগণের সামনে ভেড়ার পশমের মত কোমল পোশাক পরবে। তাদের মুখের ভাষা হবে চিনির চেয়ে মিষ্টি; কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র। আল্লাহ তা’আলা তাদের বলবেন: তোমরা কি আমার বিষয়ে ধোঁকায় পড়ে আছ, নাকি আমার প্রতি ধৃষ্টতা দেখাচ্ছ? আমার শপথ! আমি তাদের উপর তাদের মধ্য হতেই এমন বিপর্যয় (ফেতনা) আপতিত করব, যা তাদের খুবই সহনশীল ব্যক্তিদের পর্যন্ত হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ছাড়বে (আবু হুরায়রাহ রা. থেকে তিরমিজি)।
এখন যে সেই আখেরি যুগ এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। আমাদেরকেও তাই ধর্মব্যবসায়ী প্রতারক আলেম এবং সত্যনিষ্ঠ আলেমদের পার্থক্য সম্যকভাবে জানতে হবে, নতুবা পথভ্রষ্ট হওয়ার বিস্তর সম্ভাবনা রয়েছে।
১। প্রকৃত যারা আলেম তারা কখনও অহঙ্কারী হবেন না, কারণ অহঙ্কার কেবলমাত্র আল্লাহরই সাজে। প্রকৃত আলেমরা তাদের সঞ্চিত জ্ঞানকে খুবই সামান্য মনে করবেন এবং সর্বদা অতৃপ্ত থাকবেন। তারা নিজেদেরকে কখনওই আলেম বলে মনে করবেন না, দাবি করা, প্রচার করা বা আলেম খেতাব ধারণ করা তো দূরের কথা।
২। তারা আল্লাহর দীন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করবেন না। এই জ্ঞান অন্যকে দেওয়া তারা নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করবেন। আলী (রা.) কে রসুলাল্লাহ ‘জ্ঞান-নগরীর দ্বার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি কি আজকের আলেমদের মতো তাঁর জ্ঞান বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন? জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি কুলির কাজ করতেন এবং যাঁতার চাক্কি পিষে যবের আটা প্রস্তুত করতে গিয়ে তাঁর স্ত্রী জান্নাতের রানী মা ফাতেমার (রা.) পবিত্র হাতে কড়া পড়ে গিয়েছিল। এই জ্ঞানের দুয়ার আলীকেই (রা.) আমরা দেখি সিংহের বিক্রমে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। তার অনন্য সাহসিকতা ও বীরত্বের জন্য রসুলাল্লাহ তাঁকে আরেকটি উপাধি দিয়েছিলেন- সেটা হলো আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ। সুতরাং যিনি দীনের যত বড় আলেম হবেন তিনি তত বড় যোদ্ধা হবেন অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামী হবেন।
৩। দীনের জ্ঞান যিনি যত বেশি অর্জন করবেন, তিনি তত বড় দানশীল হবেন। যেমন আম্মা খাদিজা (রা.), আবু বকর (রা.)। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তারা প্রত্যেকেই ঐ সমাজের প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করতে করতে তারা এমন দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন যে, আবু বকরের (রা.) পরিবারের তিনবেলা ঠিকমত খাদ্যও জুটতো না। আর আম্মা খাদিজার (রা.) সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন যে, শি’আবে আবু তালেবে তিন বছর নির্মম অনাহারের ফলে তিনি মারাত্মক অপুষ্টিতে আক্রান্ত হন এবং এটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ।
৪। প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানীরা হবেন লোহার মতো ঐক্যবদ্ধ। কোনো দুনিয়ার সম্পদের লোভ লালসা (সামানান কালীলা) তাদের ঐক্যে ভাঙ্গন ধরাতে পারবে না। কারণ তারা জানেন ঐক্য নষ্ট করা কুফর। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাবেন না, গীবত করবেন না। কারও কোনো ভুল থাকলে তারা সেটা তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলবেন। পক্ষান্তরে আজকের সমাজে যারা আলেম বলে পরিচিত তাদের বিষয়ে একটি কথা বলা হয় যে, দু’জন আলেম এক বিছানায় শুতে পারেন না। দুনিয়ার সম্পদের দেনা-পাওনা, রাজনৈতিক স্বার্থ ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় তাদের মধ্যে অনতিক্রম্য দেওয়াল তৈরি করে রেখেছে, তারা একে অপরকে অনেকাংশেই প্রতিপক্ষ জ্ঞান করেন। তাদেরকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণও হাজার হাজার তাবুতে বিভক্ত।
৫। প্রকৃত আলেমরা হবেন সুশৃঙ্খল। আল্লাহর রসুলের হুকুমের শিকলে তারা নিজেদেরকে বন্দী রাখবেন। তাদের জাতি হবে একটি, তাদের এমাম হবেন একজন, দীন (জীবনব্যবস্থা) হবে একটি। তাদের সকলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও হবে অভিন্ন; সেটা হচ্ছে- সংগ্রামের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। তারা কোনোভাবেই জাতির এমামের বা নিজ আমীরের হুকুম অমান্য করবে না, হুকুম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন যেমনটা রসুলাল্লাহর সাহাবিরা করতেন। তাদের স্ত্রী, পুত্র, সহায় সম্পদ বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেত-খামার ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য দুনিয়ার বুকে বেরিয়ে পড়বেন, পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখবেন না। কিভাবে জীবনটা আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করা যায়, শহীদ হওয়া যায় এটাই হবে তাদের জীবনের একমাত্র বাসনা। যেমন রসুলাল্লাহর কাছ থেকে ইসলামের এলেম হাসিল করেছিলেন খালেদ (রা.)। যিনি জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আল্লাহর রাস্তায় এমনভাবে বহির্গত হয়েছিলেন যেন এক প্রচণ্ড সাইমুম। ইসলামের শত্রæদের উপর আঘাত হানার জন্য তিনি যে তলোয়ার কোষমুক্ত করেছিলেন তা কখনও কোষবদ্ধ করেন নি। লাখ লাখ সুশিক্ষিত সৈন্যের রোমান পারস্য বাহিনী কখনও তাঁকে এতটুকুও বিচলিত করতে পারে নি।
৬। প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানীরা যাবতীয় অন্যায় থেকে, গায়রুল্লাহর বিধান মেনে শেরক ও কুফর করা থেকে এমনভাবে হেজরত করবেন, এমন ঘৃণাভরে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করবেন যে, প্রয়োজনে তার জীবন যাবে, না খেয়ে থাকবে, অবর্ণনীয় দারিদ্র্যে পতিত হবে তবুও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবে না।
যারা মহানবীর (সা.) কাছ থেকে ইসলামের জ্ঞান লাভ করে ইসলামের ‘আলেম’ হয়েছিলেন তাঁদের চরিত্র এইসব বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ও মহীয়ান ছিল। অথচ দুঃখের বিষয় হলো আজ আলেম বলতে আমাদের সামনে সেই আসহাবদের জীবন ও চরিত্র ভেসে ওঠে না, ভেসে ওঠে এমন একটি শ্রেণির অবয়ব যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা না করে ইসলামকে বিক্রি করেই জীবন কাটিয়ে দিবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
আমরা চাই এ জাতির সত্যনিষ্ঠ আলেমদের কালঘুম ভাঙুক। যাদের উপর অন্যকে জাগানোর দায়িত্ব তারাই যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক কী হতে পারে! ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, “সত্যনিষ্ঠ আলেমদের সম্মান সাধারণ মো’মেনের তুলনায় ৭০০ গুণ বেশি।” আমরা সত্যনিষ্ঠ আলেমদের সম্মান করি। যে আলেমগণ নানাবিধ কারণে এখনও ধর্মব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন কিন্তু তাদের হৃদয় আল্লাহর প্রতি অনুগত, যারা মুসলিম উম্মাহর করুণ দুর্দশা দেখে ব্যথিত, তাদের প্রতি আমাদের কথা হচ্ছে:
আজ এই হতভাগ্য জাতিসহ সমস্ত মানবজাতি শেরক ও কুফরে ডুবে আছে, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের সার্বভৌমত্ব মেনে নিয়েছে। অথচ আল্লাহ এই উম্মাহকে শ্রেষ্ঠতম উম্মাহ বলেছেন (সুরা ইমরান ১১০)। আপনারা সামান্য কিছু অর্থ লাভের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে ছোট হয়ে থাকবেন না। এই হতভাগ্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আপনাদেরও আছে। দুর্নীতিবাজ সমাজপতি আর রাজনৈতিক ধান্ধাবাজেরা মনে করে আপনাদেরকে অর্থের বিনিময়ে তাদের পছন্দমত ফতোয়া দেওয়ানো যায়। বস্তুত পরমুখাপেক্ষী যারা হয় তাদের আর মেরুদণ্ড বলতে কিছু থাকে না। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা বেশিদূর এগুতে পারে না। বড় কোনো কোরবানি করার আত্মিক শক্তি তারা হারিয়ে ফেলে। তাই আপনারা এই জাতির কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে ধর্মব্যবসা পরিত্যাগ করুন এবং ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে, মতবিরোধ ত্যাগ করে মানবজাতির কল্যাণে তওহীদের উপরে ঐক্যবদ্ধ হোন, সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করুন। এই কাজ করতে গিয়ে আপনাদেরকে হয়তো কিছু অর্থকষ্ট সহ্য করতে হতে পারে, তবু ভয় পাবেন না। আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কাল রেখে হারাম উপার্জন বন্ধ করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম রেযেকের বন্দোবস্ত করে দেবেন এবং আপনাদের দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করে দেবেন। এক গৌরবময় জীবন আল্লাহর পক্ষ থেকে পাবেন।
সারা দুনিয়ায় মোসলেম জাতি আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে আছে। বিভিন্ন কুসংস্কারে তারা নিমজ্জিত। অশিক্ষা-কুশিক্ষা তাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এ জাতিটি সংখ্যায় ১৫০ কোটি হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্বের বিরাট ধন সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও পাশ্চাত্য জাতিগুলির দ্বারা লাঞ্ছিত, অপমানিত, নির্যাতিত হচ্ছে। তারা জাতীয় জীবনে আল্লাহ এবং রসুলের হুকুম বাদ দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা তথা দাজ্জালের হুকুম মেনে নিয়ে জাতিগতভাবে শেরক ও কুফরে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এতে করে একদিকে তারা যেমন ইসলাম থেকে বহির্গত হয়ে গেছে, অপরদিকে অন্য সকল জাতির ঘৃণার পাত্রেও পরিণত হয়েছে। তারা যে পরকালের জাহান্নামের দিকে ধাবিত হচ্ছে তাও অতি পরিষ্কার। জাতির নেতারা সাধারণ শ্রেণির মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে তাদেরকে দাবিয়ে রেখে আল্লাহ রসুলের হুকুম পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জাতির মধ্যে যারা সত্যনিষ্ঠ আলেম রয়েছেন তাদের জাতিরক্ষায় এগিয়ে আসা খুবই দরকার।