হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দোয়ার বন্যা ফিলিস্তিনে কান্না ( বদরে আল্লাহর সাহায্য ছিল এখন নেই কেন? )

মুখলেছুর রহমান সুমন

দোয়ার বন্যা ফিলিস্তিনে কান্না বদরে আল্লাহর সাহায্য ছিল এখন নেই কেন?
দোয়ার বন্যা ফিলিস্তিনে কান্না বদরে আল্লাহর সাহায্য ছিল এখন নেই কেন?

হিজরি দ্বিতীয় সনে সংঘটিত বদরের যুদ্ধে মহানবী (স.) আল্লাহ পাকের দরবারে সাহায্য চেয়ে ফরিয়াদ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীবের সেই ফরিয়াদ কবুল করে নেন এবং অগণিত মালায়েক পাঠিয়ে দেন মুসলিম বাহিনীর সাহায্যার্থে। আল্লাহর এই প্রত্যক্ষ সাহায্যের বদৌলতে মুসলিম বাহিনী ওই যুদ্ধে বিজয়ী হয়, যদিও তাদের তুলনায় কাফের বাহিনী ছিল বহুগুণ শক্তিশালী ও সুসজ্জিত। এই সাহায্য যদি না আসতো তাহলে যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু আল্লাহ এমনটা ঘটতে দেন নি। তিনি প্রিয় হাবীব ও তাঁর সাথীদেরকে সে দিন রক্ষা করেছিলেন এবং তাঁদেরকে বিজয়ী করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের দরবারে এই দোয়া কবুল হওয়ার পেছনে রসুল (স.) ও তাঁর সাহাবীদের কী পরিমাণ আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও কোরবানি ছিল, তা উপলব্ধি করা জরুরি। অন্যথায় বদরের বিজয়কে আমরা মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হবো।
বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। অন্যদিকে কোরায়েশ মুশরিক বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ১ হাজার, অর্থাৎ তিন গুণের বেশি। মুশরিকরা শুধু সৈন্য সংখ্যাতেই বেশি ছিল তা নয়, বরং অস্ত্রশস্ত্র, উট, ঘোড়াসহ প্রতিটি বিষয়েই তারা বহুগুণ এগিয়ে ছিল। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ২টি ঘোড়া আর ৭০ টি উটের বিপরীতে তাদের কাছে ছিল ১০০ টি ঘোড়া ও ৭০০ টি উট। তারচেয়েও বড় কথা, মুসলিম বাহিনী সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে মদিনা থেকে বের হয় নি, তারা রওনা হয়েছিলেন মূলত আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বাধীন কোরায়েশদের একটি বাণিজ্য কাফেলাকে পাকড়াও করার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে তারা অপর কোরায়েশ নেতা আবু জাহেলের নেতৃত্বাধীন একটি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি বাণিজ্য কাফেলার মুখোমুখি হওয়া আর রণসাজে সজ্জিত এটি সশস্ত্র বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া এক কথা নয়।
আবু জাহেলের নেতৃত্বে কোরায়েশদের এই সশস্ত্র দলটির অগ্রযাত্রার খবর রসুল (স.) এর কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। এই অবস্থায় রসুল (স.) কৌশলগত কারণে যুদ্ধ এড়িয়ে মদিনায় ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু তা সারা আরবে রসুল (স.) এর নেতৃত্ব ও মদিনার মান-মর্যাদা নষ্ট করে দিত। তাই এ ব্যাপারে সাহাবিদের কাছে পরামর্শ চান। সাহাবীরাও তাঁকে একই পরামর্শ দেন এবং জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। মিক্বদাদ (রা.) দাঁড়িয়ে ওজস্বিনী ভাষায় বলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহর দেখানো পথে আপনি এগিয়ে চলুন। আমরা আপনার সাথে আছি। আল্লাহর কসম! আমরা আপনাকে ঐরূপ বলব না, যেরূপ বনু ইসরাঈল জাতি তাদের নবী মুসাকে বলেছিল যে, ‘তুমি ও তোমার রব যাও, গিয়ে যুদ্ধ কর! আমরা এখানে বসে রইলাম’। বরং আমরা বলব, ‘আপনি ও আপনার রব যান ও যুদ্ধ করুন, আমরা আপনাদের পাশে যুদ্ধরত থাকব। সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, যদি আপনি আমাদেরকে নিয়ে ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত চলে যান, তবে আমরা অবশ্যই আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সেই পর্যন্ত পৌঁছে যাব’। (আহমাদ শরীফ: হা/১৮৮৪৭) আরেকজন বিশিষ্ট আনসার সাহাবী সা’দ ইবনে মুয়াজ (রা.), তিনি আরো কিছু কথা যুক্ত করে শেষে বললেন, ‘আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাহলে আমরাও সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়বো।’
রসুল (স.) ও তাঁর সাহাবীদের সে দিনের ওই সিদ্ধান্ত কতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায় একটি ঘটনা থেকে। যুদ্ধকালে রসুল (স.) এর তাবুর নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয় সা’দ বিন মু’আয (রা.) এর নেতৃত্বাধীন কয়েকজন আনসার সাহাবীকে। এসময় সা’দ (রা.) একটি ঘোড়া প্রস্তুত করে মহানবীকে বললেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহলে আপনি এই সওয়ারীতে চড়ে দ্রুত মদিনায় চলে যাবেন। কেননা সেখানে রয়েছে আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই।” (সিরাত ইবনে হিশাম)। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, সুসজ্জিত ১ হাজার শত্রুসেনার সামনে মাত্র ৩১৩ জন অপ্রস্তুত মানুষের যুদ্ধ ঘোষণা ছিল নিজেদেরকে মৃত্যুর মুখে সঁপে দেয়ার নামান্তর।
অতঃপর ১৭ রমজান সকালে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। উভয় বাহিনীর সৈন্যরা হতাহত থাকে। রসুল (স.) এর সামনে উমাইর বিন হোমাম (রা.) নামে একজন সাহাবী শহিদ হয়ে গেলেন। আল্লাহর নবী চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছ তা স্মরণ কর। হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পুরনের প্রার্থনা জানাচ্ছি। … হে আল্লাহ! আজকে যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আজকের দিনের পর তোমার ইবাদত করার মত কেউ জমিনে অবশিষ্ট থাকবে না’। এ প্রার্থনার সময় এমন ব্যাকুল ও কাতর হয়ে পড়লেন যে, তার কাঁধ থেকে চাদর পড়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আবু বকর (রা.) ছুটে এসে চাদর উঠিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! যথেষ্ট হয়েছে! আপনার পালনকর্তার নিকটে আপনি চূড়ান্ত প্রার্থনা করেছেন।’ (বুখারী হা/৪৮৭৫, মিশকাত হা/৫৮৭২।)
এ সময় আয়াত নাজিল হলো, ‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন এই মর্মে যে, আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার মালায়েক দিয়ে, যারা ধারাবাহিকভাবে অবতরণ করবে’ (সুরা আনফাল ৯)।
রসুল (স.) আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করার সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এ আয়াত নাজিল হলে তিনি জেগে ওঠেন এবং আনন্দের সাথে ঘোষণা দেন, সুসংবাদ গ্রহণ করো আবু বকর! তোমার কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে গেছে। এই যে জিব্রাইল, তার ঘোড়ার লাগাম ধরে ধূলি উড়িয়ে এগিয়ে আসছেন’ (সিরাত ইবনে হিশাম)।
বাকি ইতিহাস আমাদের মোটামুটি সবারই জানা। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের ব্যবধানে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। আবু জাহেল ও বাঘা বাঘা সব কোরায়েশ নেতাসহ কাফেরদের ৭০ জন নিহত হলো। আরো ৭০ জন বন্দি হলো। বিপরীতে মুসলিমদের মধ্যে শহিদ হলেন মাত্র ১৪ জন। বদরের এই পরাজয় কাফেরদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, এই যুদ্ধের পর মক্কায় কোরায়েশদের নেতৃত্ব গ্রহণ করার মতো একজন প্রবীণ নেতাকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বহুগুণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও কোরায়েশ বাহিনীর এই পরাজয়ের পেছনে আল্লাহর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল। যেমন কাফেররা রসুলাল্লাহর বাহিনীকে বহুগুণ বড় দেখতে পাচ্ছিল যা তাদের মনোবল ধ্বংস করে দিয়েছিল। মালায়েকরা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যার ফলে আঘাতের আগেই কোনো কোনো কাফেরের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার রসুলাল্লাহর ছুঁড়ে দেওয়া এক মুষ্টি ধুলো কাফেরদের চোখে গিয়ে প্রবেশ করেছিল যা তাদেরকে যুদ্ধের সময় অসুবিধায় ফেলে দেয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রসুল (স.) কখন আল্লাহ পাকের দরবারে সাহায্য চাইলেন? মানুষ হিসেবে তাঁর পক্ষে ও তাঁর সাহাবীদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তার সবটুকু করার পরেই তিনি সাহায্য চেয়েছেন। তাঁর সাথীরা পৃথিবীর সমস্ত মায়া ও বন্ধন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে শুধু আল্লাহর জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ করলেন। নিজেরা শহিদ হয়ে গেলে দূরে মদিনা শহরে নিজেদের পুত্র-পরিবার-পরিজনের ভাগ্যে কী ঘটবে তা ভুলে গেলেন। অতঃপর যুদ্ধের ময়দানে নিজেদেরকে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিলেন, নিজেদেরকে মৃত্যুর মুখে সপে দিলেন। মানুষ হিসেবে এরচেয়ে বেশি কিছু করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই ‘সবটুকু’ করার পর আল্লাহর নবী দুই হাত তুললেন, আল্লাহ পাকের কাছে বিগলিত হৃদয়ে সাহায্য প্রার্থনা করলেন, তাঁর আগে নয়। নবী হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে, নিজেকে উৎসর্গ করতে হয়েছে, যুদ্ধের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে দাঁড় করাতে হয়েছে। দোয়ার বরকতে, মুখের ফুৎকারে কিংবা চোখের পানিতে কোনো কিছু ঘটে যায় নি। এই হলো ইতিহাস।
এখন মুসলিম বিশ্বের আজকের পরিস্থিতি নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই। সারা বিশ্বে আমরা সংখ্যায় ১৮০ কোটি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সিংহভাগই মনে প্রাণে আল্লাহকে বিশ্বাস করে, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, দেশের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহ পাকের কাছে ফরিয়াদ করে। আমরা প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্ত নামাজ শেষে দোয়া করি। শুক্রবার জুমার নামাজের শেষে মুসলিম বিশ্বের শতকোটি মুসলমান লক্ষ লক্ষ আলেম মওলানাদের সঙ্গে দোয়ায় শরিক হই। হজ্বের মৌসুমে আরাফাতের ময়দানে আর টঙ্গির ইজতেমায় জড়ো হই লাখে লাখে। অতঃপর দুই হাত তুলে সম্মিলিতভাবে আল্লাহর দরবারে আহাজারি করি। মুসলিম উম্মাহর শক্তি, শান্তি, সমৃদ্ধি কামনা করে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলি। আমাদের এই আহাজারিতে, আমাদের এই আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। প্রতিটি সংবাদপত্রে আমাদের সেই আহাজারির ছবি ছাপা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই আর্তনাদ, এই প্রার্থনা আল্লাহ পাকের দরবারে পৌঁছায় কি? নাকি তা আকাশে-বাতাসেই মিলিয়ে যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা নিজেদের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে তাকালেই পেয়ে যাব। বদরের ৩১৩ জনের জায়গায় আজ আমরা সংখ্যায় ১৮০ কোটি। অথচ সারা দুনিয়ায় আমরা মার খাচ্ছি। আমাদের মাটির নিরাপত্তা নেই, আমাদের সীমানার নিরাপত্তা নেই। আমাদের নারীদের ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। আমাদের সন্তানেরা শত্রুর বুটের তলায় পিষ্ট, গুলিতে বিদ্ধ। ঠিক এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। তাদেরকে নিজেদের ঘর-বাড়ি, ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়া হচ্ছে।
গত কয়েক দশকে এই একই তাণ্ডব চালানো হয়েছে ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়ায়। নানা ইস্যু সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে থাবা বসিয়েছে এবং একেকটি দেশকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়ে ফিরে গিয়েছে। গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই উপমহাদেশ সহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ড শাসন করেছে ছোট ছোট কয়েকটি ইউরোপীয় জাতি। এই শাসনকালে তারা মুসলিমদের রক্ত চুষে নিজেদের দেশে নিয়ে গেছে এবং সেখানে ধন-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
সেই ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত মুসলিমরা সারা বিশ্বে নির্যাতিত, নিপীড়িত। এই দাসত্বের কয়েক শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহর ঘরে ঘরে কোর’আন পাঠ হয়েছে, মসজিদে মসজিদে নামাজ পড়া হয়েছে, সুর করে মিলাদ পড়া হয়েছে, ওয়াজ মাহফিল করা হয়েছে, রমজান মাসে খতমে তারাবি শেষে দীর্ঘ মোনাজাত হয়েছে। প্রতিবছর হজ্ব হয়েছে, ইজতেমা হয়েছে। মোনাজাত, প্রার্থনা, দোয়ার বন্যা বয়েছে, সেখানে কান্নার রোল ওঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এত কিছু হয়েছে, কিন্তু রসুল (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা যেভাবে শাহাদাতের তামান্না নিয়ে, আল্লাহকে বিজয়ী করার বাসনা নিয়ে নিজেদের সবটুকু উজাড় করে বদরের মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হয়েছে কি? আজকের মুসলিম জাতি সেই চূড়ান্ত কোরবানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি? আল্লাহর জন্য, আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য আজকের ‘তওহীদী জনতা’ কি সাহাবীদের ন্যায় নেতার আদেশে সাগরে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত? তাদের আত্মা বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করার হিম্মত রাখে কি? তারা কি আল্লাহর সত্যদীনকে বিজয়ী করে পৃথিবীতে ন্যায়, শান্তি আর সুবিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত?
প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হবে, না। তারা আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দীনের জন্য মোনাজাতের বাইরে কিছুই করতে প্রস্তুত না। সত্যের জন্য জীবন দিতে, রক্ত দিতে, শ্রম দিতে, ঘাম দিতে তারা রাজি না। তারা বরং নিজেরাই ঐক্যহীন, বিভক্ত, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়িতে লিপ্ত। তাদের একক কোনো নেতৃত্ব নেই, আল্লাহর বিধি-বিধানের প্রতি আনুগত্য নেই। তারা আল্লাহর দেয়া বিধানের পরিবর্তে ইহুদী-খ্রিস্টানদের প্রবর্তিত আইন দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এমন নাফরমানির পরেও তারা আশা করে তারা কখন দুই হাত তুলে প্রার্থনা করবে, সেই অপেক্ষায় আল্লাহ বসে আছেন। তারা তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবে না, আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবে না, শুধু দুই হাত তুলে সম্মিলিত কণ্ঠে প্রার্থনা করবে। এতেই আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠবে। মালায়েকরা মাটিতে নেমে আসবে। ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখি ছুটে আসবে। অমুসলিমদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে সারা দুনিয়ার কর্তৃত্ব মুসলিমদের হাতে তুলে দেবে। এ যেন ‘মামার বাড়ির আবদার’।
আজকে আমরা যারা কোনোরূপ চেষ্টা ছাড়া, সংগ্রাম ছাড়া, ত্যাগ ও কোরবানি ছাড়া আল্লাহর সাহায্য আশা করি, আমাদের মনে রাখা উচিত, শুধুমাত্র দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে যদি সাহায্য পাওয়া যেত, তবে সবার আগে সেই সাহায্যের দাবিদার ছিলেন স্বয়ং রসুলাল্লাহ (স.)। তাঁর পবিত্র দুই হাতের মূল্য, এক ফোঁটা চোখের পানির মূল্য আল্লাহ পাকের দরবারে ১৮০ কোটি মুসলিমের হাতের চেয়ে, চোখের পানির চেয়েও বেশি। সুতরাং প্রচেষ্টাহীন দোয়ায় যদি আল্লাহর সাহায্য মিলত তাহলে তিনি এত কষ্ট না করে শুধু দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করলেই পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি জানতেন, প্রচেষ্টাহীন দোয়া, সংগ্রামহীন ফরিয়াদ আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। বরং এরূপ দোয়া আল্লাহর ক্রোধকে উদ্দীপ্ত করে। তার প্রমাণ ফিলিস্তিন। যত বেশি ফিলিস্তিনের জন্য দোয়া করা হচ্ছে, তত বেশি তার জমি দখল করে নিচ্ছে ইহুদিরা, তত বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হচ্ছে, বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে।
আমাদেরকে বদর থেকে শিক্ষা নিতে হবে। গত কয়েকশ’ বছর ধরে দোয়ার নামে যে প্রহসন আমরা করে এসেছি, তা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দুনিয়াব্যাপী আমাদের উপর যে নির্যাতন, লাঞ্ছনা, অপমান চলছে, তা আরো বাড়তে পারে। প্রচেষ্টাহীন দোয়ার বদৌলতে আমরা সাহায্য আশা করতে পারি না, বরং আমাদের উপর আল্লাহর গজব আরো বাড়তে পারে।

 

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...