মোহাম্মদ আসাদ আলী
ইসলামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হচ্ছে- আকীদা, ঈমান ও আমল। বলা যায় এই তিনটি বিষয় নিয়েই সামগ্রিক ইসলাম। ইসলামে যা কিছু রয়েছে, তার সমস্তই হয় আকীদা, বা ঈমান, বা আমলের অন্তর্ভুক্ত। এগুলো এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলাম সম্পর্কে, আল্লাহর রসুল সম্পর্কে, পবিত্র কোর’আন সম্পর্কে কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে এই তিনটি পরিভাষা ও তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কটি আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন। তা না জানলে যতই কোর’আন হাদিস তাফসির ফিকাহর কিতাব চষে বেড়ানো হোক, এই দ্বীনকে বোঝা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে আকীদা, ঈমান ও আমল সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে লেখাপড়া না জানা নিরক্ষর ব্যক্তিও ইসলামকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যেমনটা আল্লাহর রসুলের সাহাবীরা হয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে আমরা পরিভাষা তিনটির সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।
আকীদা:
আকীদা বলতে বোঝায় সামগ্রিক বা সম্যক ধারণা (Comprehensive concept, Overall idea) রল হাতি দেখতে কীরকম! তারা কেউ হাতির পা ধরে ভাবল হাতি খাম্বার মতো। কেউ হাতির কান ধরে ভাবল হাতি কুলার মতো। কেউ হাতির লেজ ধরে ভাবল হাতি রশির মতো। তারা যদিও হাত দিয়ে স্পর্ষ করেই মন্তব্য করল, কিন্তু তাদের ধারণা হলো ভুল, কারণ একনজরে পুরো হাতিটি তারা দেখতে পায়নি। কারণ তাদের দৃষ্টিশক্তি নেই। আকীদা হচ্ছে ওই দৃষ্টিশক্তির মতো, যা দিয়ে কোনো বস্তু বা বিষয়কে সামগ্রিকভাবে এক নজরে দেখতে ও বুঝতে পারা যায়।
ঈমান:
‘ঈমান’ হচ্ছে বিশ্বাস। আল্লাহ, রসুল, মালায়েক, তাকদির, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম, কেতাবসমূহ ও নবী-রসুলগণের প্রতি বিশ্বাস। যেমন আমরা সবাই বিশ্বাস করি- ‘পবিত্র কোর’আন হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ, কোনো মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়।’ আরও বিশ্বাস করি আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসুল প্রেরণ করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বশেষ যিনি পৃথিবীতে এসেছেন তিনি আমাদের বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)। আমরা মৃত্যুর পরে আখেরাতে বিশ্বাস করি এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই- এই কলেমায় বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাসগুলো পোষণ করাই ‘ঈমান’।
আমল:
ঈমানভিত্তিক যে কাজগুলো করা হয় সেটাই আমল। যেমন, আমরা পবিত্র কোর’আনে ঈমান বা বিশ্বাস রাখি। এই বিশ্বাসভিত্তিক যে কাজগুলো আমরা করি অর্থাৎ পবিত্র কোর’আনে যেসব কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলোই আমল। যেমন সালাহ, যাকাত, হজ্ব, জেহাদ, কিতাল, দান, সদকা ইত্যাদি। আবার যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি মোহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত রসুল, কাজেই তিনি যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন সেই কাজগুলো করার চেষ্টা করি। ওগুলোও আমল।
আকীদা, ঈমান ও আমলের মধ্যকার সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে প্রায় সকল মাজহাবের আলেমরাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন যে, ‘আকীদা ছাড়া ঈমান অর্থহীন হয়ে যায়।’ আর ঈমান অর্থহীন হয়ে গেলে আমলের কোনো মূল্য থাকে না তা তো সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়। একটি উদাহরণ দিলে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হবে। আমরা জানি পবিত্র কোর’আন হচ্ছে আল্লাহর প্রেরিত গ্রন্থ, কোনো মানুষের রচিত গ্রন্থ নয়- এই বিশ্বাস পোষণ করা ‘ঈমান’। কিন্তু পাঠকরা একবার ভাবুন তো, আল্লাহ এই কিতাব কেন পাঠালেন, এর উদ্দেশ্য কী, লক্ষ্য কী তা যদি আমরা না জানি তাহলে ওই বিশ্বাসটুকুর কোনো অর্থ থাকে কি? আল্লাহ কোর’আন নাজেল করেছেন যেন মানুষ সত্য-মিথ্যা বাছাই করে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক জীবনযাপন করতে পারে। আপনি যখন কোর’আনের এই আকীদা জানবেন তখন আপনি কী করবেন? আপনি চেষ্টা করবেন এমন সমাজব্যবস্থা নির্মাণ করতে যেই সমাজ আল্লাহর দেওয়া হুকুম মোতাবেক পরিচালিত হবে। তখন আপনার আমলগুলো হবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অভিমুখী। আপনি কোর’আন পড়বেন কিন্তু উদ্দেশ্যহীনভাবে নয়, জীবনের কোন অঙ্গনের জন্য আল্লাহ কী হুকুম দিয়েছেন তা জানার জন্য। এতে আপনার আমল হবে সার্থক আমল। পক্ষান্তরে যিনি কোর’আনের আকীদা জানেন না তার কাছে আল্লাহর হুকুম দিয়ে জীবন পরিচালনা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে না, তিনি সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন, ওগুলো আল্লাহর হুকুমে চলছে নাকি মানুষের হুকুমে চলছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, তিনি কেবল কোর’আন তেলাওয়াত করে প্রতি হরফে কত নেকি হচ্ছে সেই হিসাবে মশগুল থাকবেন। তার ঈমান থাকলেও এই দ্বীনের কোনো উপকার তার দ্বারা হবে না। অর্থাৎ আকীদা সঠিক না ভুল তার সাপেক্ষে নির্ধারিত হচ্ছে বিশ্বাস যথার্থ হবে নাকি অর্থহীন হবে, আমল সঠিক হবে নাকি ভুল হবে! এজন্যই আমলের আগে প্রয়োজন ঈমান, আর ঈমানের আগে আকীদা।