মোহাম্মদ আসাদ আলী:
পশ্চিমাদের ন্যায় আমাদের সমাজেও ধর্মকে পরিকল্পিতভাবে উপাসনাকেন্দ্রিক করে ফেলার জোর চেষ্টা চালানো হয়েছে, ধর্মকে মসজিদ-মন্দিরের মধ্যে, ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে ধর্মের শিক্ষা দ্বারা সমাজ পরিচালিত হলেও বর্তমানে ধর্ম কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যে ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণে তা এখন কেবলই ধর্মব্যবসায়ীদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার আর পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষিত শ্রেণিটির কাছে কাল্পনিক জুজুর ভয়।
পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি আমাদের উজ্জ্বল আকর্ষণ নিয়ে হাতছানি দিচ্ছে, তার প্রভাবে ধর্ম ক্রমেই বিবর্ণ ও আকর্ষণহীন বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্তের কণিকায় মিশে আছে যা বাদ দেওয়া সহজ কাজ নয়। তবে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ধর্মের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা বিগত শতাব্দীগুলোতে চালানো হয়েছে তা খুবই সফল হয়েছে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝখানে আস্থাহীন ধর্মচর্চার রশিতে ঝুলে আছে সন্দেহবাদী শিক্ষিত সমাজ। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় এই দ্বিধা ও সন্দেহ সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
এ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে রাখা হয়েছে নামমাত্র। ধর্ম বইতে বলা হচ্ছে সমস্ত কিছুর মালিক স্রষ্টা, অথচ অন্য সকল বইয়ে ‘আল্লাহ’ শব্দটিও খুঁজে পাওয়া মুশকিল, পরোক্ষভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। কৌশল করে ধর্মকে সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। ধর্মশিক্ষা বইতে যতটুকু ধর্ম শেখানো হয়েছে তার পুরোটাই ব্যক্তিগত জীবনের বিষয়, সামষ্টিক জীবন কীভাবে চলবে তা শেখানোর জন্য আছে অন্যান্য বিষয়সমূহ। বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আদিকালের পুরাতন স্রষ্টার আধুনিক জীবনের জটিলতার সমাধান করার মতো জ্ঞান নেই (নাউজুবিল্লাহ), তাই এ বিষয়ে তিনি নীরব। মানুষের মনকে ধর্মবিমুখ ও অবজ্ঞাপ্রবণ করে তোলার এটি হচ্ছে একটি সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়া। ধর্ম বলছে- সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়াকে পৃথিবীতে প্রেরণের মাধ্যমে এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাস শুরু। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদেরকে মহান আল্লাহ পৃথিবীতে বসবাসের সমস্ত জ্ঞান দান করেন, ভাষা শিক্ষা দেন এবং তাঁরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করেন ও সন্তানের জন্ম দেন। অর্থাৎ মানবসৃষ্টির শুরুতেই মানুষ পরিবার গঠন করলো, আস্তে আস্তে সমাজ হলো।
কিন্তু সমাজবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষাসহ অন্যান্য বইগুলোতে বলা হচ্ছে- বানর জাতীয় প্রাণীর বিবর্তনের ফলে মানুষের সৃষ্টি (এখানে সৃষ্টিকর্তার প্রসঙ্গ স¤পূর্ণ অনুপস্থিত)। মানুষ প্রথমে কথা বলতে জানতো না (যেহেতু স্রষ্টাই নেই, বানর থেকে তার সৃষ্টি কাজেই ভাষা জানবে না এটাই স্বাভাবিক, শেখানোর তো কেউ নেই) ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে, চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে, নৃত্যের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। আস্তে আস্তে সে ভাষা আবিষ্কার করল। তারা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করত, একসময় তারা একসাথে বসবাস শুরু করল। তারা পোশাক পরতে জানত না, পোশাক পরা শিখল। পশু শিকার করে খেত, একসময় কোনো বুদ্ধিমতী নারী সুস্বাদু ফল খেয়ে বীজ মাটিতে বপন করল, সেখান থেকে গাছ হলো, ফল ধরল, এখান থেকে মানুষ কৃষিকাজ শুরু করল। এভাবে নারীদের মাধ্যমে কৃষিকাজের সূচনা হলো। এরপর নারীরা তার পছন্দমতো পুরুষ সঙ্গী বেছে নিয়ে একসাথে বসবাস শুরু করল- এভাবে শুরু হলো পারিবারিক জীবন (অতি সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করেছি)।
এই জ্ঞানগুলো সমাজবিজ্ঞানীরা কোথায় পেল আমার জানা নেই। আসলে তাদের এই মস্তিষ্কপ্রসূত বানোয়াট কথাগুলো জ্ঞান হিসাবে পাঠ্য বইয়ে দেবার একটাই উদ্দেশ্য- শিক্ষিত সমাজকে ধর্মের ব্যাপারে সন্দেহবাদী করে তোলা। যখন ইউরোপীয় সেক্যুলারিজমের জন্ম হয়েছে তখন থেকেই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে এবং অনেকাংশেই তারা সফলও হয়েছে। যারা শিক্ষিত হচ্ছে তারা এই জ্ঞানগুলোই সত্য বলে মেনে নিচ্ছে, এ বিষয়গুলোতে কারও দ্বিমত করতেও দেখি না।
এখন মানুষ যদি ধর্মকে সত্য বলে জানে তবে তার অন্যান্য বইয়ে পড়া সব জ্ঞানকে মিথ্যা বলে জানতে হচ্ছে আর যদি অন্য সব জ্ঞানকে সত্য বলে জানে তবে ধর্মকে মিথ্যা বলে জানতে হচ্ছে। এ কারণে মানুষ বিশ্বাসগতভাবে দুইটা মেরুতে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিচ্ছে, উভয়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে, সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে।
এখন প্রয়োজন- সকল বইয়ের মধ্যে সত্য বিষয়টা তুলে ধরা, মিথ্যা, বানোয়াট বিষয়গুলো বাদ দেওয়া, অপরপক্ষে ধর্মকে শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে বন্দী না রেখে সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মের বক্তব্যগুলো যৌক্তিকভাবে (যুক্তিগুলো আমাদের কাছে আছে), বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করতে হবে, ধর্মকে ব্যবসায়িক হাতিয়ারে পরিণত হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র ও ধর্মকে একমুখী করতে হবে। না হলে দ্বিধাগ্রস্ত ও দ্বিধাবিভক্ত সমাজ নিয়ে খুব বেশিদূর এগোনো সম্ভব হবে না।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।