ইসলাম শুধু ব্যক্তিজীবনের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালনের ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এটি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বিচারিক, সামরিক ইত্যাদি সকল বিভাগের দিক নির্দেশনা প্রদান করে। আর রাষ্ট্রশক্তি তথা সার্বভৌমত্ব ছাড়া কখনওই একটি জীবনব্যবস্থা একটি জাতির জীবনে কার্যকর করা যায় না এটা সাধারণ জ্ঞান। এই সার্বভৌমত্ব আল্লাহর রসুল যে প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেটাই হচ্ছে ইসলামের নীতি ও প্রক্রিয়া। তিনি কী করেছিলেন? তিনি প্রথমে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পক্ষে, তওহীদের পক্ষে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। মানুষকে না বুঝিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে বা মানুষকে অন্ধকারে রেখে শাসন ক্ষমতা দখল করে নিয়ে তিনি মদিনার নেতা হন নি। মানুষকে সত্য বোঝানোর জন্য কী অকল্পনীয় ত্যাগ, কোরবানি, সবর তাঁকে করতে হয়েছে তা ইতিহাস। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যখন মদিনার জনগণ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব তথা আল্লাহ হুকুম স্বীকার করে নিল এবং রসুলাল্লাহকে তাদের পরিচালক হিসাবে তাদেরকে শাসন করার এখতিয়ার অর্পণ করল, তখনই রসুলাল্লাহ তাঁদের সর্বোচ্চ নেতা হলেন এবং সেখানে আল্লাহর বিধান দিয়ে তাদেরকে পরিচালিত করতে লাগলেন। ক্রমান্বয়ে পুরোনো সব ব্যবস্থা লুপ্ত হলো, এক নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হলো। এই নব সভ্যতা কেবল তাদের জাতীয় রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে নয়, তাদের চিন্তাচেতনা, সংস্কৃতির উপরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করল। ঐ নবগঠিত জাতির নিরঙ্কুশ সিদ্ধান্তদাতা ছিলেন রসুলাল্লাহ স্বয়ং। তিনি একাধারে বিচারক ছিলেন; বিচারক হিসাবে তাঁকে অপরাধীকে দণ্ড প্রদান করতে হয়েছে। তিনি সেনাপতি ছিলেন; সেনাপতি হিসাবে তাঁকে সামরিক কলাকৌশল নির্ধারণ থেকে শুরু করে সন্ধিচুক্তি, যুদ্ধাভিযান পর্যন্ত করতে হয়েছে। তিনি ঐ জাতির নেতা (এমাম) ছিলেন, তাই নামাজসহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গনের নেতৃত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা তাকে প্রদান করতে হয়েছে। আল্লাহর রসুল হিসাবে রেসালাতের বাণী প্রচার করেছেন, আত্মিক, মানসিক, শারীরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে উম্মাহ গঠন করেছেন।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা আর আজকের পৃথিবীতে যে ভৌগোলিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে তার ভিত্তি এক নয়, কাঠামোও এক নয়। ইসলামের ‘নেতা নির্বাচন পদ্ধতি’ আর প্রচলিত গণতান্ত্রিক ধারায় ‘নেতা নির্বাচন পদ্ধতি’ এক নয়। তবু উপায়ন্তর না পেয়ে অথবা হীনম্মন্যতাবশত পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিক প্রভুদের শেখানো রাজনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিগত শতাব্দীর অনেক চিন্তাবিদ কিছু রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেগুলোকে ইসলামিক মুভমেন্ট বা ইসলামি আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। এগুলো আসলে কী? কয়েকশত বছর আগে বিশ্বের মুসলিম এলাকাগুলো ইউরোপীয় খ্রিষ্টান জাতিগুলোর পদানত হয়। এই দাসত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতেও আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছে, এগুলো তারই একটি ধারা, প্রভুদের উদ্ভাবিত রাজনীতিক প্রক্রিয়ায় কয়েকশ বছরের গোলামি থেকে জাতিকে উদ্ধার করে ইসলামী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ।
সেই রাজনৈতিক দলগুলো সবই ব্যর্থ হয়ে গেছে অথবা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। অনেক দেশে এই দলগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। হয় তাদেরকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয় নি, অথবা যেতে দিলেও কিছুদিন বাদেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বা গণবিক্ষোভের কারণে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। এক কথায় তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছেন এবং হবেন। এর প্রধান কারণ পশ্চিমা প্রভুরা আসলে ইসলাম চায় না। তাই ইসলামপন্থীদের রাজনীতি করার সুবিধা দিলেও তাদের হাতে কর্তৃত্ব অর্পিত হোক এটা তারা মেনে নিতে পারে না। আর ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু পশ্চিমাদের পদ্ধতি মেনেই রাষ্ট্র পরিচালনার জায়গায় যান, তাই তাদেরকে সেখান থেকে নামিয়ে দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা সেই পাশ্চাত্য প্রভুদের হাতেই রয়ে যায়। এটাকে আর যা-ই হোক সার্বভৌমত্ব বলা যায় না। সার্বভৌমত্বের মানে হচ্ছে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। বস্তুত ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হবেই কারণ আল্লাহ মানুষকে একটি জীবনব্যবস্থা দান করবেন আর সেটা প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি মানুষ চিন্তা করে আবিষ্কার করবে এটা হতে পারে না। এই দলগুলোর প্রত্যেকটির কর্মসূচি তাদের নেতারা বসে তৈরি করেছেন, সেগুলো আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি নয়। আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি কোনটি তা আমরা ‘ধর্মব্যবসার উৎপত্তি’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। সেই হাদিসটির শেষাংশে আল্লাহর রসুল বলেছেন যে, যারা (ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদ) এই পাঁচটি কাজের ঐক্যবন্ধনী থেকে আধ হাতও বহির্গত হবে তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যারা জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করে তাদেরকে জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত করা হবে যদিও বা তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করে, সালাহ কায়েম করে, সওম পালন করে (হাদিস: আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত)। ব্রিটিশদের তৈরি করা রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি রসুলাল্লাহর ঘোষণা মোতাবেক জাহেলিয়াতের পদ্ধতি নয় কি?
সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ যুগে দেখে এসেছে যে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। পাশ্চাত্যে পাঁচশ বছর ধরে এই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। ব্রিটিশরাও ভারতবর্ষসহ মুসলিম অধ্যুষিত ভূমি দখল করে ইউরোপের সেই ব্যবস্থাই চাপিয়ে দিয়েছিল। এর আগে মুসলিম বিশ্বে ইসলামের নামেই শাসন চলত। খলিফা বা সুলতানদের নামে খোতবা দেওয়া হতো, মুদ্রার উপর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ খচিত থাকত। দণ্ডবিধি, অর্থনীতি, রাজস্ব, দেওয়ানী, ফৌজদারি ইত্যাদি বিষয়গুলো ইসলামের বিধি-ব্যবস্থা মোতাবেকই চালিত হতো। কাজিরা বিচার করতেন ইসলামের ফেকাহ আর ফতোয়ার কেতাব মোতাবেক। এভাবে সহস্রাধিক বছর ধরে চলেছে এবং মুসলিমরা এরই মধ্যে তাদের সোনালি যুগ অতিক্রম করেছে এবং আদর্শচ্যুত হয়ে পতনের কিনারায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশে যে গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, টাকায় আট মণ চাল ইত্যাদি প্রবাদগুলো চালু আছে তা ঐ মুসলিম শাসনামলেরই ইতিহাস।
মুসলিম শাসকদের পদস্খলন তাদের গোটা সভ্যতার উপর অভিশাপ হিসাবে ব্রিটিশদের ডেকে আনল। তারা শাসক হয়েই পূর্বের মুসলিম শাসিত অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবনব্যবস্থাটা আমূল পাল্টে দিল। তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাবঞ্চিত করে, কর্মবঞ্চিত করে একেবারে গণ্ডমূর্খ বানিয়ে ফেলল, শাসকের জাতিকে দাসের জাতিতে রূপান্তরিত করল, কৃষিকাজ হয়ে গেল তাদের প্রধান পেশা। দুইশ বছর গোলামির পর এই জাতির মনে মগজে গোলামি বেশ শক্তপোক্তভাবে আসন গেড়ে বসেছে। এরই মধ্যে মুসলমানেরা ভুলেও গেছে যে ইসলাম কেবল নামাজ-রোজা না, ইসলাম দিয়ে বিশ্ব চালানো যায়। জীবনের সর্বাঙ্গনের পূর্ণ ব্যবস্থা ইসলামে আছে। এই কথাগুলো মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করল রাজনৈতিক ইসলামি দলগুলো। তারা শাসনব্যবস্থায় ইসলামকে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজতে লাগল।
এখানে একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, মুসলিম বিশ্বে শত শত বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা রাজতন্ত্র চলেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। প্রমাণের চেষ্টা চলেছে যে, রাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের তেমন কোনো বিরোধ নেই। আবার যখন বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের জোয়ার বইছিল, তখন কোর’আন-হাদিস-ইতিহাস ঘেটে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সমাজতন্ত্রকে ‘ইসলামসম্মত’ প্রমাণ করা হলো। এর ভিত্তিতে দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক ইসলামি (Islamic socialism) দল গঠন করা হলো। তারা বলতে লাগল, খলিফা ওমর (রা.) হলেন আদর্শ সাম্যবাদী শাসকের উদাহরণ। পরে যখন সমাজতন্ত্রের বাস্তবরূপ মানবজাতি প্রত্যক্ষ করল, স্বপ্নবিলাস টুটে গেল। পতন হলো সমাজতন্ত্রের। আজ যখন বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের জোয়ার বইছে তখন রাজনৈতিক ইসলামের চিন্তানায়কগণ কমুনিজমকে কুফরি মতবাদ ফতোয়া দিয়ে গণতন্ত্রের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। তারা এবার গণতন্ত্রের ঘাড়ে চেপে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। তারা কথিত বাতিলের বিরুদ্ধে জেহাদ করছেন, জাতিকে ইসলাম শিখাচ্ছেন, গবেষণামূলক ইসলামী বই লিখছেন- সেগুলোর নাম দিচ্ছেন ইসলামি সাহিত্য। আর তাতে মোটাদাগে যে কথাটি উল্লেখ থাকছে তাহলো- ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ধর্ম! খলিফা আবু বকর (রা.) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং গণতন্ত্র মেনেই খেলাফত করে গেছেন। তিনি মজলিশে শুরা বানিয়েছিলেন যা হচ্ছে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ। আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, কোনোভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদি হিটলার-মুসোলিনি বিজয়ী হতেন তাহলে রাজনৈতিক ইসলামীরা ফ্যাসিবাদি ইসলাম আবিষ্কার করে ফেলতেন এবং স্বয়ং রসুল ও তাঁর খলিফাদেরকে সর্বকালের সেরা একনায়ক বলে প্রমাণ করে দিতেন। গরু আর বাঘ উভয়ই পশু। তাদের একটি করে মাথা, নাক ও লেজ, দুটো করে চোখ-কান, চারটা করে পা, লোমে আবৃত শরীরসহ অজস্র মিল রয়েছে, তাই বলে কি গরু আর বাঘ এক হয়ে গেল? তাদের উভয়ের মধ্যে অমিলও রয়েছে অসংখ্য। গরু শিংযুক্ত খুরবিশিষ্ট তৃণভোজী, নিরীহ পোষা প্রাণী আর বাঘ ঠিক উল্টো, সে মাংসভোজী, হিংস্র, ভয়ঙ্কর, বন্য, ধারালো দাঁত ও নখরবিশিষ্ট, দ্রুতগামী। এভাবেই প্রতিটি জীবনব্যবস্থার মধ্যে খুঁজলে অসংখ্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু মৌলিক বিষয়ে বৈপরীত্য রয়েছে। দীনের মূল বিষয়ই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব কার। এটাই হচ্ছে দীনের ভিত্তি। গণতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির, সমাজতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব একটি বিশেষ শ্রেণির যাদের পলিট ব্যুরো বলা হয়। রাজতন্ত্রে সার্বভৌমত্ব রাজার। আর ইসলামের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর। যখন ভিত্তিই আলাদা তখন গৌণ বিষয়ের সাযুজ্য সন্ধান করে ইসলমকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির সাথে তুলনা করা হাস্যকর। ইসলাম ইসলামই। অন্যান্য তন্ত্র-মন্ত্রের মধ্যে যারা ইসলাম খুঁজে বেড়ান তাদের অভিজ্ঞতা অন্ধের হাতি দেখার চেয়ে খুব ভালো হবে না। তাদেরকে যারা অনুসরণ করবে তারাও সেভাবেই পুরো হাতিকে বুঝতে পারবে না, জানতে পারবে না, দেখতে পারবে না।
উপনিবেশ যুগ সমাপ্ত হলে ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর পুরোধাগণ দেখলেন, এই সময়ে সরকার গঠন করতে হলে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ধাপ্পাবাজির রাজনীতি (যা ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে কোনোদিন অনুসরণ করে নি, এদেশেও করে নি। তারা শেষ দিন পর্যন্ত গণতন্ত্র নয় বরং বন্দুকের জোরেই শাসন চালিয়ে গেছে) যাকে ব্রিটিশরা নাম দিয়েছে ‘নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি’ সেটা অনুসরণ করেই ক্ষমতায় যেতে হবে। তারা সেই পথেই পা বাড়ালেন। আল্লাহর রসুল হেঁটেছেন আল্লাহর দেখানো পথে, আর রাজনৈতিক ইসলামিক দলগুলো হাঁটতে লাগলেন ব্রিটিশদের দেখানো পথে। এরপর তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠল প্রচলিত গণতন্ত্রের সাথে, আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সাথে ইসলামের সমীকরণ মেলানো। তারা প্রথমেই ব্রিটিশদের গোলাম মুসলমান জাতিকে এটা বললেন যে, “শোনো, ব্যক্তিগত উপাসনায় ব্যস্ত মুসলিমরা। ইসলামে কিন্তু রাজনীতি আছে, আল্লাহর রসুল রাজনীতি করেছেন। সুতরাং মুসলিমরা, তোমরা আমাদেরকে ভোট দিলে তোমাদের সওয়াব হবে, তোমরা জান্নাতে যাবে। আর আমাদের বিপরীত অবস্থানে থাকা অনৈসলামিক দলগুলোকে ভোট দিলে তোমরা জাহান্নামে যাবে।”
এখানে আরেকটি জটিল প্রশ্ন প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসে। নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ইসলামি দলও আবার শত শত। তাদের প্রত্যেকের আলাদা মার্কা, আলাদা কর্মসূচি, আলাদা ইশতেহার, আলাদা পতাকা। তারা একদল আরেকদলের এমন বৈরী যে রীতিমত সাপে নেউলে সম্পর্ক। তারা সবাই ধর্মবিশ্বাসী ভোটারদেরকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। তাহলে এত এত ইসলামি দলের মধ্যে কোন দলের ভোটাররা জান্নাতে যাবেন?
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, জান্নাতে যাবে কেবল মো’মেন (আল কোর’আন, সুরা মোহাম্মদ ১২, সুরা তওবা ৭২), আর মো’মেনরা তো হবে এক দলভুক্ত, একটি দেহের ন্যায় (আল হাদিস- মেশকাত), তারা হবে ভাই ভাই (কোর’আন, সুরা হুজরাত ১০) তাদের কর্মসূচি থাকবে একটি (আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত), তাদের নেতা হবে একজন, তাদের সবার লক্ষ্য হবে একদিকে। কোনো মসজিদে একই সাথে যেমন দুটো জামাত চলতে পারে না তেমনি একই সাথে পৃথিবীতে মুসলমানদের একাধিক ফেরকা, মাজহাব, তরিকা থাকতে পারে না। সালাতের সময় যেমন একজন মাত্র এমামের তাকবির সকল মুসল্লি মানতে বাধ্য থাকেন তেমনি মুসলিম জাতির মধ্যেও একজন মাত্র এমাম (নেতা) থাকবেন যার হুকুম সবাই মানতে বাধ্য থাকবে। সালাতের সময় যেমন প্রত্যেক মুসল্লির কেবলা (লক্ষ্য) থাকে একটি অর্থাৎ আল্লাহর ঘর ক্বাবার দিকে, তেমনি বাস্তব জীবনেও মুসলিম জাতির জীবনের লক্ষ্য হবে একটি, তা হলো মানবজীবনে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়ন করা।
কাজেই সফল তারাই হবে, জান্নাতে তারাই যাবে যারা দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রসুলের তরিকা (পথ, কর্মসূচি) মোতাবেক চলবে। নিজেদের আবিষ্কৃত বা ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের প্রদর্শিত পথে চলে জান্নাতে যাওয়া যাবে এমন কোনো অঙ্গীকার আল্লাহ দেন নি। “ইসলামে রাজনীতি আছে” এ কথাটি প্রতারণামূলক অর্ধসত্য। ইসলাম যেহেতু সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা তাই তার একটি রাষ্ট্রনীতি তো থাকতেই হবে কিন্তু ব্রিটিশদের রচিত রাজনৈতিক পদ্ধতি কি আল্লাহর রসুলের পদ্ধতি? আল্লাহর রসুল কি এই ধান্ধাবাজি আর প্রতারণার রাজনীতি করেছেন? কক্ষণো নয়। তারা স্রেফ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভোট নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত রাজনীতিকে ইসলামের রূপ দিয়েছে। তাদের চিন্তাবিদ ও আলেমগণ নানা কূটকৌশল (তাদের ভাষায় হেকমত) অবলম্বন করে কোর’আন, হাদিসের বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত উক্তি এবং রসুলের জীবনের নানা ঘটনার মতলবি ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে তাদের সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি ও সিদ্ধান্তগুলো ইসলামসম্মত। এভাবে ‘ইসলামে রাজনীতি আছে’ এই শ্লোগানটি দিয়ে ব্রিটিশের রাজনৈতিক পদ্ধতিকে জায়েজ করে ফেলা হলো। রসুলাল্লাহ বলেছেন, ‘যুদ্ধ মানেই হেকমত, কৌশল’। এই হাদিসকে নীতি হিসাবে গ্রহণ করে তারা রাজনৈতিক স্বার্থে সর্বপ্রকার মিথ্যা, শেরক ও কুফরের সাথে আপসও করে চলেছেন এবং নিজেরাও সেসবে লিপ্ত হচ্ছেন।
তারা জনগণকে বুঝ দেওয়ার জন্য বললেন যে, মদিনা ছিল একটি ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ যদিও জাতিরাষ্ট্রের বর্তমান ধারণা ১৪শ’ বছর আগে ছিলই না। ইসলামে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সীমানা বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ধারণাই নেই। তারা আল কোর’আনকে আধুনিক যুগের ভাষায় শুধুমাত্র ‘সংবিধান’ বলতে চান, কারণ এখন সব দেশে সংবিধান আছে। কোর’আন আর বর্তমানের সংবিধানের মধ্যে যে আসমান জমিন ফারাক সেটা তারা নিজেরা জানলেও জনগণকে সে বিষয়ে বলেন না। কোর’আন কোনো বিজ্ঞানের বই নয়, যদিও এতে বহু বৈজ্ঞানিক সত্য ও তত্ত্ব উল্লেখ করা হয়েছে, কোর’আন দণ্ডবিধি বা শরিয়তের বই নয়, যদিও এতে বেশকিছু দণ্ডবিধি সন্নিবেশিত হয়েছে। কোর’আন কোনো ইতিহাসের বই নয়, যদিও এতে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। কোর’আন সত্য ও মিথ্যার ফারাককারী এক মহা অলৌকিক ও বিস্ময়কর গ্রন্থ, একে আল্লাহ স্বয়ং বলেছেন উপদেশগ্রন্থ। এতে মানুষের আধ্যাত্মিক শুদ্ধতা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক, সামরিক, বিচারিক অর্থাৎ সামগ্রিক জীবনে শান্তিলাভের মূলনীতিগুলো রয়েছে। সেই চিরন্তন মূলনীতিগুলো পাল্টে ফেললে সেটা আর ইসলাম থাকে না। যুগের সাথে পোশাক পাল্টাতে পারে, যানবাহন পাল্টাতে পারে, প্রযুক্তি পাল্টাতে পারে কিন্তু দীনের মূলনীতিগুলো পাল্টাতে পারে না। তারা মদিনা সনদকে ‘গঠনতন্ত্র’ বলতে চান যেটা আসলে ছিল একটা নিরাপত্তা চুক্তি। এসব পরিভাষা তারা ব্যবহার করে ইসলামকে ঐ ব্রিটিশ রাজনীতির কাঠামোয় ফেলতে চান, জনগণের কাছে নিজেদেরকে ইসলামের খেদমতকারী হিসাবে প্রকাশ করতে চান। তারা যেহেতু মার্কা নিয়ে নির্বাচন করছেন, নির্বাচনকে বলেন জেহাদ আর ব্যালটকে বলেন সেই জেহাদের বুলেট। আল্লাহর রসুল (সা.) বা তাঁর সাহাবিরা কোনো মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন নি। ধর্মব্যবসা হারাম জেনেও এর বিরুদ্ধে তারা মুখ খোলেন না। ধর্মব্যবসায়ী ইমামদের পেছনেই নামাজ পড়েন, তাদেরকে হাতে রাখার চেষ্টা করেন। কারণ একটাই- তাদের ভোট দরকার আর ধর্মব্যবসায়ীরা জনগণের ধর্মানুভূতির উপর প্রভাবশালী। এখানে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না। আল্লাহ সুদ হারাম করেছেন। সুতরাং সুদমুক্ত কোনো ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করা গেলে ধর্মানুরাগীরা সেখানে টাকা গচ্ছিত রাখবেন। তাই তারা কায়দা করে এমন একটি ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু করল যাকে জনগণের সামনে ইসলামসম্মত ও হালাল বলে প্রচার করা হলো। ইসলামে যে পুঁজিবাদই হারাম আর ব্যাংক যে পুঁজিবাদেরই কার্যালয় সেটা আর কেউ জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিল না। তারা নিজেরা বৈশ্বিক সুদব্যবস্থার সাথে লেনদেন বজায় রাখলেন (এটা ছাড়া উপায়ও নেই), আবার জনগণকেও ইসলামিক ‘পুঁজিবাদ’ ধরিয়ে দিলেন। মানুষের ঈমানকে, ধর্মপ্রিয় মানসিকতাকে ব্যবহার করে তারা এভাবেই স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ইত্যাদি বহুপ্রকার ব্যবসা করেন। এগুলো তারা করতে পারবেন ঠিকই, আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু মানুষ কোনোদিন ইসলাম পাবে না। কারণ এগুলোও ধর্মব্যবসার একটি রূপ যা দ্বারা মানবজাতি কেবল প্রতারিতই হয়, ক্ষতিগ্রস্তই হয়।
একটি উদাহরণ দিলে ইসলাম ও রাজনৈতিক ইসলামের পার্থক্যটা হয়তো সুস্পষ্ট হবে। ধরুন দুই ঠিকানায় অবস্থিত সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের দু’টো বাড়ি। এর একটি হচ্ছে ইসলাম আরেকটি হচ্ছে বর্তমানের জাতিরাষ্ট্র। যারা প্রচলিত রাজনৈতিক তরিকায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা কী করছেন? তারা পশ্চিমাদের দেখানো পথ বেয়ে তাদের বাড়িতেই প্রবেশ করতে চাচ্ছেন। নিয়ত হচ্ছে, একবার ক্ষমতায় যাই। তারপর একটা একটা করে সেই বাড়ির ইট, কাঠ, জানালা, কামরা (বিধিবিধান, নীতিমালা) পাল্টে ফেলব। তারা বুঝতেই পারছেন না যে নতুন বাড়ি নির্মাণ করতে হলে পূর্বের বাড়ির ভিত্তিসহ চূর্ণ করতে হয়।
আল্লাহর বাড়িও আলাদা, আল্লাহর বাড়ির পথও আলাদা। অন্যের বাড়ির পথ দিয়ে আল্লাহর বাড়িতে ঢোকা যাবে না। পরের জমিতে বাড়ি বানালে সেই বাড়ি রক্ষা করা যায় না। আল্লাহ সত্যদীন দিয়েছেন, সেই দীন প্রতিষ্ঠার পথ দিয়েছেন, আলাদা কর্মসূচিও দিয়েছেন। সেগুলো সব বাদ দিয়ে পশ্চিমাদের তৈরি করা পথে ও প্রক্রিয়ায় আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা হবে না। তারা দুই একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে জনগণকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে, স্বপ্ন দেখিয়ে, তাদের ভোটব্যাংক ব্যবহার করে যদিও বা ক্ষমতায় বসতে পারেন, তাদেরকে তিউনিশিয়ার আন নাহ্দার মতো সংস্কারের মাধ্যমে নিজেদের মূল কাঠামোরই পরিবর্তন করতে হবে, প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক নীতিমালাই মেনে চলতে হবে। আজ যেমন বহু কট্টর বামপন্থী দল ভোল পাল্টে গণতান্ত্রিক হয়েছে, তেমনি বহু ইসলামিক দলকেও ভোল পাল্টে সেক্যুলার সাজতে হচ্ছে। একটা পর্যায়ে তারা ইসলামও মানতে পারবে না, আল্লাহর সার্বভৌমত্বও প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আর যদি একটুও এদিক সেদিক করে তাহলে পাশ্চাত্য তরিকায় গড়ে ওঠা দেশীয় সেনাবাহিনী আছে, তারা যেভাবে মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে এক বছরের ব্যবধানে গদিচ্যুত করে নেতাদের গণহত্যা করেছে, ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে তেমনটাই করবে। তারা কেউ ক্ষমতায় গিয়ে ‘খলিফা’ পদবি ধারণ করতে পারলেও গলার কাঁটা হয়ে থাকবে বিরোধীদলগুলো যারা নানা ইস্যুতে জ্বালাও পোড়াও করে ‘খলিফা’র ঘুম হারাম করে দেবে, জনপ্রিয়তা নষ্ট করার চেষ্টা করবে। জনপ্রিয়তা নষ্ট হলে পাঁচ বছর পরে ‘খেলাফত’ শেষ। আবার মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য রাজপথে বসে অপেক্ষা। এমন ভঙ্গুর ব্যবস্থা, বানরের মতো পিচ্ছিল বাঁশে আরোহণের ব্যবস্থা তো আল্লাহর ‘ইসলাম’ হতে পারে না।
আল্লাহর রসুল যেহেতু একজন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তিনি আমাদের জন্য আদর্শ হিসাবে রাষ্ট্রনীতিও রেখে গেছেন। তাঁর মূল নীতি ছিল সর্বদা সত্যের উপর সরল পথে অটল থাকা এবং পরিণতি যা-ই হোক সেটা আল্লাহর উপর সোপর্দ করে দেওয়া। তাতে সম্পত্তির ক্ষতি হয় হোক, জনপ্রিয়তা বাড়ুক বা কমুক সেটা নিয়ে তিনি কখনও চিন্তিত হন নি। কোনো প্রলোভনের কাছেই তিনি আত্মবিক্রয় করেন নি। যেনতেনভাবে রাষ্ট্রশক্তি অর্জনের চিন্তা যদি তাঁর থাকতো তাহলে মক্কায় থাকতে তো তাঁকে মক্কার শাসক, সুলতান হওয়ার প্রস্তাব করাই হয়েছিল। তিনি তো এটা ভাবতে পারতেন যে, আগে ক্ষমতাটা হাসিল করি, পরে আমার মনের মধ্যে যা আছে সেটা সুযোগ বুঝে বাস্তবায়ন করব। কিন্তু না, তিনি হেকমতের নামে ঐ বক্র পথে হাঁটেন নি। তিনি আল্লাহর হুকুমের পক্ষে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছেন। সেখানে প্রতিটি নাগরিকই ছিল রাষ্ট্রের ও ধর্মের পাহারাদার। আলাদা কোনো সামরিক বাহিনী ছিল না, আলাদা পুলিশ বাহিনী ছিল না। তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কাউকে কোনোদিন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন নি। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি নিজের কসম (ওয়াদা) দ্বারা কোন মুসলমানদের সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়, সে নিজের জন্য জাহান্নাম অবধারিত ও জান্নাত হারাম করে ফেলে। এক ব্যক্তি বললো, হে আল্লাহর রসুল (স.) যদি তা খুব নগণ্য জিনিস হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি একটা গাছের ডালও হয় তবুও (মুসলিম, নাসায়ী, ইবনে মাযাহ)।
ইসলামের নামে চলমান রাজনীতিতে ইশতেহারের মধ্যে প্রদত্ত শত শত অঙ্গীকার ক্ষমতায় গেলে ভুলে যাওয়া হয়, মনে থাকলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। সিস্টেমের কারণে চাইলেও অনেক কিছু করা যায় না। তাদের দলীয় নেতৃত্ব কর্মীদেরকে জেহাদের আয়াত, হাদিস ইত্যাদি বলে উদ্বুদ্ধ করেন কিন্তু নিজেরা কর্মীদের মতো কষ্ট করতে চান না। তারা আরাম-আয়েশের মধ্যে জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করতে ভালোবাসেন। তারা নিজেদের ছেলে মেয়েদেরকে বিদেশে পড়ান। আন্দোলনের চেয়ে আর্থিক সমৃদ্ধি, চাকুরি, ব্যবসা ইত্যাদিই তাদের ব্যস্ততা ও চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করে ও কসম খেয়ে (ওয়াদা) তার বিনিময়ে তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থ হাসিল করে, পরকালে তাদের কিছুই থাকবে না, আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের দিকে দৃষ্টি দেবেন না, এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (আল কোর’আন: সুরা আল ইমরান ৭৮)।
মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা হলো যে মিথ্যা ধর্মের নামে করা হয়, আল্লাহর নামে করা হয়। পলিটিক্যাল ইসলামের বড় বড় নেতারা এই জঘন্য মিথ্যাটিকেই তাদের রোজগারের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন। আসলে এরকম ছলনা তারা করতে বাধ্য। আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সোজা গাড়ি চালানো যায় না, আঁকাবাঁকাই চালাতে হয়। তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে না, তারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির কথা বলে রাজনীতি করে। সেই দলের নেতারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ দুর্নীতির আশ্রয় নেন, তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামলে তাদের চেয়েও বেশি দুর্নীতি আর ভণ্ডামির আশ্রয় নিতেই হবে। ব্রিটিশদের শেখানো পথে যারা রাজনীতি করবে তাদেরকে ধান্ধাবাজি, গলাবাজি, মিথ্যাচার, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, জ্বালাও- পোড়াও, ভাঙচুর, হরতাল-অবরোধ করতেই হবে। এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। তাই ইসলামের নামে যারা রাজনীতি করেন তারা একদিকে যেমন আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করেন অপরদিকে জনগণের সঙ্গেও প্রতারণা করেন।
তাদের সবচেয়ে বড় বোকামিটা এখানে। যারা সেক্যুলার রাজনীতি করেন তারা তাদের যাবতীয় অপকর্মকে শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ প্রমাণ করার চেষ্টা করেন না। তাই জনগণও তাদের কাছে শরিয়তসম্মত, ইসলামের নীতিসঙ্গত আচরণ আশা করে না, দীনের মানদণ্ডে তাদেরকে যাচাই করে না। রাজনীতিতে ধান্ধাবাজি চলে, প্রতারণা চলে এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু যারা ইসলামের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছে তাদেরকে মানুষ ইসলামের মানদণ্ডেই যাচাই করবে এটাই যুক্তিসঙ্গত, মানুষ দেখবে তারা কি অন্যদের মতো রাজনৈতিক মিথ্যাচারিতা করে, নাকি যা বলে তা কাজেও প্রমাণ করে। তাদের বক্তব্যের মধ্যে কোর’আন হাদিসের কথা থাকে, তাই তাদের বক্তব্যকে ইসলামের কথা বলেই জনগণ বিবেচনা করে। কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জনগণের এই চাহিদা কোনোদিন তারা পূরণ করতে পারবে না। এখানেই ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো হাজারবার ব্যর্থ হতে বাধ্য। ধর্মের নামে মিথ্যাচার, প্রতারণাকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ কারণে আমাদের দেশেও রাজনৈতিক ইসলামি দলগুলো জাতীয় নির্বাচন তো দূরের কথা, গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যান পদেও জিততে পারে না। দু’চার জন জিতলেও সেটা সামগ্রিক বিচারে এতটাই নগণ্য যে জাতীয় পর্যায়ে তাদের কোনো প্রভাবই সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। আর যেসব দেশে অমুসলিমরা সংখ্যাগুরু সেখানে রাজনৈতিক ইসলামের সফলতার সম্ভাবনা শতকরা শূন্যভাগ, যেমন ভারত, চীন, জাপান, রাশিয়া বা ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোয়। কারণ মুসলমানদের ভোটের উপর ভরসা করেই ইসলামিক দলগুলো রাজনীতি করে থাকে। যেখানে মুসলমানদের বাঁধা ভোটব্যাঙ্ক নেই সেখানে তাদের ভোটাভুটি করে ক্ষমতায় যাওয়াই সম্ভব নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রসুলকে দায়িত্ব দিয়েছে অন্যান্য সমস্ত দীনের উপরে এই শেষ জীবনব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাঁর উপাধি দিয়েছেন রহমাতাল্লিল আলামিন বা বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ। এক কথায় সমগ্র মানবজীবনে এই সত্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব আল্লাহ তাঁকে দিয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর নির্দিষ্ট কিছু ভূখণ্ডে দীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হতে পারে, আর বাকি পৃথিবীতে অসম্ভব সেটা কোনোভাবেই সার্বজনীন নীতি-প্রক্রিয়া হতে পারে না। আল্লাহ দীনুল হক দিলেন সারা পৃথিবীর জন্য কিন্তু এমনই প্রতিষ্ঠার তরিকা দিলেন (রাজনৈতিক ইসলাম) যা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশগুলোয় প্রয়োগ করা সম্ভব এটা কী করে হতে পারে? সুতরাং এটা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর দেওয়া পথ নয়, এটি মানুষের তৈরি পথ। ও পথে আল্লাহর ইসলাম প্রতিষ্ঠা হওয়া সম্ভব নয়। ধানচাষের প্রক্রিয়ায় আলু চাষ করা যায় না। এই দলগুলোতে বহু কর্মী আছেন যারা সত্যি সত্যিই ইসলামকে ভালোবাসেন, আল্লাহ-রসুলের বিজয় দেখতে চান। কিন্তু পথ ভুল হলে হাজার বছর চলেও গন্তব্যে পৌঁছা যায় না। এটা এসব দলের কর্মীরা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন ততই তাদের পক্ষে বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য ইসলাম নিয়ে কপটতার রাজনীতি করতে কিন্তু সেক্যুলার দলগুলোও কম যান না। প্রয়োজনে বাহ্যিক কিছু কাজ করে তারা দেখান যে নেতারাও অতি উৎকৃষ্ট মুসলিম। যেমন মসজিদ তৈরি ও মেরামত, টাকার নোটে মসজিদের ছবি ছাপান, শুক্রবারকে ছুটির দিন ঘোষণা করা, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, রাষ্ট্রধর্ম ইত্যাদি সংযোজন করা। প্রতি বছর সরকারি খরচে বিরাট বহর নিয়ে হজ্ব করতে যাওয়া এবং সেখানে সৌদি বাদশা ও শাহী আলেমদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজ নিজ দেশে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা, নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরুর আগে কোনো বিখ্যাত মাজারে গমন এবং লম্বা মোনাজাতের ব্যবস্থা করা, বড় কোন ইসলামের নামে সম্মেলনের শেষদিনে আখেরী মোনাজাতে উচু মঞ্চ বানিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে লম্বা দোয়া করা এবং সেটা সারাক্ষণ টেলিভিশনে দেখানো ইত্যাদি। ইংরেজিতে যাকে বলে Window dressing, বাইরে রং লাগিয়ে চকচকে করে মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। যেহেতু জনসাধারণ প্রকৃত ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ কাজেই তারাও খুব ইসলাম করা হচ্ছে মনে করে খুশি থাকেন। কিন্তু এসবকিছু করে ইসলামের কোনো উপকার হচ্ছে না, ইসলামের প্রতিশ্রুত ন্যায়, শান্তি, সাম্য, অর্থনৈতিক সামাজিক সুবিচার কিছুই মানুষ পাচ্ছে না। পাচ্ছে কেবল ধোঁকা। তাদেরকে সেক্যুলার দলগুলোও ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছে, ইসলামপন্থী দলগুলোও ধর্মের নামে ধোঁকা দিচ্ছে।
আজ গণতান্ত্রিক রাজনীতির মতো মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, সাধারণ মানুষের জীবন-সম্পদকে জিম্মি করে আন্দোলন ইত্যাদি কাজগুলোও অন্যান্য দলগুলোর মতো অনেক ইসলামি আন্দোলনও হরদম করে যাচ্ছে কিন্তু ইসলাম এগুলোর অনুমতি দেয় না, এগুলো ইসলামে নেই। আল্লাহর রসুল মক্কায় থাকতে অর্থাৎ রাষ্ট্র গঠনের আগে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করেন নি। তিনি সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে একবারও কোনো ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াওয়ের কর্মসূচি নিয়েছেন এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। এগুলো হচ্ছে ইসলামের মৌলিক নীতিপরিপন্থী কাজ যা সুস্পষ্ট সন্ত্রাস। ইসলামের নীতি হলো সত্য ও মিথ্যা মানুষের সামনে উপস্থাপন করা এবং সত্যের পথে যারা আসবে তাদেরকে নিয়ে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা। একটা পর্যায় আসবেই যখন সত্য বিজয়ী হবে আর সত্য বিজয়ী হতে গেলে মিথ্যার সঙ্গে চূড়ান্ত সংঘাত হবে, সেটা হলো যুদ্ধ, জেহাদ, কেতাল। সেটার জন্য ন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পক্ষে এক নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা লাগবে, মদিনার মতো একটা স্বাধীন ভূখণ্ড ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো লাগবে। এই শর্তগুলো পূরণ হওয়ার পরই রসুলাল্লাহ সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ইসলামের নীতিই হচ্ছে, কেউ যদি নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে তাহলে তাকে নেতৃত্ব লাভের অযোগ্য বলে গণ্য করতে হবে। অথচ প্রচলিত রাজনৈতিক পদ্ধতিই হচ্ছে, নিজের জন্য মনোনয়নপত্র কিনতে হবে, পোস্টার টানাতে হবে, আত্মপ্রচার করতে হবে এমন কি ঘুষ দিয়ে ভোট কিনতে হবে। অর্থাৎ ইসলামের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। রসুলাল্লাহ বলেছেন, তোমরা যখন কারো ভিতর নেতৃত্ব পাবার বাসনা, আকাঙ্ক্ষা দেখ সে যেন কখনও তোমাদের মধ্যে নেতা না হতে পারে। সুতরাং এটা হচ্ছে প্রথম নীতি। যারা রাজনৈতিক ইসলামের কথা বলেন তারা এই নীতিটা ভঙ্গ করতে বাধ্য হন।
আল্লাহর রসুল কোনোদিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোয়ালিশন করে, ভাগাভাগি করে ক্ষমতায় যান নি। তিনি যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছেন, সন্ধি করেছেন। এই সবই তিনি করেছেন কাফেরদের সঙ্গে। কিন্তু সত্য ও মিথ্যাকে, ঈমান ও কুফরকে, দীন ও তাগুতকে তিনি কোনোদিন মিশ্রিত হতে দেন নি। তার নীতি ছিল, মিথ্যার সাথে কোনো আপস হবে না। কিন্তু ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে কোনো পন্থা গ্রহণ করতে পারে। মানুষের অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, কখনও গুজব রটনা করে, কখনও মিথ্যানির্ভর হুজুগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে যেভাবে পারে উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করে। এতে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাছবিচার থাকে না।
রসুলাল্লাহর সমস্ত সংগ্রামের প্রতিপক্ষ ছিল কাফেরগণ। আজকে যারা নির্বাচনকে ‘এ যুগের জেহাদ’ বলে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চান তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে এই ভোটযুদ্ধ তারা কার বিরুদ্ধে করছেন তাদের ধর্মীয় পরিচয় কী? তারা কি মো’মেন না কাফের এটা আগে সুস্পষ্ট করতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মো’মেনদের সংগ্রাম নিশ্চয়ই হবে কাফেরের বিরুদ্ধে। সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলো এ ক্ষেত্রে বড় কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের ধর্মীয় পরিচয়টি স্পষ্ট করে না। প্রতিপক্ষ ধর্মীয় মানদণ্ডে হয় মো’মেন হবে নয় তো কাফের হবে, তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই। প্রতিপক্ষ যদি মো’মেন-মুসলিম হয় তাহলে লড়াই হতেই পারে না, তাহলে উভয়েই ভ্রাতৃবিরোধী সংঘাতের দরুন ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। আর যদি কাফের হয় তাহলে কাফেরদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ইসলামের যে নীতিগুলো আছে সেগুলো প্রযুক্ত হবে। মনে মনে তারা সেই প্রতিপক্ষ সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোকে তাগুত আর কুফরি শক্তি বলেই বিশ্বাস করেন, কিন্তু এ কথা তারা প্রকাশ্যে বলেন না, কারণ ও কথা বললে তো রাজনীতিই করা যাবে না। ক্ষমতার ভাগ পেতে তাদেরকে বিভিন্ন সেক্যুলার দলের লেজুড়বৃত্তি করতে হয়। কাফের ফতোয়া দিলে সেটা সম্ভব হবে না। এই লেজুড়বৃত্তিকে জায়েজ করার জন্য তারা মক্কার কাফেরদের সঙ্গে রসুলাল্লাহর করা হোদায়বিয়ার সন্ধির উদাহরণ টেনে আনেন। তারা ভুলে যান যে, সেই সন্ধিটি হয়েছিল কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনদের। এখানে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির প্রসঙ্গ টানার অর্থই হচ্ছে অপর পক্ষকে কাফের বলে সাব্যস্ত করা। এই আখ্যাটি তারা জনসমক্ষে দিতে পারেন না। তারা অন্তরে বিভেদ পুষে রেখে একই মসজিদে, একই ইমামের পেছনে নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়েই তারা একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হন। কিন্তু রসুলাল্লাহর সময় এই মো’মেন ও কাফেরের বিভাজনটা স্পষ্ট ছিল। যারা মোমেন তারা ছিলেন ভাই-ভাই, এক নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ। নামাজের সময় তারা যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতেন তেমনি বাস্তব জীবনেও তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের কাছে কে মো’মেন কে কাফের এ বিভাজন প্রকাশ্য ও স্পষ্ট ছিল। মক্কার কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনগণ কি এক জামাতে নামাজ পড়তেন, একসঙ্গে হজ্ব করতেন? প্রশ্নই আসে না।
আজকে ক্ষমতার মোহে পড়ে, ক্ষমতার চর্চা করতে গিয়ে সেক্যুলার দলগুলো যে সব দুষ্কর্ম করছে সেই দুষ্কর্মগুলোতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোও লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছে। কারণ প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে এছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এদেরকে এই দুষ্কর্মগুলো করতে হচ্ছে ইসলামের নাম দিয়ে, হেকমতের দোহাই দিয়ে। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করছি। প্রকৃত ইসলাম তেরশ’ বছর আগে হারিয়ে গেছে। আজ ‘মুসলিম’ অমুসলিম সব জাতিগুলোই পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, আইন-কানুন, দর্শনের প্রভাবাধীন। ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’র প্রচণ্ড প্রভাব সমস্ত পৃথিবীকে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত জাতিগুলি ব্যক্তিজীবনে যাই বিশ্বাস করুক সমষ্টিগত জীবনে অন্ধভাবে ঐ সভ্যতার নকল করছে। শুধুমাত্র মুসলিম জাতির মধ্যে কতকগুলি সংগঠন ছাড়া অন্য কোনো জাতি ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার সমষ্টি জীবনের ব্যবস্থা অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন ইত্যাদি প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে না। এই মুসলিম জাতির ভেতর যে সংগঠনগুলো সে চেষ্টা করছে সেগুলোর কোনো কোনোটির অনুসারী কোটির উপরে, আবার কোনো কোনোটি খুবই ছোট। কিন্তু ছোট বড় কোনোটাই ঐ ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার জীবন-দর্শনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সাম্যবাদ, অর্থাৎ কমিউনিজম যখন মহাপরাক্রমশালী, তখন ইসলামকে প্রতিষ্ঠার জন্য যে সব প্রচেষ্টা করা হয়েছিল তাতে সাম্যবাদও সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করা হতো। ঐ প্রচেষ্টায় কোর’আনের বিশেষ বিশেষ আয়াতগুলিকে প্রধান্য দেয়া হতো, যেগুলোতে আল্লাহ নিজেকে আসমান-জমীনের সব কিছুর মালিক বলে ঘোষণা করছেন। উদ্দেশ্য-সব কিছুর মালিকানা যখন আল্লাহর তখন সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের মত ইসলামেও ব্যক্তি মালিকানা নেই। বিশ্বনবীর (দ.) লক্ষ সাহাবাদের মধ্য থেকে বেছে নেয়া হলো আবু যরকে (রা.) একমাত্র আদর্শ বলে, কারণ, তার ব্যক্তিগত মতামতের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের দর্শনের কিছুটা মিল ছিল। সমাজতন্ত্রের সাথে ইসলামের এত যখন মিল তখন সৃষ্টি করা হলো ইসলামিক সমাজতন্ত্র। প্রায় তিনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই এই ইসলামিক সমাজতন্ত্রের সংগঠন হয়েছিল এবং পাকিস্তানের যুলফিকার আলী ভুট্টোর ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক (পি.পি.পি) দলসহ কয়েকটি দেশে কিছু দিনের জন্য সরকারও গঠন করেছিল। তারপর সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার কারণে যখন সেগুলো ম্লান হয়ে গেল তখন ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র জোরদার হয়ে উঠেছে। এখন চেষ্টা চলছে প্রমাণ করতে যে ইসলাম গণতান্ত্রিক, নাম দেয়া হচ্ছে ইসলামিক গণতন্ত্র। সেই আগের মতই কোর’আন থেকে বেছে বেছে আয়াত নেয়া হচ্ছে। ইহুদি-খ্রিষ্টান পদ্ধতির সঙ্গে আপসকে অর্থাৎ শেরক ও কুফরের সঙ্গে আপসকে যথার্থ প্রমাণের চেষ্টায় মহানবীর (দ.) মদিনায় ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে চুক্তির ঘটনা উপস্থিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রয়োজনে আল্লাহর রসুলও (দ.) মদিনার ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে আপস করেছিলেন। এর নাম এরা দিয়েছেন হেকমত। যে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সার্বভৌমত্ব আল্লাহ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের, সেই ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে সেই পদ্ধতিতে রাজনীতি করে এবং সেই পদ্ধতির নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের কাজকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টায় এরা এমন অন্ধ হয়েছেন যে, আপস ও চুক্তির মধ্যে বিরাট তফাৎ দেখতে পান না। আকিদা বিকৃতির জন্য ইসলামের প্রকৃত রূপ, অগ্রাধিকার এ সব এরা বোঝেন না বলে বিশ্বনবীর (দ.) ইহুদি ও মোশরেকদের সঙ্গে চুক্তিকে তাদের নিজেদের শেরক ও কুফরের সাথে আপসের সঙ্গে একই পর্যায়ে ফেলেছেন। আপস হলো কিছু দেয়া কিছু নেয়া, বিরুদ্ধ পক্ষের কিছু দাবি মেনে নেয়া ও নিজেদের কিছু দাবি বিরুদ্ধ পক্ষকে মেনে নেয়ানো। মদিনার চুক্তিতে বিশ্বনবী (দ.) বিরুদ্ধ পক্ষের অর্থাৎ ইহুদি ও মোশরেকদের পদ্ধতির (System) একটি ক্ষুদ্রতম কিছুও মেনে নেন নি, ইসলামের জীবন-ব্যবস্থার, দীনের সামান্য কিছুও তাদের উপর চাপান নি। কারণ তিনি আপস করছিলেন না। তিনি মদিনা রক্ষার জন্য শুধু একটি নিরাপত্তা চুক্তি (Security Treaty) করছিলেন। সম্পূর্ণ চুক্তিটির উদ্ধৃতি এখানে দিতে গেলে বই বড় হয়ে যাবে, শুধু প্রধান প্রধান শর্তগুলো পেশ করছি –
(ক) মদিনা শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ইহুদি ও মোশরেকরা মুসলিমদের সঙ্গে একত্র হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
(খ) যুদ্ধে ইহুদি ও মোশরেকরা তাদের নিজেদের খরচ বহন করবে, মুসলিমরা নিজেদের খরচ বহন করবে, যত দিনই যুদ্ধ চলুক।
(গ) ইহুদি ও তাদের সমগোত্রের লোকজন রসুলাল্লাহর (দ.) অনুমতি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না।
(ঘ) এই চুক্তির অধীন সমস্ত গোত্রগুলির মধ্যে যে কোন প্রকার বিরোধ বা গণ্ডগোল যাই হোক না কেন সমস্ত বিচার মহানবীর (দ.) কাছে হতে হবে।
এই কয়টিই হলো মহানবীর (দ.) ও মদিনার ইহুদি-মোশরেকদের মধ্যে চুক্তির প্রধান প্রধান (Salient) বিষয়, যে চুক্তিটাকে মদিনার সনদ বলা হয়। চুক্তির ঐ প্রধান প্রধান বিষয়গুলির দিকে মাত্র একবার নজর দিলেই এ কথায় কারো দ্বিমত থাকতে পারে না যে, বিন্দুমাত্র ত্যাগ স্বীকার না করেও মহানবী (দ.) এমন একটি চুক্তিতে ইহুদি ও মোশরেকদের আবদ্ধ করলেন- যে চুক্তির ফলে তিনি কার্যত (De Facto) মদিনার ইহুদি ও মোশরেকদের নেতায় পরিণত হলেন। তাদের নিজেদের যুদ্ধের খরচ নিজেরা বহন করে মহানবীর (দ.) অধীনে মুসলিমদের সঙ্গে একত্র হয়ে যুদ্ধ করার, মহানবীর (দ.) বিনা অনুমতিতে কারো সঙ্গে যুদ্ধ না করার ও নিজেদের মধ্যেকার সমস্ত রকম বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারের ভার মহানবীর (দ.) হাতে ন্যস্ত করার শর্ত্তে আবদ্ধ করে তিনি যে চুক্তি করলেন তা নিঃসন্দেহে একাধারে একটি রাজনৈতিক, কুটনৈতিক ও সামরিক বিজয়। মদিনা রক্ষার ব্যবস্থা তো হলোই, তার উপর তিনি কার্যত মুসলিম-অমুসলিম সকলের নেতায় পরিণত হলেন। যারা ‘হেকমতের’ দোহাই দিয়ে রসুলাল্লাহ ও আসহাবগণের করে যাওয়া সর্বাত্মক সংগ্রামের পথ ‘জেহাদ’ ত্যাগ করে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ করে মিটিং, মিছিল, শ্লোগান দিয়ে, মানুষের সার্বভৌমত্বের সংগঠনের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন, কিন্তু বিনিময়ে অপর পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিদান বা ত্যাগস্বীকার পান নি, তারা কেমন করে তাদের ঐ শেরক ও কুফরের কাজকে বিশ্বনবীর (দ.) ঐ মহা বিজয়ের সঙ্গে একই পর্যায়ে ফেলে তাকে ছোট করেন তা বোঝা সত্যিই মুশকিল।
রাজনৈতিক ইসলামের নেতৃবৃন্দের হেকমতের কোনো শেষ নেই। তারা মাঠে ময়দানে যাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটান, ইসলমাবিরোধী, তাগুতশক্তি ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে থাকেন, ভিতরে ভিতরে সেই প্রতিপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে গভীর আত্মীয়তা ও ব্যবসায়িক সম্পর্কও তৈরি করেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যেন ক্ষমতার পালাবদলে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ না হয়। বিশেষ বেকায়দায় পড়লে প্রতিপক্ষের দলে যোগদান করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। প্রয়োজনে দলে নামও পাল্টে ফেলেন, আদর্শের মধ্যেও রদবদল করেন। এহেন ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে ‘ইসলাম’ বলে চালিয়ে দেওয়া আল্লাহ ও রসুলের উপর ন্যাক্কারজনক অপবাদ আরোপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব কর্ম অন্যদের বেলায় খাটে, কিন্তু ইসলামের বেলায় খাটে না। এবং আল্লাহ বলেন, তার চেয়ে বড় জালেম কে যে আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপ করে? তারা আজ যেটাকে ‘পাক্কা হারাম’ বলছেন কাল সেটাকেই রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ‘হালাল’ বানিয়ে ফেলেন। আজকে তারা যাকে ‘ফেরাউন’ বলেন, কালই তার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন বা নির্বাচন করেন। তাদের দলে অনেক জনপ্রিয় খ্যাতিমান মোফাসসিরে কোর’আন, মুহাদ্দিস, মুফতি ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ থাকেন যারা দলের প্রয়োজনমাফিক শরিয়তের নবতর ব্যাখ্যা হাজির করতে খুব পারদর্শী। তাদের ব্যাখ্যা জনগণ কতটুকু গ্রহণ করে জানি না, তবে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা সেগুলোকেই ‘ইসলাম’ বলে অন্ধভাবে মেনে নেন।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক ইসলামকে এতদিন সহ্য করে এসেছে, সৌদি আরবের মতো ধর্মব্যবসায়ী রাষ্ট্র তাদের সালাফি/ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য আধ্যাত্মিকতাহীন কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চিন্তায় ব্যাপৃত একটি বিকৃত ইসলামকে মদদ দিয়ে এসেছে। অনেকে স্বপ্ন দেখেছে যে এই পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হতেও পারে। কিন্তু এক শতাব্দী হয়ে গেল প্রায়, কোথাও কোনো সফলতার দৃষ্টান্ত মিলল না, ফলে রাজনৈতিক ইসলাম তত্ত্ব বা থিয়োরি হিসাবে কেতাবের পাতায় রয়ে গেল। তাদের দরকার ফুরিয়েছে বলেই পশ্চিমারা নতুন করে জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে। ১৬০ কোটি মুসলমানকে কান ধরে উঠ বস করাতে এই জঙ্গিবাদ ইস্যুটিই যথেষ্ট। তাই সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহনকারী আরব দেশগুলো এখন জঙ্গিবাদ বিস্তারে অর্থ ঢালছে। ব্যর্থ হয়ে যাওয়া পলিটিক্যাল ইসলামের অনেক কর্মী সেইসব জঙ্গিদলগুলোয় যোগ দিচ্ছে। সরকারের দমনপীড়নে, মামলা- মোকাদ্দমার চাপে পড়ে অনেকে মরিয়া হয়ে জঙ্গিবাদী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা আরো বড় পথভ্রষ্টতা এবং ইসলামের জন্য আরো বড় ক্ষতিকর পন্থা। ইসলামের সামগ্রিক রূপ সম্পর্কে যাদের সঠিক ও সম্যক ধারণা (Comprehensive Concept) রয়েছে তারা সহজেই এই ভ্রান্তপথগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন।
এতক্ষণ যে আলোচনা করলাম, তার সারকথা হচ্ছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গিবাদও একটি পথভ্রষ্টতা, প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামও একটি পথভ্রষ্টতা। ইসলামের বিজয়প্রত্যাশীরা কেউ এই ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে, কেউ অন্য ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। তাদের সবার ধর্মবিশ্বাসই লুটপাট হচ্ছে, অপব্যবহৃত হচ্ছে। তারা না পচ্ছেন দুনিয়া, না পাচ্ছেন আখেরাত। তাদের ধর্মবিশ্বাস মানুষের অকল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার দরুন মানবতার কল্যাণার্থে আগত ইসলামের বদনাম হচ্ছে, আল্লাহ রসুলের বদনাম হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মানবজীবনে চলমান বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বাদ-মতবাদের ব্যর্থতার পর ইসলামকে বিকল্প জীবনব্যবস্থারূপে গ্রহণ করার যে সম্ভাবনা ছিল সেটাও সুদূরপরাহত হয়ে যাচ্ছে ধর্মের নামে এসকল অপকর্মের ফলে। পৃথিবীর সর্বত্র একপ্রকার ইসলামভীতি (Islamophobia) চালু করে দেওয়া হচ্ছে।
এখন আমাদের কথা হচ্ছে, যারা ইসলামকে বিজয়ীরূপে দেখতে চান এবং বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য ও সার্বজনীন আদর্শরূপে উপস্থাপন করতে চান তাদের একটাই করণীয়, তাদের সবাইকে এই সত্যটি স্বীকার করে নিতে হবে যে, আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম ১৩ শ’ বছরে বিকৃত হতে হতে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। পুরো জাতি আল্লাহর তওহীদ থেকে, আল্লাহর হুকুম থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার দাসে পরিণত হয়েছে। এখন এ অবস্থা থেকে ফেরার জন্য একেক দল একেকটি পথ নির্মাণ করে নিচ্ছে এবং সেই সব পথের দিকে অন্যদেরকেও আহ্বান করছে। কিন্তু যে মহাসড়ক, যে রাজপথটি রসুল নির্মাণ করে গেছেন সেই রাজপথটি ছিল তওহীদের উপর নির্মিত যার নাম সেরাতুল মোস্তাকীম- সহজ সরল পথ। আজ কেউই সেই পথে উঠছেন না। তারা একেক দল একেকটি রজ্জুকে ধারণ করেছেন কিন্তু ধারণ করতে হবে আল্লাহর রজ্জু, আর সেটা হচ্ছে তওহীদ। তাদের সবাইকে এখন আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেনতেন ঐক্য নয়, নির্বাচনকালীন জোট নয় — ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দল-মত-তরিকা-ফেরকা-মাজহাব নির্বিশেষে একটি মহাজাতি গড়ে তুলতে হবে। আর সাধারণ মানুষকেও সেই তওহীদের সঠিক অর্থ কী, দাবি কী, অঙ্গীকার কী সেটা তাদের মাতৃভাষায় বোধগম্য করে বোঝাতে হবে। পাশাপাশি রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া সেই পাঁচ দফা কর্মসূচিকে নিজেদের জীবনে ধারণ করে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করতে হবে। তাহলে তারা হবেন মো’মেন, আল্লাহর সাহায্যের অঙ্গীকার তখন তাদের জন্য সত্য হবে। আর যারা আল্লাহ সাহায্য প্রাপ্ত হয় তাদেরকে কেউ পরাভূত করতে পারে না। জনগণ যদি আল্লাহর হুকুমের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তাদের চাওয়ার প্রতিফলন হিসাবে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে তওহীদভিত্তিক একটি সভ্যতা। সেই সভ্যতার আলোয় মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন আলোকিত ও সুখী হবে। সেই অনাবিল সুখ ও শান্তির নামই ইসলাম- আক্ষরিক অর্থেই শান্তি।
জাতীয় জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামী দলগুলোর এমন অগণিত আন্তরিক কর্মী আছেন যাদের ত্যাগ সত্যিকার অর্থেই উদাহরণযোগ্য। ইসলামের জন্য তারা যে কোনো মুহূর্তে জীবন পর্যন্ত কোরবান করতে প্রস্তুত। তাদের উদ্দেশে আমরা সবিনয়ে দুটো কথা বলতে চাই।
প্রথম কথাটি হচ্ছে, ইসলাম হলো আল্লাহর দেওয়া দীন, এর নাম আল্লাহ দিয়েছেন সেরাতুল মোস্তাকীম বা সহজ-সরল পথ। সৃষ্টির সূচনালগ্নেই আল্লাহর সঙ্গে ইবলিসের যে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল সেখানে ইবলিস বলেছিল যে, সে এই সেরাতুল মোস্তাকীমে মানুষকে থাকতে দেবে না, সে এই জীবনপদ্ধতিটি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করতে দেবে না। সে এই পথের ডানে-বামে, উপরে-নিচে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে এবং মানুষকে আক্রমণ করে এই মহান পথ থেকে সরিয়ে দেবে। কাজেই সত্যদীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মানুষকে এমন এক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হবে যাকে সে দেখতেই পায় না, যে বিভিন্ন রূপে এসে মানুষকে প্রতারিত করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সুতরাং এই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হলে আল্লাহর সাহায্য তার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তি দিয়েই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহ কাকে সাহায্য করবেন?
আল্লাহ সাহায্য করবেন কেবল তাকেই যে মো’মেন। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ যত ওয়াদা করেছেন সব মো’মেনদের জন্য, তাঁর সকল সাহায্যও মো’মেনদের জন্যই। তিনি বলেছেন, তোমরা নিরাশ হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মো’মেন হও (কোর’আন: সুরা ইমরান ১৩৯)। মো’মেন কে সেটাও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, “মো’মেন শুধুমাত্র তারাই যারা আল্লাহ ও রসুলের প্রতি ঈমান আনে, অতঃপর কোনো সন্দেহ করে না এবং সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে। তারাই হচ্ছে সত্যনিষ্ঠ (কোর’আন: সুরা হুজরাত ১৫)। কাজেই যারা তওহীদের উপর অটল থেকে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন-সম্পদ সব উজাড় করে দিয়ে সংগ্রাম করবে তারাই হলো মো’মেন। আল্লাহর সাহায্য শুধু তাদের জন্যই।
ইসলাম আজকে হাজারো রূপ নিয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জাতি রসুলাল্লাহর ভাষায় তেহাত্তর ফেরকায় বিভক্ত হয়েছে। এর যে কোনো একটি ফেরকা বা রূপকে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করলেই কি মানুষ আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন হয়ে যাবে আর আল্লাহও সাহায্য করতে শুরু করে দিবেন? অবশ্যই না। কোন ফেরকাকে তিনি সাহায্য করবেন? যারা আল্লাহর নাজেল করা সেই প্রকৃত ইসলামের অনাবিল রূপটিকে বিশ্বময় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবে তারাই আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন বলে পরিগণিত হবেন। আর আল্লাহর নাজেল করা সেই সত্য ইসলামটিকে প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ সাহায্য করবেন। এটাই হলো জান্নাতি ফেরকা। ইবলিসের প্ররোচনায় পড়ে মুসলমান জাতি এখন হাজারো ফেরকা মাজহাবে তরিকায় বিভক্ত হয়ে যার যার ইচ্ছামত ইসলাম পালন করছে। সেই পথগুলো ইবলিসের পথ, সেগুলো সেরাতুল মোস্তাকীম নয়। সেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যতই সর্বস্ব কোরবান করি না কেন, যতই পাগলপারা হই না কেন সেখানে আল্লাহর কোনো সাহায্য আমরা পাবো না। কথা হলো, আজকে যারা ইসলামকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করছেন তারা যে ইসলামটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন সেটা আল্লাহ-রসুলের সেই প্রকৃত ইসলাম নয়, সেটা তেরশ বছরের বিকৃতির ফসল। সেই বিকৃত কী করে হলো সেটা পেছনে বারবার বলে এসেছি। যে ইসলামটি ১৪শ’ বছর আগে অর্ধেক দুনিয়ার মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল, যে ন্যায়বিচার ও সাম্যের পরিচয় পেয়ে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, অধিকারহারা, দলিত মানুষ দলে দলে বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে ইসলামকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল, আইয়্যামে জাহেলিয়াতের বর্বর মানুষগুলো যে পরশপাথরের ছোঁয়ায় রাতারাতি সোনার মানুষের পরিণত হয়েছিল সেই ইসলাম আজ এই সংগঠনগুলোর কাছে নেই। এগুলো হলো ফেকাহ-তাফসির নিয়ে কূটতর্কের ইসলাম, জটিল মাসলা-মাসায়েলের ইসলাম, ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা স্বার্থের প্রয়োজনে শতভাবে বিকৃত ইসলাম।
তৃতীয়ত, আল্লাহ তাঁর রসুলকে সমগ্র পৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে একটি নিখুঁত ও শ্বাশ্বত কর্মসূচি দান করেছেন। শাশ্বত বললাম এই জন্য যে, আল্লাহর রসুল এই কর্মসূচিটি বর্ণনা করার পূর্বেই বলে নিয়েছেন, “আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের আদেশ করেছেন। আমিও তোমাদেরকে সেই পাঁচটি কাজের জন্য আদেশ করছি।” তাহলে এই পাঁচটি কাজ কী? সেট হলো- আল্লাহর রসুল বললেন, “(১) তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকবে, (২) তোমরা সুশৃঙ্খল থাকবে, তোমাদের নেতার আদেশ শুনবে, (৩) তোমাদের নেতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, (৪) সকল শেরক-কুফরকে পরিত্যাগ করবে অর্থাৎ হেজরত করবে, (৫) আল্লাহর রাস্তায় জীবন ও সম্পদ দিয়ে জেহাদ (সংগ্রাম) করবে।
এই কর্মসূচিটির বাইরে ইসলাম নেই। যে যত বড় সংগঠনই করুক না কেন, সংগঠন যতই প্রাচীন হোক না কেন, তাদের জনসমর্থন যত বেশিই হোক না কেন, এই কর্মসূচি হচ্ছে রসুলের কর্মসূচি যা তিনি উম্মাহর উপর অর্পণ করে গেছেন, এই কর্মসূচিকে গ্রহণ না করে, নিজেদের মনগড়া কর্মসূচি বানিয়ে নিয়ে কোনোভাবেই আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন হওয়া সম্ভব নয়, সাহায্যের উপযুক্ত হওয়াও সম্ভব নয়। এটা আমাদের কথা নয়, স্বয়ং রসুল এই হাদিসটিতে পাঁচটি কাজের তালিকা বলার পর বলছেন, “যারা এই ঐক্যবন্ধনী থেকে আধহাত পরিমাণও বহির্গত হয়ে যাবে তাদের গলদেশ থেকে ইসলামের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। আর যারা জাহেলিয়াতের কোনো কিছুর দিকে আহ্বান করবে (অর্থাৎ ভিন্ন কর্মসূচির দিকে বা ভিন্ন মতবাদের দিকে) তারা জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে, যদিও তারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমন কি নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে (হাদিস- আল হারিস আল আশয়ারি (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিজি, বাব-উল-ইমারত, মেশকাত)।
যে কর্মসূচি আল্লাহ দেন নি সেই কর্মসূচির অনুসারীদের প্রতি আল্লাহ বিজয় প্রদান করতে, সাহায্য প্রদান করতে দায়বদ্ধ নন, তিনি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে দায়বদ্ধ তাঁর প্রদত্ত কর্মসূচির অনুসারীদের প্রতি। আমাদের ভুললে চলবে না, রসুলাল্লাহর জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যবাহী দিন হচ্ছে মক্কাবিজয়ের দিন। সেই মহাবিজয়ের দিনে তিনি তাঁর সাহাবিদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন সেখানে তিনি বলেছিলেন, “এই যে বিজয় তোমরা দেখছ, এটা আল্লাহ একা করেছেন। আল্লাহ একা করেছেন।” সেই বিজয়ের পেছনে রসুলাল্লাহর কত রক্ত গেছে, কত সাহাবীদের শহীদ হতে হয়েছে, কী পরিমাণ নির্যাতন নিপীড়ন তাঁরা সয়ে তিলে তিলে এই বিজয়ের দিনটি নির্মাণ করেছে সবই আমরা জানি। কিন্তু রসুলাল্লাহ তাঁর ও তাঁর সাহাবিদের কোনো ত্যাগের কথা, কোনো অবদানের কথাই স্বীকার করলেন না, বললেন “আল্লাহ একা করেছেন।” হ্যাঁ। এটাই সত্য। আল্লাহ যদি তাঁকে এই সংগ্রামে সাহায্য না করতেন, তাহলে উম্মাহর এই বিজয় স্বপ্নই থেকে যেত। কারণ নব্যুয়তের প্রথম দিন থেকে শুরু করে ঐ দিন পর্যন্ত এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যেখানে গোটা জাতিই ধ্বংসের উপক্রম হয়েছিল। হিজরতে আল্লাহর সাহায্য, বদরে আল্লাহর সাহায্য, আহযাবের দিন আল্লাহর সাহায্য, হোদায়বিয়ার সন্ধিতে আল্লাহর সাহায্য যদি না থাকতো তাহলে উম্মাহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। কাজেই আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো ইসলামি আন্দোলন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তাদের পাহাড়প্রমাণ ত্যাগ থাকলেও পারবে না।
তবে হ্যাঁ, কোনো কারণে কোনো ভূখণ্ডে যদি রাজনৈতিক, যুদ্ধাবস্থা বা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন পরিস্থিতি (Circumstence) হয় যে কোনো একটি ইসলামি দল বা জোট ক্ষমতায় যেতে পারল (They could to do it) যেমনটা আফগানে হয়েছিল, ইরাক সিরিয়ার কিছু অংশে হয়েছিল, তিউনেশিয়া, মিশরে হয়েছিল), কিন্তু সেই ক্ষমতায় তারা টিকতে পারবে না। কারণ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে এখন দাজ্জাল অর্থাৎ পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতা যার অন্যতম লক্ষ্যই হলো ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। তারা ইসলামি দল বা জোটকে ক্ষমতায় থাকতে দেবে না, নির্বাচনে জিতে আসলেও দেবে না, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলেও দেবে না। এই দলগুলো যে কয়দিন ক্ষমতার চর্চা করতে পেরেছে, তাদের হাতে থাকা শরিয়তের শাসন কায়েম করেছে ততদিন কি মানুষ ইসলামের শান্তি লাভ করেছে? ইসলামি দলগুলোয় যোগ দেওয়ার জন্য ঐ সব এলাকার নর-নারীদের মধ্যে বাঁধভাঙা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে? না। বরং উল্টো হয়েছে। মানুষ তাদের চাপিয়ে দেওয়া ‘ইসলাম’কে প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরাপত্তা ও শান্তির পরিবর্তে তারা ভীত ও আতঙ্কিত হয়েছে। এর কারণ কী এ প্রশ্ন করলে তার সোজা উত্তর হলো, ওটা আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। তাদের ঐ ‘ইসলাম’ দেখে ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিম তো বটেই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একটি বিরাট অংশ বিদ্বেষপ্রবণ হয়ে উঠেছে যার পেছনে কেবল পাশ্চাত্যের প্রোপাগান্ডাই একচেটিয়াভাবে দায়ী নয়, এর দায় ঐ ইসলামী দলগুলোর ধর্মান্ধতা, বিকৃত আকিদা, অপ্রয়োজনীয় বা ছোটখাটো বিষয়কে মহা গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা, পক্ষান্তরে মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে একেবারে গুরুত্বহীন করে ফেলা, শরিয়তের বাড়াবাড়ি, জবরদস্তি, ফতোয়াবাজি, শিল্প-সংস্কৃতির বিরুদ্ধবাদিতা, নারীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বিধর্মী ও ভিন্নমতের সঙ্গে বর্বর নৃশংসতার প্রদর্শনী ইত্যাদিও সমধিক দায়ী।
অথচ হওয়া উচিত ছিল সম্পূর্ণ উল্টোটা অর্থাৎ মানুষ দলে দলে সত্যকে আলিঙ্গন করে নেবে এবং তাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামের সৌন্দর্যকে পুষ্পিত করে তুলবে। সেটা হয় নি কারণ ১৪ শ’ বছর আগের সেই ইসলাম তাদের কাছে নেই। তাই তারা পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে হত্যা করেও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তাদের কোরবানি যতই বৃহৎ হোক, নিয়ত যতই সহীহ হোক, নিজেদেরকে তারা যতই শহীদ মনে করুক।
আমাদের এই কথা যদি তাদের বিশ্বাস না হয় তাহলে তারা কয়েক শত বছর ধরে যেমন চেষ্টা করে যাচ্ছেন তেমনিভাবে আরো হাজার বছর সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, কিন্তু কোনো লাভ হবে না। কারণ তারা যে ইসলামটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করছেন সেটাও আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়, এমন কি তাদের অনুসৃত কর্মসূচিও আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি নয়। এই কারণে আল্লাহর সাহায্য তাদের সঙ্গে নেই। এখন আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে হলে তাদেরকে মো’মেন হতে হবে, ইসলামের প্রকৃত আকিদাকে ধারণ করতে হবে, সমস্ত দুর্ভাগ্যজনক ফেরকা মাজহাব ভুলে তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তারপর বাকি মানবজাতিকে সেই তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। অতঃপর আল্লাহর দেওয়া যে কর্মসূচি রসুলাল্লাহ নিজে অনুসরণ করে গেছেন এবং তাঁর নিজ হাতে গড়া উম্মাহকে দান করে গেছেন সেই কর্মসূচির মাধ্যমে সংগ্রাম পরিচালিত করতে হবে, নিজেদের জীবন ও সম্পদ সেই সঠিক পথে ব্যয় করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।