মুস্তাফিজ শিহাব
বর্তমান সময়ে আমরা এমন একটি সময়ে এসে উপনীত হয়েছি যে, ধর্মের বিনিময় গ্রহণ এখন স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মের কোনো কাজ করার ফলে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণিকে ধর্মের বিনিময় প্রদান করতেই হবে এমন একটি চেতনাই সাধারণ জনগণের মাঝে অধিক প্রচলিত। কিন্তু মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে ধর্মব্যবসাকে স্পষ্ট নিষিদ্ধ করেছেন এবং রসুলের সময়েও এইরূপ কোনো ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ছিল না। ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ এ সম্পর্কে অকাট্য দলিল থাকা সত্ত্বেও অনেকেই করুণার বশবর্তী হয়ে এই ধর্মজীবীরা কীভাবে সংসার চালাবে সে প্রশ্ন করে থাকেন। কিন্তু যে কাজটি মহান আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন, রসুল যে কাজটি না করার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে গিয়েছেন সে কাজটি কোনো যুক্তিতেই সিদ্ধ করার কোনো সুযোগ নেই।
প্রথম কথা হচ্ছে ধর্মব্যবসা নিষিদ্ধ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ। মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে স্পষ্ট বলেছেন, “আর যারা আয়াত গোপন করে এবং এর বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা পেটে আগুন ছাড়া কিছুই ঢুকায় না। আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না; মূলত তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আজাব (সুরা বাকারা ১৭৪)।” যে কাজটি স্বয়ং মহান আল্লাহ বলছেন আগুন খাওয়ার সমতুল্য তখন সে কাজটি বন্ধ করার কথা উঠলে যারা বলেন ‘তারা খাবে কী?’ তাদের উচিত আল্লাহকে প্রশ্ন করা কারণ মহান আল্লাহ কাজটিকে আগুন খাওয়ার সমতুল্য বলেছেন এবং তিনি নিষিদ্ধ করেছেন।
একটি উদাহারণ দেয়া যায়। ধরুন একটি দেশে অনেকদিন ধরে একটি অপসংস্কৃতি বা ভুল ব্যবস্থা চলে আসছে। সে দেশে অনেক মানুষ চুরি-ডাকাতির সাথে সম্পৃক্ত। এখন যদি কোনো ব্যক্তি প্রশ্ন তুলেন যে, চুরি-ডাকাতি সমাজের জন্য অকল্যাণকর, চুরি ডাকাতি বন্ধ করা উচিত! তাহলে কী আপনি প্রশ্ন তুলবেন, এই চোর ডাকাতরা খাবে কী? তাদের সংসার কীভাবে চলবে? আপনি খাওয়াবেন? প্রশ্নটি যতই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হোক না কেনো প্রকৃতপক্ষে বিবেকবান কোনো মানুষই এ কথার সাথে একমত হবেন না। অবশ্যই আইন সংশোধন করে চুরি-ডাকাতি বৈধ এ বলে রায় দেয়ার কথা কেউই ভাববেন না। এই একই কথা সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি ও ধর্মব্যবসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
মহান আল্লাহ প্রত্যেক মো’মেনকে হালাল উপার্জন করা নির্দেশ দিয়েছেন। কোর’আনে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মো’মেনগণ, সালাহ সমাপ্ত হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (অর্থাৎ রেজেক) সন্ধান করবে (সুরা জুমা ১০)।” এখানে আল্লাহ সকলের খাওয়ার পথ বলে দিচ্ছেন। ধর্মব্যবসায়ীরা কীভাবে খাবেন তার সমাধান এখানেই রয়েছে। আল্লাহ স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে সালাহ শেষ হবার পর সকলকে জমিনে উপার্জন করার জন্য ছড়িয়ে পড়তে। আল্লাহ অবশ্যই বলেননি মসজিদের ইমাম ব্যতিত আর সবাই উপার্জনের জন্য ছড়িয়ে পড়–ক? ইসলামে পরনির্ভরশীলতা অত্যন্ত ঘৃণ্য বিষয়।
তাই উপার্জন করা অত্যাবশ্যক। প্রত্যেক নবী রসুল উপার্জনের মাধ্যমে নিজেদের সংসার চালাতেন এবং তারা ধর্মের কাজ করে কোনো বিনিময় গ্রহণ করতেন না কারণ ধর্মের কাজের বিনিময় স্বয়ং মহান আল্লাহ দিবেন। আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে রসুলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “(হে মোহাম্মদ) তুমি কী তাদের নিকট মজুরী চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনি শ্রেষ্ঠ রেজেকদাতা (সুরা মো’মেনুন ৭২)।”
আদি পিতা ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ.) একজন কৃষক ছিলেন। শিশ (আ.) ছিলেন তাঁতি, ইদ্রিস (আ.) ছিলেন দর্জি, নূহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। আল্লাহ তাঁকে জাহাজ নির্মাণের শিক্ষা দিয়েছিলেন। হুদ (আ.) ছিলেন ব্যবসায়ী, সালেহ (আ.) ছিলেন উটের রাখাল। ইব্রাহিম (আ.) আলেপ্পোতে দুগ্ধজাত দ্রব্য বিক্রি করতেন। ইসমাইল (আ.) ছিলেন একজন শিকারী। শোয়াইব (আ.) এর ছাগলের খামার ছিল। মুসা (আ.) ছাগল চড়াতেন, ইলিয়াস (আ.) ছিলেন তাঁতি। দাউদ (আ.) ছিলেন লোহার বর্ম ও হাতিয়ার নির্মাতা, সোলাইমান (আ.) বাদশাহ ছিলেন তবুও তিনি খেঁজুরের পাতা দিয়ে বাক্স তৈরি করতেন। যাকারিয়া (আ.) ছিলেন করাতি, ঈসা (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি এবং সর্বশেষ নবী ও রসুল (স.) পেশায় একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর উটের খামার ছিল এবং তিনি ছাগল ও ভেড়া পালন করতেন। এছাড়াও তিনি প্রয়োজনে এক ইহুদির কূপ থেকে পানি তুলে দেয়ার কাজও করেছেন।
তাহলে এত নবী রসুল যখন ধর্মের বিনিময় গ্রহণ করেননি বরং হালাল উপয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন সেখানে যে সকল ওলামায়ে কেরাম ধর্মব্যবসা করে খাচ্ছেন তারা কী নবী-রসুলদেরও অতিক্রম করে গিয়েছেন নাকি? (নাউজুবিল্লাহ)
জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে রচিত ‘মহানবীর ভাষণ’ থেকে আল্লাহর রসুলের একটি উদ্বৃতি তুলে ধরছি, “হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা নির্বাহের জন্র সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করো এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে কোনো মো’মেনের সত্তাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সাথে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এই নয় যে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরি বিষয়।”
অতএব যারা আল্লাহ ও রসুলের কথা অমান্য করে ধর্মব্যবসা করে যাচ্ছেন তাদের জন্য ‘তারা খাবে কী?’ এ প্রশ্ন করা অনুচিত। ইসলামের শরিয়ত মোতাবেক সফল ব্যক্তির প্রথম কাজই হচ্ছে তার নিজের ও পরিবারের জন্য উপার্জন করা। তাই যারা ধর্মব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন তাদের উচিত এই হারাম কাজ থেকে দূরে থেকে হালাল উপায়ে উপার্জন করা। এছাড়াও যে ব্যক্তি মসজিদে সালাহ করাচ্ছেন, যিনি পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে সালাহ করালে তিনি রিযিক করার সময় পান না তার জন্য ইমামতি করা জরুরী নয়, বৈধও নয়। তার প্রথম কর্তব্য হালাল রুজির সন্ধান করা, কারণ ইমাম শব্দের অর্থ নেতা। পরনির্ভরশীল ব্যক্তি দ্বারা নেতৃত্বপ্রদান অসম্ভব।
যারা বলেন ‘তাহলে তারা খাবে কী?’ তারা করুণার বশে কথাটি বলেন কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই একটি বিষয়কে শুধু শুধু নিষিদ্ধ করেননি। যা মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর তিনি তাই হারাম করেছেন। আপনার শরীরে যে সকল জীবাণু রোগ বিস্তার করে আপনি সেগুলোকে ধ্বংস করেন। অবশ্যই আপনি বলেন না এগুলো আপনার শরীরকে পোষক হিসেবে ব্যবহার করেছে, এদের ধ্বংস করা যাবে না। রোগজীবাণুরও জীবন আছে, আমরা তাদের জীবননাশ করতে পারি না। অবশ্যই আপনারা এ ধরনের প্রশ্ন তুলেন না। ধর্মব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
পরিশেষে, কেউ জীবিকা শূন্য হোক এটা অবশ্যই কাম্য নয়। কিন্তু যারা ধর্মব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা পক্ষাঘাতগ্রস্থ নন, প্রতিবন্ধীও নন। বর্তমানে এসে তারা পরজীবিতে পরিণত হয়েছে। তাদের উচিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে তারা জীবিকার মাধ্যম হিসেবে না নিয়ে পরকালের জন্য সঞ্চয় করুক এবং ইহকালে তারা কায়িক পরিশ্রম বা অন্য কোনো উপায়ে হালাল রুজির ব্যবস্থা করুক। এতে একদিকে যেমন তারা আল্লাহ কাছে পুরস্কৃত হবে, সম্মানিত হবে অন্যদিকে সমাজেও তাদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। অতএব সাধারণ মানুষ ও ধর্মব্যবসায়ী আলেম উভয়ের এখন এই সত্যকে উপলব্ধি করা উচিত এবং সত্যকে স্বীকার করে সে অনুযায়ী নিজেদের গড়ে তোলা উচিত।
(মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি (facebook/glasnikmira13)