আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন এবং আল্লাহর রসুলও বিদায় হজের ভাষণে দীন, জীবনব্যবস্থা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। বাড়াবাড়ি অর্থ হচ্ছে অতি বিশেষণ এবং যতটুকু বলা হয়েছে তার চেয়ে বেশি বেশি করা, আধিক্য (তাশাদ্দুদ) করা। এমন কোন কাজ দেখলে রসুলাল্লাহ রেগে লাল হয়ে যেতেন এবং যারা তা করত তাদেরকে কঠিনভাবে তিরস্কার করতেন।
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে মাসলাহ জানতে চাইলে বিশ্বনবী (দ.) প্রথমে তা বলে দিতেন। কিন্তু কেউ যদি আরও একটু খুঁটিয়ে জানতে চাইতো তাহলেই তিনি রেগে যেতেন। একদিন একজন পথে পড়ে থাকা জিনিসপত্র কি করা হবে এ ব্যাপারে রসুলাল্লাহর (দ.) কাছে মাসলাহ জিজ্ঞাসা করায় তিনি তার জবাব দিয়ে দিলেন। ঐ লোকটি যেই জিজ্ঞাসা করলেন যে যদি হারানো উট পাওয়া যায় তবে তার কি মাসলাহ? অমনি সেই জিতেন্দ্রীয় মহামানব এমন রেগে গেলেন যে তার পবিত্র মুখ লাল টকটকে হয়ে গেলো (হাদীস-যায়েদ এবনে খালেদ জুহানী (রা.) থেকে বুখারী)।
কিন্তু তার অত ক্রোধেও অত নিষেধেও কোন কাজ হয় নি। তাঁর জাতিটিও ঠিক পূর্ববর্তী নবীদের (আ.) জাতিগুলির মত দীন নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে অতি মুসলিম হয়ে মাসলা-মাসায়েলের তর্ক তুলে বিভেদ সৃষ্টি করে হতবল, শক্তিহীন হয়ে শত্রুর কাছে পরাজিত হয়ে তাদের গোলামে পরিণত হয়েছ। আজও আমাদের আলেম সমাজ মতভেদে লিপ্ত আছেন অতি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে। তার কয়েকটি উদাহরণ দিই:
১. জানাজার নামাজ পড়ার পর বা পাঞ্জেগানা নামাজের পর মোনাজাত করা যাবে কি যাবে না?
২. নবীজি মাটির তৈরি নাকি নূরের তৈরি?
৩. আল্লাহ সাকার নাকি নিরাকার?
৪. নবীজির ছায়া পড়ত নাকি পড়ত না?
৫. মেরাজ কি সশরীরে নাকি স্বপ্নযোগে?
৬. মিলাদে দরুদ কি দাঁড়িয়ে হবে নাকি বসে হবে?
৭. আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান নাকি আরশে সমাসীন?
৮. রাফুলইয়াদাইন হবে কি হবে না?
৯. বেতেরের নামাজ ৩ রাকাত নাকি ১ রাকাত?
১০. তারাবি ৮ রাকাত নাকি ২০ রাকাত?
১১. নেকাব বাধ্যতামূলক নাকি ঐচ্ছিক?
১২. এমাম সুরা ফাতিহা পড়ার পর মুক্তাদিরা আমিন জোরে নাকি আস্তে বলবেন?
১৩. ঈদের নামাজে ও জানাজার নামাজে কয় তাকবির হবে?
১৪. টাই বাঁধা জায়েজ নাকি নাজায়েজ?
১৫. দোয়াল্লিন হবে নাকি জোয়াল্লিন হবে?
১৬. সালাতের তাশাহুদ পড়ার সময় তর্জনি উঠবে নাকি উঠবে না?
১৭. পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা যাবে কি যাবে না?
১৮. পানি বসে খেতে হবে নাকি দাঁড়িয়ে খাওয়া জায়েজ?
১৯. দাড়ি রাখা সুন্নত নাকি ওয়াজিব?
২০. এমামের পেছনে মুক্তাদিরা কি মনে মনে সুরা ফাতিহা পড়বেন নাকি পড়বেন না?
২১. মাজহাব মানা ফরজ নাকি নিষিদ্ধ?
২২. নবীজির ছায়া পড়ত নাকি পড়ত না, তাঁর প্রশ্রাব পায়খানা পবিত্র নাকি অপবিত্র, তাঁর ঘামে সুগন্ধ ছিল নাকি ছিল না?
২৩. খতম তারাবির বিনিময়ে টাকা নেওয়া যাবে কি যাবে না?
২৪. নবীজি হাজির নাজির কিনা, হায়াতুন্নবী কিনা, গায়েব জানেন কিনা?
২৫, পাগড়ির রং কী হবে, টুপি কী আকৃতির হবে, দাড়ি কতটুকু হবে?
২৬. ইফতার কি মাগরেবের আযানের সঙ্গে সঙ্গে হবে নাকি চারিদিক অন্ধকার হওয়ার পর হবে?
২৭. নূরে মোহাম্মদী আগে সৃষ্টি হয়েছে নাকি মহাবিশ্ব?
২৮. শবে বরাত, কুলখানী ইত্যাদি জায়েজ নাকি বেদাত?
২৯. খোতবা আরবিতে পড়তে হবে নাকি বাংলায় পড়া যাবে?
৩০. মেয়ে ও ছেলেদের নামাজ একই রকম নাকি ভিন্ন?
৩১. নামাজে হাত কোথায় বাঁধা হবে, বুকে নাকি নাভির নিচে?
৩২. মাইকে আযান দেওয়া যাবে কিনা, ডাইনিং টেবিলে খাওয়া যাবে কিনা?
৩৩. জুম্মার দিন সানি আজান মসজিদের ভিতরে হবে না বাহিরে হবে?
৩৪. আল্লাহর রসুল এন্তেকাল করেছেন নাকি এন্তেকাল করবেন?
এর একটির সঙ্গেও দীনের বুনিয়াদি বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব বিষয়বস্তু জাতির মধ্যে কেবল বিভক্তিই সৃষ্টি করে যাচ্ছে। আজ যদি রসুলাল্লাহ থাকতেন তাহলে তাঁর উম্মাহর আলেম দাবিদারদের এই মূর্খতাসুলভ ও জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ডকে তিনি নিঃসন্দেহে কঠোরহস্তে দমন করতেন।