হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দাজ্জালকে চিনতে হবে

মোহাম্মদ আসাদ আলী

পবিত্র রমজান মাসের মাঝামাঝি থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মূলধারার কিছু গণমাধ্যম দাজ্জাল প্রসঙ্গে ফিচার, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করতে আরম্ভ করেছে। ইসরায়েল হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ইহুদিদের ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদের ব্যাখ্যানুযায়ী, ইহুদিদের মুক্তি দিতে এবং সারা বিশ্বে ইহুদিদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করতে তাদের মধ্যে একজন মসিহ বা ত্রাতা আসবেন। কিন্তু যতক্ষণ না কয়েক হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিং সলোমনের মন্দির পুনরায় তৈরি করা হচ্ছে, ততক্ষণ সেই ত্রাতা আবির্ভূত হবেন না। ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী, ইহুদিদের এই মসিহই দাজ্জাল, যে কিনা গোটা বিশ্ব শাসনব্যবস্থার একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে। ইসরায়েলের কট্টর ইহুদিদের একাধিক গোষ্ঠী মসিহের আগমনের শর্ত পূরণ করতে বহু বছর ধরে আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেই জায়গায় ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, এমনকি ইসরায়েল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা মনে করছেন, আল-আকসা মসজিদ ভেঙে সেখানে ‘থার্ড টেম্পল’ নির্মাণের জন্য ইহুদিদের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। এ আলোচনাই দাজ্জালের আলোচনাকে নতুন করে সামনে এনেছে।
ফলে বিবিসি, আরটিভি, কালবেলাসহ প্রথমসারির বিভিন্ন গণমাধ্যম এখন দাজ্জাল নিয়ে কথা বলছে। এ বিষয়ে বিবিসির শিরোনাম ছিল, ‘দাজ্জাল সম্পর্কে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্ম থেকে কী জানা যায়’? আরটিভির শিরোনাম ছিল, ‘নিজেকে খোদা দাবি করবেন যে ব্যাক্তি’! কালবেলার শিরোনাম ছিল, ‘ভয়ংকর দাজ্জালের আবির্ভাব কখন, বাঁচার উপায় কী’? প্রতিবেদনগুলোতে বিভিন্ন ইসলামিক পণ্ডিত, গবেষক দাজ্জালের আগমন সম্পর্কিত তাদের ধারণা, অতীতের ধর্মগ্রন্থগুলি বাইবেল, তওরাত, ওল্ড টেস্টামেন্টের বিভিন্ন রেফারেন্স, হাদিসের বিভিন্ন এবারত তুলে ধরে দাজ্জাল সম্পর্কে মন্তব্য করছেন। তবে সেসব মন্তব্যে দাজ্জালের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত আসে নি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলারের ভাষ্য তুলে ধরে ‘দাজ্জাল’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “তার কপাল চওড়া হবে, চুল কোঁকড়ানো এবং চোখ থাকবে একটি। অন্য চোখটি ফোলা আঙুরের মতো বেরিয়ে থাকবে। প্রশস্ত বক্ষের অধিকারী হবেন দাজ্জাল।” এভাবে একটি দানবীয় মানবসদৃশ প্রাণী হিসেবে দাজ্জালকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইমরান নযর হোসাইন, হারুণ ইয়াহিয়া, আসেম ওমর, নাসিরুদ্দিন আলবানীসহ আরো অনেক বিখ্যাত স্কলার দাজ্জাল সম্পর্কে এমনই বিভিন্ন কাল্পনিক মতামত দিয়েছেন। কিন্তু কারো মতামত থেকেই দাজ্জাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় নি। প্রকৃতপক্ষে ‘দাজ্জাল’ বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ, আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক যে এটাকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। আখেরী যামানায় দাজ্জালের আগমন সম্পর্কে রসুলাল্লাহর করা ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে অনেকগুলো হাদিস ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। একটি হাদিস আছে, যেখানে আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন ইসলাম শুধু নাম থাকবে, কোর’আন শুধু অক্ষর থাকবে, মসজিদগুলো হবে জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য কিন্তু সেখানে হেদায়াত থাকবে না, আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হবে এই উম্মাহর আলেমরা, তারা ফেতনা সৃষ্টি করবে, তাদের ফেতনা তাদের দিকেই ধাবিত হবে (আলী রা. থেকে বায়হাকি, মেশকাত)। এই হাদিসটি বর্তমানে প্রায় পুরোপুরি বাস্তবায়িত। কিভাবে বাস্তবায়িত সেই প্রসঙ্গে এখন যাচ্ছি না, চিন্তাশীল মানুষমাত্রই এ হাদিসের সত্যতা খুঁজে পাবেন। কাজেই দাজ্জাল সম্পর্কে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করেছেন সেগুলোও বাস্তবায়ন হবে, কারণ তিনি যা বলেছেন তা ছিল ওহির জ্ঞান।
এখন কথা হচ্ছে, দাজ্জাল সম্পর্কে এত বিতর্কের ভিড়ে ‘আখেরী যামানার এই ভয়ংকর ফেতনা দাজ্জাল’- সম্পর্কে কীভাবে সঠিক সিদ্বান্তে পৌঁছাতে পারবো? দাজ্জালকে দাজ্জাল বলে আমরা যদি চিনতেই না পারি তবে আমাদের বিপদের সম্ভাবনা বহু বেশি হয়ে যায়। দাজ্জাল সম্পর্কে মোহাম্মদ আসাদ তার বিখ্যাত বহুল পঠিত ‘রোড টু মক্কা’ বইতে ইহুদি-খ্রিস্টান সভ্যতাকেই দাজ্জাল হিসেবে ইঙ্গিত করেন। তবে তিনি বিস্তারিত আলোচনায় বা ব্যাখ্যায় যাননি। বিভিন্ন ইসলামিক পণ্ডিত, ধর্মগুরু, স্কলারদের দাজ্জাল সম্পর্কে গবেষণার ভিড়ে সবচেয়ে যুগোপযুগী, বাস্তবসম্মত, যুক্তিসঙ্গত মতামত দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত পন্নী পরিবারের উত্তরসূরী এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী, যা ইতোমধ্যেই সত্যপিপাসু মানুষদের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তিনি এমন এক ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান যাদের এ উপমহাদেশে শিক্ষা, ধর্মবিস্তার, সংস্কৃতি, শাসন, সমাজসেবায় বিপুল অবদান রয়েছে, যাদের দ্বারা উপকৃত হয়েছে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষ। সুলতানী যুগে তাঁরা ছিলেন গৌড়ের স্বাধীন সুলতান। সুলতান দাউদ খান কররানি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় মুঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ একদিকে যেমন শাসক ছিলেন, তেমনি অনেকেই ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। তাঁর পিতামহ মাহবুবে খোদা মোহাম্মদ হায়দার আলী খান পন্নীর নানা কেরামতের কথা এখনও টাঙ্গাইলের মানুষের মুখে কিংবদন্তীর মত ফেরে। এমামুয্যামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীও ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। তাঁর ঘটনাবহুল ৮৬ বছরের জীবনে একবারের জন্যও আইনভঙ্গের কোন রেকর্ড নেই, নৈতিক স্খলনের নজির নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর মায়ের নানা ধনবাড়ির জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর বিশেষ অবদান রয়েছে।
কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষালাভের সময় তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে সম্পৃক্ত হন। সেই সুবাদে তিনি এই সংগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য নেতৃবৃন্দের সাহচর্য লাভ করেন যাঁদের মধ্যে মহাত্মা গান্ধী, কায়েদে আযম মোহম্মদ আলী জিন্নাহ্, অরবিন্দু ঘোস, শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দি অন্যতম। শিকারের নেশা তাঁর রক্তে মিশে ছিল। দেশের বিভিন্ন এলাকার বনে-জঙ্গলে হিংস্র পশু শিকারের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৬৩ সনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক আইন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগের প্রার্থীগণসহ বিপ¶ীয় মোট ছয়জন প্রার্থীকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে এম.পি. নির্বাচিত হন।
একই সাথে বিপ্লবী চেতনা এবং আধ্যাত্মিকতা তাঁর রক্তে মিশে আছে। অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করা এবং ন্যায়ের উপর বলিষ্ঠ থাকা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ। ছোটবেলা থেকেই তিনি ইসলামের উপর পড়াশুনা ও গবেষণা আরম্ভ করেন। দাজ্জাল সম্পর্কে তাঁর গবেষণা তিনি প্রকাশ করেছেন ‘দাজ্জাল? ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা!’ নামক বইটিতে। ২০০৮-২০০৯ সালে তাঁর এ বইটির প্রায় এক লক্ষ বিক্রি হয়ে বেস্টসেলার হয় যা বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে একটি বড় ঘটনা। কারণ এটি কোনো উপন্যাস নয়, বরং একটি গবেষণা গ্রন্থ। একুশে বইমেলায় বইটির জনপ্রিয়তা নিয়ে দুইবাংলার লেখক-সাংবাদিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। আর সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে অনলাইনে। বহু আলেম ওলামা এ বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে ওয়াজে, খোতবায়, অনলাইনে আলোচনা করেছেন। কথা হচ্ছে, দাজ্জাল নিয়ে তিনি কী কথা বলেছেন? কেন এত এত গবেষণার ভিড়ে তাঁর গবেষণাকে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বলছি?
জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর মতে, ‘বর্তমানে ইহুদি-খ্রিষ্টান জড়বাদী পাশ্চাত্য সভ্যতাই হচ্ছে রসুলাল্লাহর (সা.) বর্ণিত আখেরী যামানার সবচেয়ে ভয়াবহ ফেতনা দাজ্জাল। তিনি বলেন, বর্তমানে পৃথিবীতে ইহুদি-খ্রিষ্টান জড়বাদী সভ্যতার চেয়ে বড়, এর চেয়ে শক্তিধর কিছুই নেই। এই শক্তির কাছে সমস্ত পৃথিবী আজকে নতজানু হয়ে আছে, এর পায়ে সেজদায় পড়ে আছে। কারো সাধ্য নেই এই সভ্যতার প্রযুক্তিগত, সামরিক বা অর্থনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার বা একে প্রতিরোধ করার। রসুলাল্লাহর (সা.) হাদিসের রূপক বর্ণনা মোতাবেক, আরোহী দাজ্জাল হচ্ছে ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা আর তার ঘোড়া বা বাহন হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্র (Scientific Technology)। এই বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত যন্ত্রই হচ্ছে এর মহাশক্তি। এই সভ্যতার যন্ত্র আজ পৃথিবীর সর্বত্র। এ এত শক্তিশালী যে এর পারমাণবিক অস্ত্র (Nuclear weapons)) আজ এই পৃথিবীকেও ভেঙ্গে ফেলতে পারে। তিনি দাজ্জাল সম্পর্কিত রসুলাল্লাহর হাদিস, বাইবেল ও বিজ্ঞানের আলোকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, বর্তমানের এই আত্মাহীন জড়বাদী এই পাশ্চাত্য সভ্যতাই হচ্ছে সেই ভয়াবহ ফেতনা দাজ্জাল। যেমন- আল্লাহর রসুল (সা.) বলছেন,
১. দাজ্জালের গতি হবে অতি দ্রুত। সে বায়ুতাড়িত মেঘের মতো আকাশ দিয়ে উড়ে চলবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে মুসলিম, তিরমিযি]। এই হাদিসের বেশি ব্যাখ্যার প্রয়োজন করে না। দাজ্জাল অর্থাৎ পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার তৈরি এরোপ্লেন যখন আকাশ দিয়ে উড়ে যায় তখন যে সেটাকে বায়ুতাড়িত অর্থাৎ জোর বাতাসে চালিত মেঘের টুকরোর মতো দেখায় তা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি?
২. দাজ্জালের আদেশে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ হবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি] বর্তমান ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি (Scientific Technology) আকাশে হালকা মেঘের ওপর এ্যারোপ্লেন দিয়ে রাসায়নিক পদার্থ (Chemicals) ছিটিয়ে বৃষ্টি নামাতে পারে এ কথা তথ্যাভিজ্ঞ প্রত্যেক লোকই জানেন। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঐ প্রক্রিয়ায় কৃষি কাজের জন্য বৃষ্টি নামানো হচ্ছে। সন্দেহ হলে যে কোনো আবহাওয়া বিজ্ঞানীর (Meteorologist) বা কৃষিবিদের (Agriculturist) কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন। কাজেই দাজ্জালের এই শক্তিকেই যে ১৪০০ বছরের আগের আরব মানুষদের বোঝাতে আল্লাহর রসুল (সা.) রূপকভাবে বর্ণনা করে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
৩. দাজ্জালের গরু-গাভী, মহিষ, বকরি, ভেড়া, মেষ, ইত্যাদি বড় বড় আকারের হবে এবং সেগুলোর স্তনের বোটা বড় বড় হবে (যা থেকে প্রচুর পরিমাণে দুধ হবে)। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি]। তথ্যাভিজ্ঞ প্রতিটি লোকই জানেন যে ইউরোপ, আমেরিকার অর্থাৎ পাশ্চাত্য জগতের ঈধঃঃষব গরু মহিষ, বকরী ভেড়া ইত্যাদি প্রাণীর আকার বাকি দুনিয়ার অন্যান্য দেশে পালিত গৃহপালিত পশুর চেয়ে অনেক বড়, কোনো কোনোটা একেবারে দ্বিগুণ এবং ওগুলো প্রাচ্যের পশুগুলির চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি দুধ দেয়। ও দু’টোই ওরা সম্ভব করেছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে। অর্থাৎ দাজ্জাল তার শক্তিবলে স্বাভাবিকের চাইতে অপেক্ষাকৃত বড় এবং বেশি দুগ্ধ উৎপাদনকারী গৃহপালিত পশু উৎপাদন করতে পারবে।
৪. দাজ্জাল মাটির নিচের সম্পদকে আদেশ করবে ওপরে উঠে আসার জন্য এবং সম্পদগুলি ওপরে উঠে আসবে এবং দাজ্জালের অনুসরণ করবে। [নাওয়াস বিন সা’মান (রা.) থেকে- মুসলিম, তিরমিযি] দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার জন্মের আগে ভূ-গর্ভস্থ অর্থাৎ মাটির গভীর নিচের খনিজ সম্পদ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত ছিলো। মাটির সামান্য নিচের কিছু কিছু সম্পদ মানুষ কখনো কখনো আহরণ করতে পারত। এই সভ্যতার সৃষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দাজ্জাল মাটির গভীর নীচ থেকে, এমনকি সমুদ্রের তলদেশ থেকে তেল, গ্যাস ইত্যাদি নানা রকমের খনিজ সম্পদ ওপরে উঠিয়ে আনতে স¶ম হয়েছে ও পৃথিবীময় তা ওঠাচ্ছে। এটাকেই মহানবী বলেছেন যে, দাজ্জালের আদেশে মাটির নিচের সম্পদ ওপরে উঠে আসবে। তারপর ঐ সম্পদ দাজ্জালকে অনুসরণ করবে তার অর্থ হলো এই যে, মাটির নিচ থেকে ওপরে উঠে আসার পর দাজ্জাল তা পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যাবে, যেখানে ইচ্ছা পাঠাবে, ঐ সম্পদ দাজ্জালের যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, জাহাজ, গাড়ী, যুদ্ধের যানবাহন ইত্যাদি সমস্ত কিছুতে ব্যবহার করবে। আজ বিশ্বনবীর ভবিষ্যদ্বাণী অ¶রে অ¶রে সত্যায়িত হয়েছে।
৫. দাজ্জালের কাছে রিজিকের বিশাল ভাণ্ডার থাকবে। সেখান থেকে সে যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। যারা তার বিরোধিতা করবে তাদের সে ঐ ভাণ্ডার থেকে রেযেক দেবে না। এইভাবে সে মুসলিমদের অত্যন্ত কষ্ট দেবে। যারা দাজ্জালকে অনুসরণ করবে তারা আরামে থাকবে আর যারা তা করবে না তারা কষ্টে থাকবে। [বুখারী ও মুসলিম]
এখানে প্রথমেই পরিষ্কার করে নেয়া দরকার যে রিজিক শব্দের অর্থ শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়। রিজিক বলতে খাদ্যদ্রব্য, বাড়ি-ঘর, গাড়ি-ঘোড়া, টাকা-পয়সা সবই বোঝায়। এক কথায় পার্থিব সম্পদ বলতে যা বোঝায় তা সবই রিজিক। দাজ্জালের কাছে অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ইহুদি-খ্রিষ্টান যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে যে রিজিকের বিপুল ভাণ্ডার আছে এ কথা ব্যাখ্যা করার কোনো প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর সম্পদের সিংহভাগই তাদের দখলে। এই সম্পদ থেকে দাজ্জাল কাদের দেয়? শুধু তাদের দেয় যারা তাকে মেনে নিয়েছে, তাকে স্বীকার করেছে, আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান ত্যাগ করে দাজ্জালের সৃষ্ট তন্ত্রমন্ত্র, বাদ, নীতি গ্রহণ করেছে। যারা দাজ্জালকে প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জাল তাদের দেয় না, যদিও আজ দাজ্জালকে প্রত্যাখ্যান করার প্রায় কেউ নেই। আজ যদি কোনো দেশ, জাতি বা জনগোষ্ঠী দাজ্জালকে অস্বীকার করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে ও কোর’আন হাদিসের ব্যবস্থায় সমষ্টিগত জীবন যাপন করতে চেষ্টা করে তবে কি হবে?
নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার কাছ থেকে শুধু সর্বপ্রকার সাহায্যই বন্ধ হয়ে যাবে না, সমস্ত পাশ্চাত্য জগতের বিরোধিতা আরম্ভ হয়ে যাবে। এ বিরোধিতা শুধু দাজ্জাল নয়, দাজ্জালের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নিয়ে দাজ্জালের পায়ে সেজদায় অবনত অন্যান্য জাতিগুলির মানুষও, যার মধ্যে ‘মুসলিম’ নামধারীরাও আছেন, তাদের কাছ থেকেও আসবে। পৃথিবীর যে কোনো দেশ বা জাতি দাজ্জালের একটু অবাধ্যতা করলেই তাকে সব রকম সাহায্য দেয়া বন্ধ (Economic Sanction) করে দেওয়া হয়, তার ওপর অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক অবরোধ (Embargo) চাপিয়ে দেওয়া হয়। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক সাহায্য তহবিল (Consortium) ইত্যাদি, এক কথায় দাজ্জালের অধীনে যত কিছু আছে তার কোনো কিছু থেকেই কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না। এভাবে রসুলাল্লাহর বর্ণিত এই হাদিসের সত্যতা গত ১০০ বছরে দাজ্জালীয় সভ্যতার পৃথিবীজুড়ে মুসলমানদের সাথে করা হত্যাযজ্ঞ দেখলে সহজেই বুঝা যায়। এখন গাজায় জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে ইসরায়েল। বোমার আঘাতে সেখানকার অধিকাংশ স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গাজাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এমনকি মুসলিম নামধারী দাজ্জালের পদানত দেশগুলোও মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না। কারণ তাতে যে প্রভুদের করুণার হাত মাথা থেকে সরে যাবে।
একইভাবে ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জনগণকে গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যখন ক্ষেপিয়ে দিল তখন সবগুলো দেশে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হল। পশ্চিমারা এর নাম দিল আরব বসন্ত। এরপর তারা এসব দেশে সরকার উৎখাতের জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে অস্ত্রশস্ত্র ধরিয়ে দিল। তার ফলাফল কী হল? সেইসব দেশ সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন আজ গণকবর। লক্ষ লক্ষ মানুষ মাটির সাথে মিশে গেছে। তার আগে ২০০৩ সালে ‘গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র’ তৈরির ডাহা মিথ্যা কথা রটিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভু আমেরিকা ইরাকের উপর হামলা চালিয়ে দশ লক্ষ ইরাকি মুসলমানকে মেরে ফেলল। এর কোন বিচার তো দূরের কথা, বিচার দাবি করার সাহসও কারও নেই।
কাজেই পাঠক একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বর্তমানের ইহুদী-খ্রিষ্টান এই জড়বাদী সভ্যতাই যে, রসুলাল্লাহর (সা.) বর্ণিত সেই আখেরী যামানার দাজ্জাল সে বিষয়ে জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী অকাট্য সব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু সবাই দাজ্জালকে চিনতে পারবে না। চিনবে কেবল মো’মেনরা। আল্লাহর রসুলের একটি হাদিসে এটি উল্লেখ করা হয়েছে, দাজ্জালের কপালে ‘কাফের’ লেখা থাকবে; মো’মেনরা নিরক্ষর হলেও তা পড়তে পারবে, কিন্তু যারা মোমেন নয় তারা মহাজ্ঞানী হলেও পড়তে পারবে না (আনাস বিন মালিক রা. থেকে বোখারি)। এ কথা থেকে সহজেই বুঝা যায়, দাজ্জালের কপালের ঐ ‘কাফের’ লিখাটি অ¶র দিয়ে হবে না। বিশাল বাহনে (যান্ত্রিক প্রযুক্তি) আসীন দানব বলে দাজ্জালকে (ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতা) যেমন রসুলাল্লাহ (সা.) রূপকভাবে বর্ণনা করেছেন তেমনি দাজ্জালের কপালের ওই কাফের লিখাটিও রসুলাল্লাহ (সা.) রূপকভাবে বর্ণনা করেছেন। তাই আজকে যারা মো’মেন আছেন তাদেরকে দাজ্জাল চেনার চেষ্টা করতে হবে।
যেহেতু দাজ্জাল বিষয়টি খুবই চিত্তাকর্ষক, তাই বহু ইসলামী পণ্ডিত এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন। তারাও তাকে একটি দৈত্যাকার একচক্ষুবিশিষ্ট দানব বলেই ব্যাখ্যা করছেন। বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবসম্মত যুক্তিগ্রাহ্য কোন সমাধান কেউ দিতে পারছেন না। মিডিয়াগুলোও হয়তো চটকদার বিষয়ের দর্শকচাহিদা মাথায় রেখে রমজান মাসের উপযোগী বিষয় হিসাবে দাজ্জালকে বেছে নিয়েছে। তবে দাজ্জাল নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে এটা একটি ইতিবাচক বিষয়। যে বিষয়কে আল্লাহর রসুল (সা.) আদমের সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুতর ও সংকটজনক বিষয় বলে গেছেন এবং তাঁর উম্মাহকে সাবধান করে গেছেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা এখন সময়ের দাবি। গণমাধ্যম এ বিষয়ে আলোচনা করলেও তারা কোন সিদ্বান্ত দিতে পারে নি। দাজ্জাল সম্পর্কে সবচেয়ে যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। তাঁর ব্যাখ্যা অনুসারে আজ থেকে প্রায় পাঁচশত বছর আগে দাজ্জালের তথা ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতার জন্ম হয়েছে এবং বর্তমানে সে পূর্ণ শক্তিতে সমগ্র পৃথিবীর এককভাবে কর্তৃত্ব করছে। এখন প্রত্যেক মো’মেন মুসলমানের উচিত হচ্ছে, দাজ্জালের পরিচয় জানা এবং এই ধর্মহীন বস্তুবাদী আত্মাহীন ভারসাম্যহীন পাশ্চাত্য সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর দেওয়া দীন বা জীবনব্যবস্থাকে সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। তাহলেই মানবজাতি বাঁচবে এবং শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।
[লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...