রিয়াদুল হাসান:
আধুনিক জ্ঞানে-বিজ্ঞান, যুক্তি, বুদ্ধি, প্রযুক্তির এই যুগে এসে যখন তথ্য যাচাই বাছাইয়ের অবাধ সুযোগ মানুষের হাতের মুঠোয়, এমন একটি পর্যায়ে মানবজাতি পৌঁছানোর পর মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীকে কতগুলো বিষয় অনুধাবন করতে হবে। যুক্তিশীল মানুষের কাছে ইসলামের আবেদন হারানোর অন্যতম কারণ এখনও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে গুজব শুনে হুজুগে মেতে ওঠার ব্যাপক প্রবণতা। এমন কি অধিকাংশ মুসলিম সেই সংবাদটির সত্য-মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজনীতাও বোধ করে না। অথচ এটা সরল সত্য যে গুজব বা হুজুগ কখনওই কোনো শুভফল বয়ে আনতে পারে না। বরং এ দুটোকে ব্যবহার করে সর্বযুগে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে কিছু মহল। ভাবতে অবাক লাগে মুসলমানেরা কী করে হুজুগ আর গুজবে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো! একটা গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় আর মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ হৈ হৈ রৈ রৈ করে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। এতে বদনাম হয় ধর্মের, অবমাননা হয় আল্লাহর, রসুলের। রসুলাল্লাহ এক মহান রেনেসাঁ সংঘটন করে শত শত বছর দীর্ঘস্থায়ী একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সভ্যতা নির্মাণ করেছিলেন, সেটা হুজুগের দ্বারা, গুজবের দ্বারা করা সম্ভব নয়। তিনি এমন লঘুস্বভাবের মানুষ ছিলেন না যে ক্ষণস্থায়ী একটি উত্তেজনা সৃষ্টি করে কার্যসিদ্ধি করে নিবেন। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরবজাতি অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গোত্রীয় হানাহানি, রক্তপাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়ে গেছে। এ রকম অর্থহীন কাজকে বন্ধ করে মানুষকে সভ্য বানানোর জন্যই ইসলাম এসেছিল। কিন্তু রসুলাল্লাহর বিদায়ের ১৪০০ বছর পর আমরা দেখি ফেসবুকে প্রচারিত একটি গুজবকে বা বানোয়াট ছবিকে কেন্দ্র করে আমাদের আলেম দাবিদার গোষ্ঠীটি ধর্মবিশ্বাসী মানুষদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের বিরুদ্ধে বিরাট দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিচ্ছেন যেখানে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটছে, উপাসনালয় ভাঙচুর হচ্ছে, মানুষের বাড়িঘর পুড়িয়ে ভস্মীভ‚ত করে দেওয়া হচ্ছে। ইসলামের নাম করে জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
শোনা কথায় কান দিয়ে আকস্মিক আবেগের বশে কোনো কাজ করা আল্লাহর সরাসরি নিষেধ, ইসলাম এর ন্যূনতম সম্ভাবনাকেও প্রশ্রয় দেয় না বরং নির্মূল করে দেয়। উড়ো কথা প্রচার করা বা কারো উপর অপবাদ আরোপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। কারো ব্যাপারে কোনো কথা শুনে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে প্রচার করা সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তারের অন্যতম কারণ।
১. আল্লাহ বলেছেন- মো’মেনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (সুরা হুজরাত-৬)।
২. আল্লাহ এটাও বলেছেন যে, হে মো’মেনগণ! তোমরা অধিকাংশ বিষয়ে অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ (সুরা হুজরাত ১২)।
৩. অনুমানকারীরা ধ্বংস হোক, যারা অজ্ঞতা ও উদাসীনতার মধ্যে রয়েছে (সুরা যারিয়াত ১০)।
৪. আল্লাহর রসুল বলেছেন, তোমরা ধারণা-অনুমান থেকে বেঁচে থাক কারণ ধারণা-অনুমান সর্বাপেক্ষা মিথ্যা কথা (বোখারি ৬০৬৬, ৬৭২৪, মুসলিম: ৬৪৩০)।
৫. আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই যাচাই না করেই অন্যের কাছে বর্ণনা করে দেয়।” (হাদীস-মুসলিম)।
রসুলাল্লাহর জীবনে এমন একটি ঘটনাও নেই যেখানে সাহাবীরা গুজবে মেতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করেছেন। এমন কি যুদ্ধের সময়ও তারা অত্যন্ত সতর্ক থেকেছেন যেন কোনো নির্দোষ বেসামরিক ব্যক্তি, নারী, শিশু, বৃদ্ধের উপর আঘাত না লাগে। কোনো ক্ষেত্রে যেমন মক্কা বিজয়ের সময় কিছু লোককে খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ভুল করে হত্যা করে ফেলেন। খবর জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর রসুল (সা.) আল্লাহর দরবারে নিজেকে এই ঘটনার সাথে অসম্পৃক্ত বলে ঘোষণা করেন এবং খালেদের এই ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চান। তারপর নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন এবং তাদের কাছেও ক্ষমা চান। বিজয়ী সেনাপতি কখনো ক্ষমা চায় এমন ইতিহাস মানবজাতির জীবনে আর আছে? সেদিন মক্কাবাসী ছিল অসহায়। রসুলাল্লাহ যদি প্রতিশোধ চাইতেন কী অবস্থা হতো মক্কাবাসীর? একদম মাটির সাথে পিষে ফেলতে পারতেন, সবার বাড়িঘর ভস্মীভূত করে দিতে পারতেন। কিন্তু রসুল তা করেন নি। তিনি দাঙ্গাবাজ ছিলেন না, তিনি ছিলেন যোদ্ধা। তিনি চিরকাল নিজের সেনাবাহিনীর চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন আর দুর্বল শত্রুকে ক্ষমা করেছেন, এটাই তাঁর জীবনে আমরা বার বার দেখতে পাই। এটাই হচ্ছে বীরত্বের নিদর্শন। বীর যুদ্ধ করে, কাপুরুষ দাঙ্গা করে।
মিথ্যার সুযোগ না নেওয়ার দৃষ্টান্ত:
আল্লাহর রসুল (স.) যে একজন সত্যনিষ্ঠ মহামানব ছিলেন এবং তিনি তাঁর জীবনে মিথ্যার ভিত্তিতে, গুজবের ভিত্তিতে, মানুষকে ধোঁকা দিয়ে কোনো উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেন নি তার প্রমাণ হিসাবে আরেকটা ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো। মদিনায় তাঁর ৩ বছরের ছেলে ইব্রাহীম যেদিন ইন্তেকাল করলেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ হলো। আরবের নিরক্ষর, অনেকটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের মনে এই ধারণা জন্মাল যে, যার ছেলে মারা যাওয়ায় সূর্যগ্রহণ হয়, তিনি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর রসুল, না হলে তাঁর ছেলের মৃত্যুতে কেন সূর্যগ্রহণ হবে? কাজেই চলো, আমরা তাঁর হাতে বায়াত নেই, তাঁকে আল্লাহর রসুল হিসাবে মেনে নেই, তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করি।
তাদের এ মনোভাব মুখে মুখে প্রচার হতে থাকল। আল্লাহর রসুল (সা.) যখন একথা শুনতে পেলেন, তিনি নিজ গৃহ থেকে বের হয়ে লোকজন ডাকলেন এবং বললেন, “আমি শুনতে পেলাম তোমরা অনেকেই বলছ, আমার ছেলে ইব্রাহীমের ইন্তেকালের জন্য নাকি সূর্যগ্রহণ হয়েছে। এ কথা ঠিক নয়। ইব্রাহীমকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন আর সূর্যগ্রহণ একটি প্রকৃতিক নিয়ম। এর সাথে ইব্রাহীমের মৃত্যুর কোনো স¤পর্ক নেই।” (হাদীস, মুগীরা ইবনে শো’বা ও আবু মাসুদ (রা.) থেকে বোখারী)।
ঘটনাটি এমন এক সময়ের যখন মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপড়েন ও বিতর্ক চলছে যে তিনি আসলেই আল্লাহর রসুল কি রসুল নন। এমতাবস্থায় রসুলাল্লাহ কিছু না বলে যদি শুধু চুপ করে থাকতেন, কিছু নাও বলতেন, দেখা যেত অনেক লোক তাঁর উপর ঈমান এনে ইসলামে দাখিল হতো, তাঁর উম্মাহ বৃদ্ধি পেত – অর্থাৎ যে কাজের জন্য আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছেন সেই কাজে তিনি অনেকটা পথ অগ্রসর হয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, এসেছিলেন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে, তাই মিথ্যার সাথে এতটুকুও আপস করলেন না। এতে তাঁর নিজের ক্ষতি হলো। কিন্তু যেহেতু এ কথা সত্য নয় গুজব, সত্যের উপর দৃঢ় অবস্থান থাকার কারণে তিনি সেটিকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন না। তিনি শক্তভাবে এর প্রতিবাদ করলেন, তিনি জনগণের ধারণাকে সঠিক করে দিলেন। নিজের স্বার্থে তাদের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করলেন না বা হতে দিলেন না।
এটাই ইসলাম। এটাই আল্লাহর রসুলের প্রকৃত আদর্শ। সে আদর্শ থেকে সরে গিয়ে অর্থাৎ হেকমতের দোহাই দিয়ে বা যে কোনো অজুহাতে মিথ্যার সাথে আপস করে যতই নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক দল, সংগঠন, আন্দোলন পরিচালনা করা হোক, লাখ লাখ কর্মীবাহিনী তৈরি করা হোক, সফলতা আসবে না, আখেরে মিথ্যাই বিজয়ী থাকবে।
আরবরা ছিল পৃথিবীর অন্যতম অজ্ঞ, শিক্ষাবঞ্চিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী। একবার মদিনায় একটি প্রচণ্ড শব্দ হলো। সেটা কিসের শব্দ তা কেউ বুঝতে পারল না। মদিনার লোকেরা ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কার উদয় হলো, কেউ ভাবল শত্রæ আক্রমণ করেছে, কেউ বা একে আসমানী গজবের আলামত মনে করল। লোকেরা সেই আওয়াজের দিক লক্ষ্য করে অগ্রসর হতে লাগল। একটু এগিয়েই তারা দেখতে পেল যে নবী করিম (সা.) সেই দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে আসছেন। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, “সবকিছু স্বাভাবিক আছে। তোমরা কোনো চিন্তা করো না।” আওয়াজটি রসুলাল্লাহর কানে যাওয়া মাত্রই কালবিলম্ব না করে তিনি একাই ঘোড়া ছুটিয়ে সেদিকে রওয়ানা দেন এবং নিজ জনগোষ্ঠীকে আস্বস্ত করেন। ঘোড়ার পিঠে রেকাব বা জিন যুক্ত করার সময়টিও তিনি নষ্ট করেন নি (হাদিস: আনাস রা. থেকে বোখারী)। এভাবে তিনি তাঁর জনগণের মধ্যে কোনো প্রকার গুজবের বিস্তার ঘটার কোনো সুযোগ দিলেন না, ঘটনাটিকে রাজনৈতিক স্বার্থেও ব্যবহার করলেন না। এমন একজন মহান ব্যক্তির অনুসারী হয়ে কী করে উম্মতে মোহাম্মদী বর্তমানের ন্যায় এহেন অযৌক্তিক ও গুজবনির্ভর জনতা হয়ে গেল? কী তাদের এমন অন্ধ আবেগে উন্মাদনাপ্রবণ করে তুললো?
এই ঘটনায় রসুলাল্লাহর সাহসিকতা ও ক্ষিপ্রতার পরিচয় পাওয়া যায়, নিজেকে অজানা বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে জাতিকে নিরাপত্তা প্রদানের যে অঙ্গীকার তিনি করেছেন তাঁর প্রতি ঐকান্তিক দায়বদ্ধতার নিদর্শনও এ ঘটনায় ফুটে ওঠে। আতঙ্ক বিস্তার করে স্বার্থ আদায় করা ইসলামের বৈশিষ্ট্য নয় সেটা নবী স্বয়ং প্রমাণ দিলেন। অথচ বর্তমানে কেবল আতঙ্ক বিস্তারের জন্য ইসলামিক জঙ্গিরা হোটেলে খেতে আসা নিরীহ সাধারণ মানুষকে রাতভর জবাই করছে, মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মানুষকে জবাই করার বীভৎস দৃশ্য ভিডিও করে তা অনলাইনে প্রচার করছে, যেন তাদের নৃশংসতা দেখে মানুষ শিউরে ওঠে। এসব ভয়াবহ বিকৃত চিন্তাভাবনাকে তারা আবার বিভিন্ন মাসলা মাসায়েল দেখিয়ে ইসলামসম্মত বলে প্রচারও করছে। তাদের এসব কাজের ফলে ইসলাম কেবল অমুসলিম নয়, মুসলিমদের কাছেও আবেদন হারাচ্ছে।